সোমবার, ১ জুলাই, ২০২৪ ০০:০০ টা

রাজশাহী মহানগরীর সরকারি ৪৮ পুকুরের অধিকাংশই ভরাট

অবাধ মাছের খামারে পাঁচ বছরে আবাদি জমি কমেছে ২২ হাজার হেক্টর

কাজী শাহেদ, রাজশাহী

মাসখানেক আগেও যেটি ছিল পুকুর, সেটি ভরাট করে রাতারাতি গড়ে তোলা হয়েছে কলাবাগান। আইনে পুকুর ভরাট নিষিদ্ধ হলেও রাজশাহী মহানগরীর দায়রাপাক মোড় এলাকার এ পুকুর হত্যা ঠেকাতে পারেনি প্রশাসন। রাজশাহী শহরের জিরো পয়েন্টে ‘আরডিএ মার্কেট’। কয়েক দশক আগেও সেখানে বড়কুঠি নামে ২ দশমিক ১৩ একরের একটি পুকুর ছিল। অবৈধভাবে পুকুরটি ভরাট করে ভবন বানিয়েছে রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। শহর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে মোহনপুর উপজেলার মেইল বিল। বিলের পশ্চিম-দক্ষিণে বড় বড় তিনটি পুকুর। মাছ চাষের জন্য সাবেক এমপি দুটি পুকুর কেটেছেন। অন্যটি তার ভাইয়ের। বছর পাঁচেক আগেও সেখানে ধানিজমি ছিল। কৃষকের আপত্তি সত্ত্বেও সে জমি ইজারা নিয়ে কৃষিজমিতে পুকুর কেটেছেন সাবেক এমপি। প্রায় এক দশক আগে রাজশাহী শহরে ৯৫২টি পুকুর ছিল। এর মধ্যে ১ নম্বর খাস খতিয়ানভুক্ত পুকুর ৪৮টি। সরকারি পুকুরের মধ্যে বৈধভাবে নয়টি ও অবৈধভাবে আটটি ভরাট করা হয়েছে। এ ছাড়া বেশির ভাগ পুকুর ভরাট হয়ে গেছে। অন্যদিকে অবাধে মাছের খামার করায় পাঁচ বছরে রাজশাহীতে ২২ হাজার হেক্টর আবাদি জমি কমে গেছে। উল্টো চিত্র শহরের বাইরে।

শহরে ছিল ৯৫২ পুকুর : রাজশাহীতে পুকুর ভরাট ও দখল নিয়ে ২০১৪ সালে ‘হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ’-এর পক্ষে হাই কোর্টে একটি রিট করেন সিনিয়র আইনজীবী মনজিল মোরসেদ। এর পরিপ্রেক্ষিতে নগরীর পুকুর গণনা করে বোয়ালিয়া ভূমি কার্যালয়। খতিয়ান, দাগ নম্বর, জমির পরিমাণসহ মোট ৯৫২টি পুকুরের তালিকা পাওয়া যায়। এর মধ্যে ১ নম্বর খাস খতিয়ানভুক্ত পুকুর ৪৮টি। বাকিগুলো ব্যক্তিমালিকানাধীন। ওই রিটের পরিপ্রেক্ষিতে শহরের পুকুরগুলো সংরক্ষণের নির্দেশ দেন হাই কোর্ট। কিন্তু ভরাট বন্ধ হয়নি।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) রাজশাহী বিভাগীয় সমন্বয়ক তন্ময় কুমার সান্যাল বলেন, ‘পরিবেশসংক্রান্ত প্রচলিত আইন থাকা সত্ত্বেও আইন বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠানগুলো এ বিষয়ে সব সময় উদাসীন থেকেছে।’

সরকারি ৪৮ পুকুরের অধিকাংশই ভরাট : ২০১৪ সালে খাস খতিয়ানভুক্ত ৪৮টি পুকুরের সন্ধান পাওয়া যায়। এর মধ্যে ১৯টিতে পানি আছে। বৈধভাবে অর্থাৎ প্রশাসনের অনুমোদন সাপেক্ষে নয়টি আর অবৈধভাবে আটটি পুকুর ভরাট করা হয়েছে। পুকুর ভরাট করে বানানো হয়েছে ‘আরডিএ মার্কেট’। রাজশাহী চেম্বার ভবন একসময় পুকুর ছিল। নগরীর লক্ষ্মীপুর কাঁচাবাজারের দক্ষিণে পুকুরটিও অবৈধভাবে ভরাট করে ফেলা হয়েছে।

রাজশাহীর জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদ বলেন, ‘শহরে পুকুর ভরাট বন্ধে জেলা প্রশাসন অগ্রণী ভূমিকা রাখবে। এ বিষয়ে তাদের দুর্বলতা নেই। ভরাট বন্ধে আদালত যেভাবে নির্দেশনা দেবেন, জেলা প্রশাসন সেভাবেই কাজ করবে।’

২২ সংরক্ষিত পুকুরেও মাটি : ভরাটের অভিযোগে ২০১৪ সালে পুকুর মালিকদের নোটিস দিয়েছিল সিটি করপোরেশন। কিন্তু ভরাট বন্ধ হয়নি। ২০১৯ সালে ব্যক্তিমালিকানাধীন ২২টি পুকুর অধিগ্রহণ করে সংরক্ষণের মেগা পরিকল্পনা নেয় সিটি কর্তৃপক্ষ। পুকুরগুলো পার্কের মতো করে গড়ে তোলা হবে। ওই প্রকল্পের সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছিল ৭৯৫ কোটি টাকা। কিন্তু পরিকল্পনা কাগজে-কলমেই থেকে গেছে।

রাজশাহী পরিবেশ অধিদফতরের উপপরিচালক মাহমুদা পারভীন জানান, পুকুর ভরাটের অভিযোগ পেলে তারা সরেজমিনে তদন্ত করে শুনানিতে অংশ নেন। অভিযোগ প্রমাণিত হলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়।

উল্টো চিত্র শহরের বাইরে : শহরে পুকুর ভরাট হচ্ছে, উল্টো চিত্র রাজশাহীর উপজেলাগুলোয়। মাছ চাষের ‘সফলতার’ গল্প শুনিয়ে গ্রামে অবাধে চলছে পুকুর খনন। ক্ষমতাবান থেকে শুরু করে মাছ চাষিদের অনেকেই পুকুর কেটেছেন। এক যুগে মোহনপুর, দুর্গাপুর, বাগমারা ও পুঠিয়া উপজেলার অন্তত ৫ হাজার হেক্টর জমিতে পুকুর কাটা হয়েছে। পুঠিয়ার শিলমাড়িয়া ইউনিয়নের শক্তিপাড়া বিলে ৭০ শতাংশ জমি ছিল রাজশাহী মহানগরী কমিউনিস্ট পার্টির সহসম্পাদক অজিত কুমার ম-লের। ওই বিলে আগেই পাঁচটি পুকুর কাটা হয়। আশপাশে পুকুর হওয়ায় নিজের জমিতেও তিনি পুকুর কেটেছেন।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর