শনিবার, ১৮ মে, ২০২৪ ০০:০০ টা

অসতর্কতায় বাড়ছে ট্রেনে কাটা মৃত্যু

২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত ১ হাজার ৪০৭ জনের মৃত্যু

আলী আজম

রেললাইনের পাশে দাঁড়িয়ে চলন্ত ট্রেনের ভিডিও করছিলেন আদমজী ক্যান্টনমেন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র ফয়সাল (১৮)। এ সময় উল্টো দিক থেকে আসা অন্য ট্রেনের ধাক্কায় ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। ১০ মে রাজধানীর কুড়িল বিশ্বরোডে মর্মান্তিক এ ঘটনাটি ঘটে। একই দিন নীলফামারীর সৈয়দপুর-চিলাহাটি রেলপথের গোলাহাট বাইপাস সড়কের রেলক্রসিং এলাকায় ট্রেনে কাটা পড়ে আরমান হোসেন (৩৭) নামে এক পল্লী চিকিৎসকের মৃত্যু হয়। তিনি মোবাইল ফোনে কথা বলতে বলতে রেললাইন পার হতে গিয়ে ট্রেনে কাটা পড়েন। ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলার গয়েশপুর বাজার থেকে গত রবিবার বিকালে রেলসেতুর ওপর দিয়ে হেঁটে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার কাওরাইদ বাজারে যাচ্ছিলেন দুই ব্যক্তি। ট্রেন আসতে দেখে তারা দৌড়ে ব্রিজ পার হওয়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। ঢাকা থেকে ময়মনসিংহগামী দ্রুতগতির মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনের ধাক্কায় তাদের মৃত্যু হয়। সর্বশেষ সোমবার রাতে খিলগাঁওয়ের গুলবাগে চলন্ত ট্রেনের নিচে কাটা পড়ে সিফাত (১৮) নামে এক শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়। সে এ বছর এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিল। রেললাইনে এমন মৃত্যুর চিত্র এখন সারা দেশের। অসতর্কতায় বাড়ছে ট্রেনে কাটা পড়ে মৃত্যুর সংখ্যা।

রেলওয়ে পুলিশসূত্র জানান, ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত ট্রেনে কাটা পড়ে ১ হাজার ৪০৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। ১ হাজার ১০৯ জন পুরুষ, ২৯৮ জন নারী। এ ঘটনায় বিভিন্ন থানায় অপমৃত্যু মামলা হয়েছে ১ হাজার ৩৯৩টি। মৃতের মধ্যে ০ থেকে ১৮ বছর বয়সী ১২৮, ১৯ থেকে ৫০ বছর বয়সী ৮৭৬ এবং ৫০-এর ঊর্ধ্বে ছিলেন ৪০৩ জন। এর মধ্যে ছাত্রছাত্রী ৯১, শ্রমজীবী ৭২০, চাকরিজীবী ১১৪ এবং অজ্ঞাত ৪৮২ জন। ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত ট্রেনে কাটা পড়ে মৃতের মধ্যে হেডফোনের কারণে ৫৫, রেললাইনের ওপর বসা বা চলাচলে ৬৭৩, রেল ক্রসিংয়ে দ্রুত পারাপারের চেষ্টায় ৪৮৫, ট্রেনের ছাদ থেকে পড়ে ২৬ এবং অজ্ঞাত কারণে মারা যান ১৬৮ জন। বছরে সারা দেশে ট্রেনে কাটা পড়ে যে মৃত্যু হয়, তার বড় একটি অংশ হয় ঢাকা রেলওয়ে জেলাতেই। প্রতি বছর ঢাকা রেলওয়ে জেলায় ৪ শতাধিক লোক ট্রেনে কাটা পড়ে মারা যাচ্ছে। জানা গেছে, আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে চলা এসব ট্রেন দুর্ঘটনায় প্রায়ই পরিচয় মিলছে না অনেকের। প্রচার চালানোর পরও পরিচয় শনাক্ত না হওয়ায় অনেককে বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করতে হচ্ছে। রেল বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুর্ঘটনার আসল সংখ্যা এর চেয়ে বেশি। প্রতি বছর এ বিপুলসংখ্যক মৃত্যুর পরও রেললাইনগুলো ব্যবহার হচ্ছে হাঁটার পথ হিসেবে, অথচ এটি যে আইনত নিষিদ্ধ সে খবরও অনেকেই রাখেন না। ট্রেন যখন ৮০ থেকে ৮৫ কিলোমিটার গতিতে চলে, তখন এটি অন্য গাড়ির মতো ব্রেক করা সম্ভব হয় না। কাজেই ট্রেন তার গতিতেই যাবে। এ ক্ষেত্রে সবাইকে সতর্কতা অবলম্বন করে চলাফেরা করতে হবে।

