মঙ্গলবার, ২৯ মার্চ, ২০১৬ ০০:০০ টা

কিশোরগঞ্জে প্রয়োজন কৃষিভিত্তিক শিল্প

হাওর ও উজান— এ দুই বৈশিষ্ট্য নিয়ে গঠিত কিশোরগঞ্জ। ১৯৮৪ সালে মহকুমা থেকে আত্মপ্রকাশ করে জেলা হিসেবে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে ভাষা আন্দোলন ও মহান মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে এ জেলার। বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেন কিশোরগঞ্জের সূর্যসন্তান সৈয়দ নজরুল ইসলাম। খাদ্য উদ্বৃত্ত জেলা হিসেবে কিশোরগঞ্জ দেশের অর্থনীতিতে বিশেষ অবদান রেখে চলেছে। কিশোরগঞ্জ নিয়ে বিশিষ্টজনদের ভবিষ্যৎ ভাবনা তুলে ধরেছেন জেলা প্রতিনিধি সাইফউদ্দীন আহমেদ লেনিন—

 

আগামী দিনের খাদ্য ভাণ্ডার হাওর

—ড. নিয়াজ পাশা

কৃষি গবেষক ড. নিয়াজ পাশা জানান, প্রাকৃতিক সম্পদ ও জীববৈচিত্র্যে ভরপুর কিশোরগঞ্জের হাওরাঞ্চল। কিন্তু এ অঞ্চল নিয়ে তেমন কোনো কাজ হয়নি। যদিও হাওর এলাকা ঘিরে কাজের সুযোগ রয়েছে অনেক। নিয়াজ পাশা বলেন, হাওরাঞ্চলের পতিত জমিতে দুই বা তিনটি ফসল আবাদের জন্য শস্য-জাত নির্বাচন, প্রশিক্ষণ ও পর্যাপ্ত প্রদর্শনী প্লট স্থাপনের ব্যবস্থা নিতে হবে। জলজ, কৃষি বা উন্মুক্ত এবং বদ্ধ জলাশয়ে করতে হবে মাছ চাষ। কৃষিকে সমান্তরালের সঙ্গে ঊর্ধ্বমুখী ও বহুস্তরে সাজাতে হবে। বহুমুখী ব্যবহারের জন্য উঁচু ভিটা তৈরি, কাটা ধান আনা-নেওয়ার জন্য হালকা কিন্তু টেকসই পরিবহন এবং বাজার ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে হবে। দাদনের ছোবল থেকে কৃষককে রক্ষায় ‘হাওর উন্নয়ন ব্যাংক’ করা যেতে পারে। হাওরাঞ্চলে ‘বীজ উত্পাদন এবং প্রক্রিয়াজাতকরণ’, কৃষি ও মৎস্য গবেষণা কেন্দ্র স্থাপন অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। কৃষিকর্মীদের জন্য দরকার স্থায়ী অফিস, প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও হাওরভাতা চালু করা। হাওর কৃষিকে মানুষের রোজগার আর কর্মক্ষেত্র-সম্ভাবনার স্বর্ণদ্বারে রূপান্তরে ব্যাপক উদ্যোগ, প্রকল্প, বাজেট-পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। তা হবে আমাদের দুর্দিনে খাদ্যপ্রাপ্তির নিশ্চয়তা। নিরাপত্তার উৎসভূমি হবে হাওরাঞ্চল।

 

দরকার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়

—শরীফ সাদী

বাঙালি জাতিসত্তা বিনির্মাণে সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক দিক থেকে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছে কিশোরগঞ্জ জেলা। কিশোরগঞ্জ পৌর মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ শিক্ষানুরাগী শরীফ সাদী বলেন, স্বাধীনতার পর যুদ্ধবিধ্বস্ত কিশোরগঞ্জে শুরু হয় পুনর্বাসন কাজ। ভৈরব রেলসেতু নির্মাণ ও কিশোরগঞ্জ টেক্সটাইল মিল স্থাপিত হয়। পঁচাত্তরের বিয়োগান্ত ঘটনার কারণে থমকে যায় জেলার উন্নয়নের গতি। দুই যুগ উন্নয়নবঞ্চিত থেকে আবারও যাত্রা শুরু হয় সৈয়দ নজরুল ইসলামের জ্যেষ্ঠপুত্র সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের নেতৃত্বে। দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। নির্মিত হয়েছে অসংখ্য পাকা রাস্তা, ব্রিজ-কালভার্ট। যোগাযোগব্যবস্থার অভাবনীয় উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। এই শিক্ষাবিদ জানান, নরসুন্দা নদী খনন, ওয়াকওয়ে নির্মাণ, নদীতীরে পার্ক নির্মাণ, সবুজায়ন, ওয়াচ টাওয়ার, মুক্তমঞ্চ, দৃষ্টিনন্দন ব্রিজ, ফুটব্রিজ নির্মাণকাজ চলমান আছে। শিক্ষা বিকাশের জন্য বহু প্রতিষ্ঠানে নির্মিত হয়েছে একাডেমিক ভবন ও ছাত্রাবাস। ফিশারিজ ও টেক্সটাইল ডিপ্লোমা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। নতুন প্রজন্মের দাবি কিশোরগঞ্জে গড়ে তোলা হোক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়।

