শনিবার, ৮ জুন, ২০২৪ ০০:০০ টা

আবহাওয়া পরিবর্তনে কৃষিতে শঙ্কা

শামীম আহমেদ

আবহাওয়া পরিবর্তনে কৃষিতে শঙ্কা

জমি কমলেও সরকারি প্রণোদনা, উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবন, আধুনিক প্রযুক্তির সমন্বয় ও কৃষকের হাড়ভাঙা পরিশ্রমে বাড়ছে দেশের কৃষি উৎপাদন। চাল উৎপাদনে দেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ। স্বাদু পানির মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে তৃতীয়। প্রান্তিক খামারিরা দৈনিক ডিম উৎপাদন করছে সাড়ে ৪ কোটির বেশি। গ্রীষ্মমন্ডলীয় ফল উৎপাদনে বিশ্বের শীর্ষ ১০ দেশের মধ্যে আছে বাংলাদেশ। তবে কৃষির এ অগ্রযাত্রায় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে জলবায়ু পরিবর্তন। এবারের প্রলম্বিত শীত ও টানা তাপপ্রবাহে কৃষিতে বড় ধাক্কা লেগেছে। উৎপাদন কমেছে ধান, সবজি, ফল, মাছ, মাংস, ডিমসহ অধিকাংশ কৃষিপণ্যের। আবহাওয়ার এ রূপ প্রতি বছর ফিরে এলে ভবিষ্যতে দেশের খাদ্যনিরাপত্তা হুমকিতে পড়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

এ বছর মার্চের শেষ দিন থেকে টানা ৩৭ দিনের দীর্ঘতম তাপপ্রবাহের কবলে পড়ে দেশ। ১৯৪৮ সালের পর এ প্রথম এমন দীর্ঘ সময় ধরে তাপপ্রবাহ। পুরো মে মাসেই ছিল প্রচ- গরম। এমনকি জুনে বৃষ্টি হওয়ার কথা, অথচ ১২-১৩টির বেশি জেলার ওপর দিয়ে তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। গত বছর দেশবাসী ২৩ দিনের টানা তাপপ্রবাহ দেখেছিল। তথ্যানুযায়ী, ১৯৮০ সাল থেকে সব ঋতুতে তাপমাত্রা বাড়ছে। আর এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে কৃষিতে। এবারের টানা তাপপ্রবাহে পরিপুষ্ট হওয়ার আগেই পেকে গেছে বোরো ধান। এতে ফলন কমার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এ ছাড়া বাংলাদেশে সারা বছর উৎপাদিত ফলের এক-চতুর্থাংশের জোগান দেওয়া আম ও লিচুর ফলনও এবার আশানুরূপ হয়নি বলে রাজশাহী ও দিনাজপুর অঞ্চলে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে। গরম, অনাবৃষ্টি, অসময়ে বৃষ্টি ও প্রলম্বিত শীতের কারণে মুকুল আসেনি অনেক গাছে, ঝরে গেছে আম ও লিচুর গুটি। ফলে বাজারে এবার ফল দুটির দামও চড়া। গরমে মারা গেছে বিভিন্ন খামারের মাছ। সেই সঙ্গে মাছের বৃদ্ধিও কমে গেছে। গরমে এপ্রিল-মে মাসে পোলট্রি খাতেও ধস নামে। বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সুমন হাওলাদার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, গরমে এবার ৬০-৬৫ হাজার প্রান্তিক খামারে হিটস্ট্রোকে দৈনিক গড়ে ১ লাখ মুরগি মারা গেছে। দৈনিক ডিমের উৎপাদন কমে যায় ৫০-৬০ লাখ পিস। এমন পরিস্থিতিতে জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে তাপমাত্রাসহিষ্ণু ফসলের জাত ও প্রযুক্তি উদ্ভাবনের তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

দেশের অর্ধেকের বেশি চালের জোগান আসে বোরো মৌসুমে। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) বন্যা, লবণাক্ততা ও খরা সহিষ্ণু উচ্চফলনশীল ধানের জাত উদ্ভাবন করলেও উচ্চতাপ-সহনশীল ধানের জাত এখনো অবমুক্ত করেনি। তথ্যানুযায়ী, ব্রি এ পর্যন্ত ১১৫টি উচ্চফলনশীল ধানের জাত উদ্ভাবন করেছে।