রেলসংশ্লিষ্টরা বলছেন, ১৮৯০ সালের রেল আইনে রেললাইনের দুই পাশে ১০ ফুটের মধ্যে মানুষের চলাচল নিষিদ্ধ। এমনকি এর মধ্যে গরু-ছাগল ঢুকে পড়লে তা-ও নিলামে বিক্রি করে দেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে রেল কর্তৃপক্ষের। ট্রেনে কাটা পড়ে কেউ আহত হলে উল্টো ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধেই মামলা করতে পারে রেলওয়ে। তবে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ ও রেলওয়ে পুলিশের ইতিহাসে এমন কোনো নজির নেই। কিন্তু এতসব কঠোর নিয়ম থাকার পরও প্রতি বছর ট্রেনে কাটা পড়ে অসংখ্য লোকের মৃত্যু হচ্ছে। রেললাইনে হামেশাই লোকজন ফ্রিস্টাইলে চলাচল করছে। রেললাইন ঘিরে গড়ে উঠছে বসতি ও বাজার। যদিও এটি অবৈধ ও দণ্ডনীয় অপরাধ। রেললাইন ও এর দুই পাশে ১০ ফুট করে সব সময়ের জন্য ১৪৪ ধারা বহাল থাকে। জেনে হোক কিংবা না জেনে এ আইন মানছে না কেউ।

বুয়েটের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের একজন শিক্ষক বলেছেন, ‘দেশে ট্রেন দুর্ঘটনা বেশি হওয়ার প্রথম কারণ রেল ক্রসিংয়ে নিরাপত্তাব্যবস্থা পর্যাপ্ত নয়। দুর্ঘটনা কেন হচ্ছে তার কারণ জানার কোনো চেষ্টা নেই সংশ্লিষ্টদের। কোনো জবাবদিহিও নেই। দুর্ঘটনা কমাতে হলে রেল ক্রসিংয়ে নিরাপত্তার পাশাপাশি লাইনম্যান ও জনবল বাড়াতে হবে।’ রেলওয়ে পুলিশের ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘ট্রেনের নিচে কাটা পড়ে মৃত্যুর বেশ কিছু কারণ রয়েছে। রেললাইনে হাঁটার সময় মোবাইল ফোনে কথা বলা, কানে হেডফোন দিয়ে কথা বলা বা গান শোনার কারণে ৭০ শতাংশ লোকের মৃত্যু হচ্ছে। অন্য কারণগুলো হচ্ছে অরক্ষিত রেল ক্রসিং দিয়ে দ্রুত পারাপারের চেষ্টা, ট্রেনের সঙ্গে যানবাহনের দুর্ঘটনা, চলন্ত ট্রেন থেকে নামার সময়, রেললাইনের ওপর বসে থাকা, অসতর্কভাবে ট্রেন থেকে নামার সময়, অসতর্কভাবে রেললাইনের ওপর দিয়ে হাঁটা বা চলাচল করা, চলন্ত ট্রেনের সঙ্গে সেলফি তুলতে গিয়ে মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে।

রেলওয়ে পুলিশের এসপি (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) মো. তোফায়েল আহমেদ মিয়া বলেন, ‘সচেতনতার অভাবেই ট্রেনে কাটা পড়ে লোকজন প্রাণ হারাচ্ছে।

ট্রেন তার নিজস্ব পথেই চলে। সে পথ কোনো অবস্থায়ই মানুষের হেঁটে চলাচলের রাস্তা হতে পারে না। কিন্তু যত্রতত্র রেললাইন দিয়ে চলাফেরা, রেললাইনের অংশ দখল করে স্থাপনা নির্মাণ, কাঁচাবাজার বসানো এবং অবৈধ রাস্তা তৈরি করে রেললাইন ঘেঁষে চলাচলা করছে লোকজন। এ কারণেই ট্রেন দুর্ঘটনা বাড়ছে। শুধু আইন দিয়ে নয়, সাধারণ মানুষ সচেতন হলে ট্রেনে কাটা পড়ে মর্মান্তিক মৃত্যু কমিয়ে আনা সম্ভব।’

সর্বশেষ খবর