রবিবার, ১০ এপ্রিল, ২০১৬ ০০:০০ টা

আকাশছোঁয়া স্বপ্নভরা মুন্সীগঞ্জ

পদ্মা, মেঘনা, ধলেশ্বরী ও শীতলক্ষ্যাবিধৌত প্রাচীন সভ্যতার জনপদ বিক্রমপুর তথা মুন্সীগঞ্জ অপার সম্ভাবনার একটি জেলা। এ জেলা ঘিরে সরকারি-বেসরকারিভাবে শুরু হয়েছে নানা উন্নয়ন কর্মকাণ্ড। পদ্মা বহুমুখী সেতু, গজারিয়ায় দেশের সর্ববৃহৎ গার্মেন্ট শিল্পাঞ্চল ‘বাউশিয়া গার্মেন্ট পল্লী’, সবচেয়ে বড় ওষুধ শিল্পের জন্য এপিআই শিল্প পার্কের মতো মেগা প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে স্বপ্নের জেলা হবে মুন্সীগঞ্জ। ইতিমধ্যে দেশি-বিদেশি উদ্যোক্তারা বিনিয়োগের স্থান নির্বাচনে নেমে পড়েছেন। মুন্সীগঞ্জের সম্ভাবনা আর সমস্যা নিয়ে বিশিষ্টজনদের সঙ্গে কথা বলেছেন জেলা প্রতিনিধি লাবলু মোল্লা—

 

প্রবাসে চাকরি ব্যবসায় এসেছে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি

—সুখেন চন্দ্র ব্যানার্জি

সরকারি হরগঙ্গা কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ প্রফেসর সুখেন চন্দ্র ব্যানার্জী বলেন, এক সময়ে সমতটের রাজধানী বিক্রমপুর। এটা ছিল বাঙালি সভ্যতার অন্যতম প্রাণকেন্দ্র । এই মাটিতে সম্মিলন ঘটেছে হিন্দু, বৌদ্ধ, ইসলাম, খৃস্টানসহ নানা ধর্ম ও সম্প্রদায়ের মানুষের। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে জেলার অগ্রগতি ধীরগতিতে চললেও বর্তমান সরকারের আমলে উন্নয়নের নতুন মাত্রা পেয়েছে। মাওয়ায় তৈরি হচ্ছে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা বহুমুখী সেতু। এ সেতুকে কেন্দ্র করে নানামুখী উন্নয়নের জোয়ার বইছে মুন্সীগঞ্জে। সিরাজদিখানে তৈরি হচ্ছে দেশের প্রথম মুদ্রণ শিল্প নগরী। মেরিন একাডেমি গড়ে উঠছে টঙ্গিবাড়ী উপজেলায়। জেলার প্রতিটি গ্রামের বিপুল সংখ্যক মানুষ প্রবাসে চাকরি ও ব্যবসা করার ফলে এসেছে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি। এ শিক্ষাবিদের ভাষ্য, এত কিছুর পরও একটি জায়গায় কষ্ট থেকেই যায়। যে বিক্রমপুর তথা মুন্সীগঞ্জ এক সময় জ্ঞান-গরিমা, শিক্ষা-দীক্ষায় জগত বিখ্যাত ছিল আজ তা ম্রিয়মান। জেলার হারানো গৌরব ফিরে পেতে প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন বিশেষায়িত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজসহ মানসম্পন্ন স্কুল-কলেজ। মুন্সীগঞ্জে বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় করতে প্রয়োজন যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রভূত উন্নয়ন। এ জন্য মেঘনা নদীতে ফেরি সার্ভিস ও ফুলদি নদীর উপর সেতু নির্মাণ অতি জরুরি।

 

লৌহজংয়ে হতে পারে অলিম্পিক স্টেডিয়াম

—সাগুফতা ইয়াসমীন এমিলি

বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপিকা সাগুফতা ইয়াসমীন এমিলি এমপি জানান, অতীত ঐতিহ্যমণ্ডিত মুন্সীগঞ্জ আবারও তার ঐতিহ্য ফিরে পেতে শুরু করেছে। এ অঞ্চলের মানুষ ত্যাগ-তিতিক্ষায় মহিমান্বিত। মুন্সীগঞ্জ-বাসী তাদের বাপদাদার ভিটাবাড়ি ছেড়ে দিয়ে বহুল প্রত্যাশিত এবং জাতির জনকের স্বপ্নের পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নে সহোযোগিতা করেছে। এ জন্য তারা প্রশংসার দাবিদার। এ সেতু প্রকল্পের পাশেই লৌহজংয়ে জেগে ওঠেছে বিশাল চর। এ চরটিতে অলিম্পিক স্টেডিয়াম করা হলে সেখানেও এলাকার মানুষ দেশের স্বার্থে আবার জমি দিতে প্রস্তুত আছে। এমিলি বলেন, অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি এ অঞ্চলের মানুষের শিক্ষার মানোন্নয়নে এখানে বিশ্বমানের একটি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে ওঠা জরুরি। তবে এখানকার মানুষ এখনো নদীভাঙন আতঙ্কে ভুগছে। পদ্মার করাল গ্রাস থেকে আজও এদের রক্ষা মেলেনি। প্রতি বছর বর্ষা শুরু হলেই পদ্মা রুদ্রমূর্তি ধারণ করে। তখন পদ্মাপাড়ের মানুষ পড়ে জীবন-মরণ সমস্যায়। কখন তাদের শেষ সম্বলটকু কেড়ে নেয় পদ্মা। নদীভাঙনে অসহায় হয়ে পড়ে অসংখ্য মানুষ। তাই জেলার শ্রীনগর, লৌহজং ও টঙ্গিবাড়ী উপজেলার পদ্মাপাড়ের গ্রামগুলো রক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। এ সমস্যার সমাধান হলেই জেলা আরও উন্নত ও সমৃদ্ধ হয়ে বাংলাদেশকে এগিয়ে যেতে সহায়তা করবে।

 

প্রয়োজন শিক্ষা-সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা

     —চৌধুরী ফাহিরয়া আফরিন

কালজয়ী নারী সাহিত্যিক সরোজনী নাইডু, সৈয়দ এমদাদ আলীর জন্মস্থান মুন্সীগঞ্জ। এখানে জন্মেছেন অবিভক্ত বাংলার প্রধান বিচারপতি চন্দ্র মাধব, গণিতের সাগর সৌমেন বসু, ইংলিশ চ্যানেল বিজয়ী ব্রোজেন দাস, চিত্র শিল্পী আব্দুল হাইয়ের মতো গুণীজন। এখন আর তাদের মতো কারোর দেখা মিলছে না— এমনটাই মন্তব্য করলেন বিশিষ্ট কণ্ঠশিল্পী ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব চৌধুরী ফাহিরয়া আফরিন। তিনি বলেন, মুন্সীগঞ্জ রাজধানীর সন্নিকটের একটি জেলা হলেও এখানে শিল্প-সংস্কৃতির তেমন বিকাশ ঘটছে না। সাংস্কৃতির অপার সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও সাংস্কৃতিক কর্মী ও শিল্পীদের যথাযথ পরিচর্যা এবং প্রশিক্ষণের তেমন কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। জেলার একমাত্র শিল্পকলা একাডেমি নানা সমস্যায় জর্জরিত। সদর থানাসংলগ্ন গণসদন নামের ভবনটির ধ্বংসাবশেষ পড়ে আছে। তার পাশে রুগ্ণ অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে কালচারাল কমপ্লেক্স ভবন। জেলা শহরে নেই বিনোদনের স্থান। শিশুদের জন্য নামমাত্র পার্ক থাকলেও, সেটিও শ্মশানভূমিতে পরিণত হয়েছে। ছিন্নমূল শিশুদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা নেই। রয়েছে সুপেয় পানি, আধুনিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অভাব। এসব সমস্যা সমাধানে এখনই পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। তা হলে সম্ভাবনার এ জেলা বাংলাদেশকে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে বিশেষ ভূমিকা রাখবে বলে মনে করেন ফাহিরয়া আফরিন।

 

কমলাঘাট বন্দরে ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে হবে

—শহিদুল ইসলাম শাহীন

মুন্সীগঞ্জের মীরকাদিম কমলাঘাট শিল্প ও বণিক সমিতির সভাপতি মো. শহিদুল ইসলাম শাহীন (মেয়র) বলেন, মীরকাদিম কমলাঘাট একটি ঐতিহ্যবাহী বন্দর। ‘দ্বিতীয় কলকাতা’ হিসেবে পরিচিত বন্দরটির মাধ্যমে সুদীর্ঘকাল হতে বন্দর সংলগ্ন ধলেশ্বরী ও ইছামতি নদীর মাধ্যমে বিভিন্ন অঞ্চলের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালিত হয়ে আসছে। অতীতে বড় বড় জাহাজ কমলাঘাট ও কলকাতা বন্দরের মধ্যে লোক ও মালামাল পরিবহন করতো। পূর্ববাংলার ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডের বৃহৎ অংশজুড়ে কমলাঘাট বন্দরের ভূমিকা ছিল। কালক্রমে বন্দর সংলগ্ন ইছামতি নদীতে পলি জমে নাব্যতা কমে যাওয়ায় বর্তমানে বন্দরটির কার্যক্রম প্রায় স্থবির। আমি শুধু জনপ্রতিনিধি হিসেবে নই, মিরকাদিম কমলাঘাট শিল্প ও বণিক সমিতির সভাপতি হিসেবেও  উপলব্ধি করি, মরকাদিম নদীবন্দর থেকে নবনির্মিত পাওয়ার প্লান্ট সংলগ্ন হয়ে কমলাঘাট বাণিজ্য বন্দর পর্যন্ত ইছামতি নদী খনন করা হলে ঢাকা এবং দক্ষিণ বঙ্গের সঙ্গে এ বন্দরের যোগাযোগ পুন:প্রতিষ্ঠিত হবে। বন্দরটি ফিরে পাবে তার অতীত ঐতিহ্য। সম্ভব হবে এলাকার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের পুনর্জাগরণ। এ ছাড়া কমলাঘাট বন্দরের প্রধান রাস্তাটি আরসিসি দ্বারা উন্নয়ন, রাস্তার পাশে ড্রেন নির্মাণ দরকার। এসব সমস্যা দূর করা হলে উন্নত বাংলাদেশ বিনির্মাণে অত্র অঞ্চল অগ্রণী ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।

সর্বশেষ খবর