সত্তর দশকের শেষ দিকে রাঙামাটি জেলাকে পর্যটন এলাকা হিসেবে ঘোষণা করে সরকার। তিন পার্বত্য জেলার মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী ও বৈচিত্র্যে ভরপুর রাঙামাটি। এশিয়ার বৃহত্তম কৃত্রিম লেক, দেশের একমাত্র জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র, বেতবুনিয়া উপগ্রহ ভূ-কেন্দ্র ও কর্ণফুলী পেপার মিল এই জেলায় অবস্থিত। এ অঞ্চলে হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান ধর্মের ১১ ভাষাভাষির ১৪টি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর বসবাস। প্রতিটি জনগোষ্ঠীর রয়েছে নিজস্ব আচার-অনুষ্ঠান, কৃষ্টি ও সংস্কৃতি। এ অঞ্চলের উন্নয়ন ও বিভিন্ন সম্ভাবনা নিয়ে বিশিষ্টজনদের সঙ্গে কথা বলেছেন বাংলাদেশ প্রতিদিন রাঙামাটি প্রতিনিধি ফাতেমা জান্নাত মুমু—
শিগগিরই মডেল পর্যটন জোনে পরিণত হবে
—নব বিক্রম কিশোর ত্রিপুরা
শিগগিরই পার্বত্যাঞ্চল মডেল পর্যটন জোনে পরিণত হবে। অপার সম্ভাবনাময় এ অঞ্চলের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি সৌন্দর্য্যের দিকে পর্যটক আকৃষ্ট করতে ইতোমধ্যে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে মন্ত্রণালয়। এ বিষয়ে বিভিন্ন পরিকল্পনাও গ্রহণ করা হয়েছে। খুব দ্রুত তা বাস্তবায়ন করা হবে। বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রাম পর্যটন সেক্টরগুলোতে নতুন পরিকল্পনা যোগ করা হচ্ছে। নতুন নতুন জায়গায় গড়ে তোলা হবে পর্যটন স্পট। তাছাড়া পার্বত্যাঞ্চলের পর্যটন সেক্টরকে মাস্টারপ্লানের মাধ্যমে উন্নয়ন করা হবে বলে জানিয়েছেন পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব নব বিক্রম কিশোর ত্রিপুরা, এনডিসি।
তিনি বলেন, এ অঞ্চলের বিপুল সম্ভাবনা থাকলেও পর্যটন শিল্প কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি অর্জন করতে পারেনি। পর্যটন সম্ভাবনাকে পরিকল্পিতভাবে কাজে লাগানো গেলে পার্বত্যাঞ্চলের মানুষের জন্য বিপুল কর্মসংস্থানের সুযোগ যেমন বাড়বে, তেমনি আর্থ-সামাজিক অবস্থারও উন্নয়ন ঘটবে। রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের মাধ্যমে পর্যটন উন্নয়নে এখানে যেসব সমস্যা রয়েছে তা চিহ্নিত করা হচ্ছে। এসব সমস্যা থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে গ্রহণ করা হয়েছে ভবিষ্যত পরিকল্পনা।
পুনরুদ্ধার করতে হবে কাপ্তাই হ্রদের অস্তিত্ব
—মাইনুল ইসলাম (সি) বিএন
১৯৬০ সালে খরস্রোতা কর্ণফুলী নদীর উপর বাঁধ নির্মাণের পর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সর্ববৃহৎ কৃত্রিম জলরাশি কাপ্তাই হ্রদ সৃষ্টি হয়। যার আয়তন ৭২৫ বর্গকিলোমিটার। দীর্ঘ ৫৬ বছরে একবারও ড্রেজিং না করায় হারিয়ে যাচ্ছে এর নাব্যতা। একটা সময় কাপ্তাই হ্রদকে বলা হতো মত্স্য উৎপাদন ভাণ্ডার। কিন্তু লেকের গভীরতা হ্রাস, পানি ও পরিবেশ দূষণের কারণে মাছের প্রাকৃতিক প্রজনন হুমকির মুখে পড়েছে। বিভিন্ন প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হয়ে গেছে হ্রদ থেকে। তাই ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে কাপ্তাই হ্রদের অস্তিত্ব পুনরুদ্ধার করতে হবে বলে মনে করন বাংলাদেশ মত্স্য উন্নয়ন করপোরেশন ব্যবস্থাপক ও প্রজেক্ট ডিরেক্টর কমান্ডার মাইনুল ইসলাম (সি) বিএন। এ কর্মকর্তা জানান, পাহাড়ি ঢলে পলি জমে হ্রদ ভরাট হয়ে শুষ্ক মৌসুমে অসংখ্য চর জেগে ওঠে। এ সময় হ্রদ এলাকায় নদীপথে যান চলাচল, মাল পরিবহন, মত্স্য প্রজনন সর্বোপরি বিদ্যুৎ উৎপাদনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংকট দেখা দেয়। ড্রেজিং করা হলে এ সমস্যা সমাধান সম্ভব। হ্রদে সাতটি পয়েন্টে ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের কথা বলা হলেও কার্যকর উদ্যোগ দেখা যায়নি।