অধিকাংশ ক্ষেত্রে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে একই আবহাওয়ায় ফলন বৃদ্ধির ওপরে। এতে স্বাধীনতার পর আবাদি জমি কমলেও চালের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় সাড়ে তিন গুণ। বর্তমানে বাংলাদেশ প্রায় ৪ কোটি টন চাল উৎপাদন করছে বছরে। তবে ব্রির গবেষকরা বলছেন, বাংলাদেশের ধানের জাতগুলো ২০ থেকে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সবচেয়ে ভালো ফলন দেয়। ফুল ফোটার সময় দিনের তাপমাত্রা ৩৩ ডিগ্রি ছাড়ালে ধানের উৎপাদন হ্রাস পেতে পারে। এবার এপ্রিল-মে’র অধিকাংশ দিন তাপমাত্রা ছিল ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের আশপাশে। এটা বোরোর ফলনে প্রভাব ফেলতে পারে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের (ডিএই) সরেজমিন উইংয়ের উপপরিচালক ড. এইচ এম মনিরুজ্জামান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, তাপমাত্রা ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে উঠলেই ধানের ফলনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এবার গরমের কারণে ১৫ দিন আগেই পেকে গেছে বোরো ধান। ধান পরিপুষ্ট হতে পারেনি। তবে আগে তাপপ্রবাহের এমন সমস্যা হয়নি, তাই সেভাবে জাতও উদ্ভাবন হয়নি। ভবিষ্যতেও গরম অব্যাহত থাকলে উষ্ণতাসহিষ্ণু ধানের জাত চলে আসবে। এবারের তাপপ্রবাহের প্রভাব সব ফসলে পড়বে জানিয়ে এই কৃষিবিদ বলেন, এবার আমের ফলনও কম। আকারে ছোট। যারা গরমের সময় গাছের গোড়ায় সেচ ও গাছে পানি স্প্রে করতে পেরেছেন, তাদের ফলন কিছুটা ঠিক আছে।

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি)-এর পরিচালক (গবেষণা) ড. মোহাম্মদ খালেকুজ্জামান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, উচ্চ তাপমাত্রা ধানের ফলনে কতটুকু প্রভাব ফেলবে তা নির্ভর করছে উৎপাদনের কোন পর্যায়ে এ তাপমাত্রাটা ছিল। ফুল ফোটা ও ধানে দুধ আসার সময় উচ্চ তাপমাত্রা থাকলে ধান চিটা হবে। বিষয়টি আগে থেকেই আমাদের ভাবনায় আছে। এ নিয়ে ১৫ বছর আগে থেকেই কাজ চলছে। তবে আগে এমন টানা গরম কখনো ছিল না। তখন গবেষণার কাজ হাতে নেওয়া হয়েছিল কেবলই খরার কথা মাথায় রেখে। এখন উষ্ণতার বিষয়টাও যুক্ত হয়েছে। ধানের উষ্ণতাসহিষ্ণু কয়েকটি লাইন গবেষণা পর্যায়ে আছে। ট্রায়ালে পাস করলে আগামী এক-দুই বছরের ভেতর উষ্ণতাসহিষ্ণু জাত আমরা দিতে পারব।