 

সাহিত্য-সংস্কৃতি বিকাশে প্রয়োজন পৃষ্ঠপোষকতা

—জাহাঙ্গীর আলম জাহান

মধ্যযুগের কীর্তিমান ভাসান গায়ক দ্বিজবংশী দাসের সুমিষ্ট কণ্ঠমাধুর্যে বিমোহিত হয়েছে এ অঞ্চলের মানুষ। বাংলা সাহিত্যের প্রথম মহিলা কবি চন্দ্রাবতীর রচনাসম্ভার সমকালীন সমাজকে যেমন আপ্লুত করেছে, তেমন আজও তার রচিত রামায়ণ সনাতনধর্মাবলম্বী থেকে শুরু করে সবাইকে আচ্ছন্ন রাখে অসাধারণ ভালোলাগার আবেশে। শিল্প-সংস্কৃতির সেই অপার সম্ভাবনাময় জেলায় আজ আর সেই চর্চা খুঁজে পাওয়া যায় না। সর্বত্রই বিরাজ করছে স্থবিরতা। এ অবস্থা কাটিয়ে ওঠার জন্য প্রশাসনিক উদ্যোগের বিকল্প নেই— এমনটাই জানালেন কিশোরগঞ্জ ছড়াকার সংসদের সভাপতি ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব জাহাঙ্গীর আলম জাহান। তিনি বলেন, সংস্কৃতির পাশাপাশি মননশীল সাহিত্যের ক্ষেত্রেও এ জেলার রয়েছে গর্ব করার মতো বহু ইতিহাস। গত শতকের ত্রিশের দশকের প্রথমার্ধে পাকুন্দিয়ায় অনুষ্ঠিত হয়েছিল পল্লীসাহিত্য সম্মেলন। তারই ধারাবাহিকতায় যুগে যুগে এ জনপদে অনেকবার সাহিত্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার উদাহরণ রয়েছে। এক যুগ ধরে জেলা শহরে ঘটা করে উদ্যাপিত হচ্ছে বার্ষিক ছড়া সম্মেলন ও ছড়া উৎসব। এ জেলায় সাহিত্য-সংস্কৃতির যে পৃষ্ঠপোষকতা থাকা দরকার ছিল তা অনেকাংশেই অনুপস্থিত।

 

কৃষিভিত্তিক শিল্প-কারখানা গড়ে তুলতে হবে

—বাদল রহমান

বর্তমান সরকার পাটের সোনালি দিন ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিয়েছে। তাই কৃষিভিত্তিক এ অঞ্চলে পাটকে কেন্দ্র করে শিল্প গড়ে উঠতে পারে। কিশোরগঞ্জে স্থায়ী কোনো কাজের ব্যবস্থা নেই। হাওরাঞ্চলে বছরে চার-পাঁচ মাস কাজ থাকে। বাকি সময়টা অলস কাটাতে হয় বেশির ভাগ মানুষকে। ফলে যুবসমাজ বিপথগামী হচ্ছে। কথাগুলো বললেন কিশোরগঞ্জ চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি বাদল রহমান। তিনি বলেন, ‘অফুরন্ত সম্ভাবনার হাওরকে আমরা সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারিনি। এখানকার কৃষি ও মত্স্য সম্পদকে কেন্দ্র করে শিল্প কারখানা গড়ে তোলা যায়। এখানে সরকারি একটি টেক্সটাইল মিল ও চিনিকল ব্যক্তিমালিকানায় ছেড়ে দেওয়ার পর থেকে বন্ধ রয়েছে। চিনিকলটিতে সিরামিক কারখানা ও গার্মেন্ট পল্লী করার ঘোষণা দিয়েছিলেন এর মালিক। কিন্তু তা বাস্তবায়নের কোনো লক্ষণ নেই। বন্ধ হয়ে যাওয়া টেক্সটাইল মিলকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠতে পারে শিল্পপার্ক। আমাদের বিসিক শিল্পনগরীতে এখনো গ্যাস সংযোগ মেলেনি। ফলে অনেক উদ্যোক্তা থাকলেও সম্ভাবনাটা কাজে লাগানো যাচ্ছে না।’ তিনি মনে করেন, এখানে সুষ্ঠু বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পরিবেশবান্ধব জৈব সার কারখানা গড়ে তোলা সম্ভব। এতে কৃষি আবারও চাঙা হবে, উপকৃত হবেন কৃষক।

সর্বশেষ খবর