সংরক্ষণের অভাবে কৃষিভিত্তিক অর্থনৈতিক সম্ভাবনা বিঘ্নিত
—গৌতম দেওয়ান
১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের পর এ অঞ্চলে কৃষিভিত্তিক বিপ্লব হলেও সংরক্ষণের অভাবে অর্থনৈতিক সম্ভাবনা বিঘ্নিত হচ্ছে। পরিবহন সুবিধা ও সুষ্ঠুভাবে বাজারে সরবারহ ব্যবস্থা না থাকায় এবং প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সংরক্ষণের অভাবে পার্বত্যাঞ্চলে প্রতিবছর কাঁঠাল, আনারসসহ বিভিন্ন জাতের কোটি কোটি টাকার ফল নষ্ট হচ্ছে। পাহাড়ে প্রচুর আনারস, লিচু, আম, তরমুজ, কাঁঠাল উৎপাদন হয়। কিন্তু পার্বত্য তিন জেলায় কোনো হিমাগার ও জুস প্লান্ট না থাকায় এসব ফল সংরক্ষণ করা যাচ্ছে না। পার্বত্যাঞ্চলের সম্ভাবনাময় কৃষি খাতকে উন্নয়নশীল করতে পার্বত্য জেলাগুলোয় সরকারি উদ্যোগে কোল্ডস্টোরেজ স্থাপন খুবই জরুরি। এমনটাই মনে করেন সাবেক স্থানীয় সরকার পরিষদের চেয়ারম্যান ও আদিবাসী ফোরামের আহ্বায়ক গৌতম দেওয়ান। তার মতে, সংরক্ষণ ও দ্রুত বাজারে সরবরাহের ক্ষেত্রে নানা সমস্যার কারণে উৎপাদিত ফল বেশির ভাগই নষ্ট হয়ে যাওয়ায় কৃষকরা চাষাবাদে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। বহুকষ্টে উৎপাদিত ফল পানির দরে বিক্রি করতে হয়। এ কারণে বিঘ্নিত হচ্ছে পার্বত্যাঞ্চলের কৃষিভিত্তিক অর্থনৈতিক সম্ভাবনা।
হস্তশিল্প অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হতে পারে
—জেলা প্রশাসক সামসুল আরেফিন
রাঙামাটিতে বস্ত্রশিল্পের পর বাঁশ ও বেতের কাজ অন্যতম হস্তশিল্প। একটা সময় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীরা তাঁত দিয়ে পরিবারের লোকজনের চাহিদা মেটানোর পিনন, খাদি, চাঁদর, ধুতি, গামছা, বর্গী, মাথায় পরার খবং তৈরি করতেন। বর্তমানে জীবিকার তাগিদে তাদের কোমর তাঁতের এসব পণ্য বিপণন হচ্ছে। শুধু কাপড় নয়, তারা বাঁশ, বেত, পাঠ ও চট দিয়ে তৈরি করছেন ব্যবহারিক সামগ্রী ঝুড়ি, স্কুলব্যাগ, হুক্কা, ডুলা, ফুলের ঝুড়ি, পানবাটা ইত্যাদি। পরিকল্পনার অভাবে এ হস্তশিল্পের সম্ভাবনাকে সঠিক অর্থে কাজে লাগানো হচ্ছে না। কিন্তু ক্ষদ্র নৃ-গোষ্ঠীর তৈরি বিভিন্ন হস্তশিল্প অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হতে পারে বলে মনে করছেন রাঙামাটি জেলা প্রশাসক সামসুল আরেফিন। জেলা প্রসাশক বলেন, ঢাকা-চট্টগ্রামের সাধরাণ কল-কারখানায় তৈরি অন্যান্য ব্যাগের তুলনায় রাঙামাটিতে স্থানীয়দের তৈরি স্কুলব্যাগ অনেক উন্নত। এ বিষয়টি অনেকেই অবগত নন। এর প্রচার ও প্রসার বৃদ্ধি করা গেলে স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে এ অঞ্চলের তৈরি ব্যাগ বাণিজ্যকভাবে রপ্তানি হতে পারে। এর মাধ্যমে যেমন পাহাড়ের বৈচিত্র্য ফুঠে উঠবে, অন্যদিকে অর্থনৈতিকভাবে এ অঞ্চলের নারীদের আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।