এদিকে বাংলাদেশে বছরে এখন প্রায় দেড় কোটি টন ফল উৎপাদন হয়। সবচেয়ে বেশি উৎপাদন হয় আম। দ্বিতীয় অবস্থানে আছে কলা। গ্রীষ্মকালীন ফল হিসেবে শুধু আম ও লিচু দেশের এক-চতুর্থাংশ ফলের জোগান দেয়। এবার এ দুটি ফলেরই উৎপাদন কমেছে বলে খামার পর্যায়ে কথা বলে জানা গেছে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের হর্টিকালচার বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. মোকতার হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এবারের মৌসুমে গরমের কারণে আম ও লিচুর ক্ষতি হয়েছে। গরমে লিচু ঝরে গেছে। পোকা হয়েছে। আমের ফলনও কমবে। অন্যদিকে, শীতের শেষ দিকে কুয়াশা পড়ায় উত্তরবঙ্গে ব্যাপকভাবে লেটই ব্লাইট রোগে আক্রান্ত হয়েছে আলু খেত। এ কারণে এবার আলুর দাম চড়া। তাপমাত্রা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। এখন বিভিন্ন ফসলের তাপমাত্রা ও খরা সহিষ্ণু জাত উদ্ভাবন জরুরি। গবেষণা চলছে। আমরা লবণসহনশীল ফলের জাত উদ্ভাবন করেছি। গরমের ব্যাপারটা এতদিন আলোচনায় ছিল না। এখন গবেষণা করা দরকার। না হলে কৃষির ফলনে বিপর্যয় আসতে পারে।

তবে গরমে ফল উৎপাদনে সমস্যা হবে না বলে মনে করছেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের হর্টিকালচার উইংয়ের পরিচালক কে জে এম আবদুল আউয়াল। তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমাদের সব ফল সাবট্রপিক্যাল অঞ্চলের। গরমে উৎপাদনে সক্ষম। এবার তাপমাত্রা একটু বেড়েছে, বৃষ্টিও কম। এতে সামাজিক ও পারিবারিকভাবে লাগানো ফলের উৎপাদনে কিছুটা সমস্যা হয়েছে। তবে যারা বাণিজ্যিকভাবে ফল আবাদ করেছেন, তাদের সমস্যা হয়নি। তারা সেচ দিয়েছেন, গাছে পানি স্প্রে করেছেন। উল্টো এবার শিলাবৃষ্টি ও কালবৈশাখি না থাকায় যে কটা আম ধরেছিল, সব টিকে গেছে। তবে শীতকাল দীর্ঘমেয়াদি হওয়ায় আম এবার কম ধরেছে। যে তাপে মুকুল আসে, সেই তাপমাত্রাটা ছিল না। আর মুকুল অবস্থায় বৃষ্টিপাত হওয়ায় এবার লিচুর ফলন কম হয়েছে। এর পেছনে গরমের সম্পর্ক নেই।

তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও বৃষ্টিপাত না হওয়ায় নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে মৎস্য খাতেও। মা মাছের ডিম ছাড়ার ছয়টি জোর (অমাবস্যায় প্রজনন সময়) মধ্যে চারটি শেষ হলেও উপমহাদেশের অন্যতম প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র এবং বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ হালদা নদীতে ডিম ছাড়েনি মা মাছ। বাকি রয়েছে দুটি জো। এর মধ্যে ২ থেকে ৮ জুন পঞ্চম এবং ১৯ থেকে ২৫ জুন ষষ্ঠ জো। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা (স¦াদু পানি কেন্দ্র) ড. মো. মশিউর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, মাছের বৃদ্ধির জন্য পানির তাপমাত্রা ২৮ থেকে ৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াস সবচেয়ে ভালো। বাতাসের তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে উঠে গেলে পানির তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রি ছাড়িয়ে যায়। কম গভীরতার জলাশয়ের নিচ পর্যন্ত পানি গরম হয়ে যায়। গরমে মাছ খাবার খাওয়া বন্ধ করে দেয়, এতে মাছের বৃদ্ধি থেমে যায়, পানির অক্সিজেন কমে যায়, মাছের মৃত্যুও হয়। এবারের গরমে অনেক খামারে মাছ মারা গেছে বলে রিপোর্ট পেয়েছি। এ ছাড়া বৃষ্টি না হওয়ায় মাছের প্রজননও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। আমাদের গবেষণাগারে পানি সেচ দেওয়াসহ নানা প্রযুক্তি রয়েছে। সেখানেই মাছে ডিম আসেনি, বড় হচ্ছে না। খামারে তো আরও খারাপ অবস্থা। এখন তাপমাত্রার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে জলাশয়ের গভীরতা বাড়াতে হবে। জলাশয়ের একটা নির্দিষ্ট স্থানে কচুরিপানা দিয়ে বা অন্য উপায়ে ছায়ার ব্যবস্থা করতে হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর