শনিবার, ১২ মার্চ, ২০১৬ ০০:০০ টা

লালমনিরহাট হতে পারে সমৃদ্ধ জনপদ

তিস্তা, ধরলা, সানিয়াজান নদ-নদী বেষ্টিত উত্তরের অবহেলিত সীমান্ত জেলা লালমনিরহাট। জেলা প্রতিষ্ঠার পর এখানে এখনো গড়ে ওঠেনি শিল্প কারখানা, কৃষিবান্ধব অর্থনীতি ও দক্ষ জনবল। বিমানবন্দর থাকলেও বিমান ওড়ে না চার দশক ধরে। বিসিক, স্থলবন্দরসহ ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যাপক সম্ভাবনা থাকলেও এর জন্য উদ্যোগের অভাব রয়েছে। দেশের তৃতীয় বৃহত্তম স্থলবন্দর বুড়িমারীও চলছে সুষ্ঠু পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। সুষ্ঠু পরিকল্পনা থাকলে রংপুরের পরই লালমনিরহাট হয়ে উঠতে পারে দেশের সমৃদ্ধ জনপদ। এ অঞ্চলের নানা সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে জেলার বিশিষ্টজনদের সঙ্গে কথা বলেছেন জেলা প্রতিনিধি রেজাউল করিম মানিক—

 

অবকাঠামোগত উন্নয়ন জরুরি

—মোকছেদুর রহমান

স্বাধীনতার ৪৫ বছর পরও এ জেলার মানুষ উন্নয়নবঞ্চিত এবং রাষ্ট্রীয় বৈষম্যের শিকার। নেই অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও শিল্পের বিকাশ।

লালমনিরহাট-বুড়িমারী সড়কটি চার লেনে উন্নীত, বুড়িমারী-ঢাকা রেললাইন ডাবল এবং লালমনিরহাট-কলকাতা-শিলিগুড়ি রেলপথে ট্রেন চলাচল চালু করতে হবে; যাতে উপ-আঞ্চলিক জোটভুক্ত নেপাল, ভুটান, ভারত ও বাংলাদেশের পণ্য সরবরাহ এবং মানুষ চলাচলে সুবিধা হয়। প্রাণ ফিরে আসে বুড়িমারী স্থলবন্দরে। লালমনিরহাট চেম্বার অব কমার্সের সাবেক পরিচালক ও জেলা সম্মিলিত ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি বিশিষ্ট শিল্পপতি মোকছেদুর রহমান বলেন, ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের কারণে বন্ধ হওয়া মোগলহাট স্থল শুল্ক স্টেশন চালু করা প্রয়োজন। স্বাধীনতার পর থেকে পড়ে থাকা বিমানবন্দরটি চালু করে নেপাল, ভুটান, ভারত ও বাংলাদেশের সঙ্গে ত্রিদেশীয় জোন গড়ে তোলা সম্ভব। লালমনিরহাটে গ্যাস সরবরাহের জন্য পাইপলাইন বসানোর দাবি দীর্ঘদিনের। একটি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ও মেয়েদের ক্যাডেট কলেজ প্রতিষ্ঠা জরুরি। অঞ্চলগত অর্থনৈতিক বৈষম্য নিরসন ও বিদেশে কর্মসংস্থানে জেলা কোটা প্রবর্তন করতে হবে। সীমান্ত সড়কগুলোও চলাচলের অনুপযোগী। অর্থনৈতিক জোন করলে বদলে যেতে পারে এ জেলা। বিসিক শিল্পনগরীতে উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি।

 

মানসম্পন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে

—প্রফেসর বাসাররফ হোসাইন

লালমনিরহাটের প্রবীণ শিক্ষাবিদ, সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ প্রফেসর মো. বাসাররফ হোসাইন মনে করেন শিক্ষা ক্ষেত্রে উত্তরের এ জেলাটি অনেক পিছিয়ে। গড়ে ওঠেনি বৃহৎ কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। একমাত্র রংপুর ছাড়া এ অঞ্চলের কোনো জেলাতেই বিশ্ববিদ্যালয় নেই। শিক্ষার মান বিকাশে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা অনস্বীকার্য। সমাজ গঠনে বিশ্ববিদ্যালয়ের যে ভূমিকা তা নেই এখানে। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে দেশ-বিদেশের শিক্ষার্থীরাও পড়তে আসে। তার প্রভাবে এলাকায় নানামাত্রিক প্রসার ঘটে। জেলায় রয়েছে মাত্র তিনটি সরকারি কলেজ। লালমনিরহাট সরকারি কলেজে ১০ বিষয়ে স্নাতক ও ৫ বিষয়ে স্নাতকোত্তর, পাটগ্রাম সরকারি কলেজে শুধু এইচএসসি আর মজিদা খাতুন মহিলা কলেজে রয়েছে এইচএসসি কোর্স। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের সময় এর বেশির ভাগ অংশ চলে যায় ভারতে। সে সময় এখানে যারা শিক্ষিত সম্প্রদায়, পৃষ্ঠপোষক, জ্ঞানী-গুণী ও ধনাঢ্য ছিলেন তারা অনেকেই ভারতে চলে যান। তখন এ সীমান্ত এলাকায় শিক্ষিত লোকের শূন্যতা সৃষ্টি হয়। আবার অর্থনৈতিক দুর্বলতাও এ জেলার শিক্ষাকে পিছিয়ে রেখেছে। অন্যদিকে লালমনিরহাটে নতুন নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন অব্যাহত থাকলেও শিক্ষার গুণগতমান বাড়েনি। শিক্ষক নিয়োগে ডোনেশন প্রথা এ জেলায় শিক্ষার গুণগতমান বজায় রাখার প্রধান সমস্যা। সম্মিলত প্রচেষ্টায় শিক্ষার মান বাড়ানো সম্ভব।

 

কৃষিপণ্যনির্ভর কারখানা গড়ে তুলতে হবে

—মিজানুর রহমান মিজু

গর্ব করার মতো ইতিহাস-ঐতিহ্য লালমনির হাটের। কৃষিপ্রধান এ জেলায় এখন পর্যন্ত কোনো শিল্প কারখানা গড়ে ওঠেনি। শিল্প বলতে রয়েছে পোলট্রি ক্লাস্টার ও ফিশ ফিড মিল, অটো রাইস মিল, কোল্ড স্টোরেজ ও মিল চাতাল। যদিও এখানে শিল্পের অপার সম্ভাবনা রয়েছে। অ্যাগ্রোবেজ শিল্প পার্ক তৈরি করা গেলে এ জেলায় উৎপাদিত ফুলকপি, বাঁধাকপি, কচুর লতি, টমেটো, সবজি, আলুসহ অন্যান্য কৃষিপণ্যের যথাযথ ব্যবহার সম্ভব হবে। এমনটাই মনে করেন লালমনিরহাট প্রেসক্লাবের সভাপতি প্রবীণ সাংবাদিক মিজানুর রহমান মিজু। তিনি আরও বলেন, কপি, আলু, পটোলসহ বিভিন্ন সবজি সারা বছর উত্পন্ন হয় কিন্তু কোনো বাজার নেই। এগুলোকে প্রিজারভেটিভ করারও কোনো সুব্যবস্থা নেই। তাই কৃষক সঠিক মূল্য পাচ্ছে না। এখানে কৃষিপণ্যনির্ভর কল কারখানা গড়ে তুলতে হবে। শুধু কারখানা গড়ে তুললে হবে না, সেগুলো বাজারজাতের পন্থা বের করতে হবে। এর জন্য ব্যাংকগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। এ ছাড়া বাঁধ দিয়ে ভারত পানিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত করায় ১৪টি নদ-নদী এখন অস্তিত্ব সংকটে। মানচিত্র থেকে প্রায় হারিয়ে গেছে তিস্তা, ধরলা, সানিয়াজানসহ বেশ কটি নদ-নদী। সবচেয়ে বেশি বেকায়দায় রয়েছেন তিস্তা ব্যারাজের সুবিধাভোগী কৃষক। এ ব্যাপারে সরকার অগ্রণী ভূমিকা পালন না করলে জেলাটি মরুভূমিতে পরিণত হবে।

 

রাজনৈতিক নেতৃত্বের পদক্ষেপ জরুরি

—ফেরদৌসী বেগম বিউটি

সংকুচিত রাস্তাঘাট, জলাবদ্ধতা, ড্রেনেজ সমস্যা, যানজট, উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থার অনুপস্থিতি, উচ্চশিক্ষা ও কর্মসংস্থানের অভাব লালমনিরহাটের জীবনযাত্রার মান নিম্নমুখী করে রেখেছে। লালমনিরহাটের উন্নয়নকর্মী ও সাহিত্যিক ফেরদৌসী বেগম বিউটি এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, তিস্তা সেতু হওয়ার পরও প্রশাসনিক এবং মামলা-মোকদ্দমার দরকার ছাড়া চার উপজেলার মানুষ লালমনিরহাট শহরে কমই আসতে চান। ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা, চিকিৎসা, কেনাকাটার জন্য তারা রংপুরে যাতায়াত করেন। তা ছাড়া দেশের অন্যান্য জেলার মতো প্রত্যক্ষ উন্নয়নের ছোঁয়া পায়নি লালমনিরহাট। যদিও এ জেলায় রয়েছে দেশের তৃতীয় বৃহৎ বুড়িমারী স্থলবন্দর, তিস্তা ব্যারাজ, তিনবিঘা করিডর, রেলওয়ে জংশন, বেশ কিছু জমিদারবাড়ি। গানে, গল্পে, আড্ডায় এ এলাকার মানুষের জীবনযাপন ছিল সমৃদ্ধ। প্রতি বছর বিশেষ দিনগুলো কেন্দ্র করে এ অঞ্চলে রচিত হতো পালা, জারি, সারি, ভাওয়াইয়া গান। এ জেলায় মাধ্যমিক পর্যায়ে আরও কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রয়োজন। আর বিত্তশালীরা সহযোগিতা না করলে সাংস্কৃতিক চর্চা টিকিয়ে রাখা যাবে না। সুন্দর ও সত্যের চর্চা অব্যাহত না রাখলে সমাজে অসুন্দর ও অসত্যের আধিপত্য বেড়ে যাবে। এ জন্য রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত বড় ভূমিকা রাখতে পারে।

সর্বশেষ খবর