মঙ্গলবার, ১২ এপ্রিল, ২০১৬ ০০:০০ টা

অর্থনীতির দ্বিতীয় লাইফলাইন বাগেরহাট

মংলা বন্দর কেন্দ্রিক শিল্পাঞ্চল, ইপিজেডসহ একাধিক অর্থনৈতিক অঞ্চল ও বিভিন্ন ট্যুরিজম স্পটের মিশেল ঘটেছে বাগেরহাট জেলায়। রয়েছে দুটি ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ সুন্দরবন ও ষাটগুম্বজ মসজিদ। সুন্দরবন উপকূলে দ্বিতীয় সেন্টমার্টিনখ্যাত বঙ্গবন্ধু আইল্যান্ড ঘিরে দেশ-বিদেশের দর্শনার্থীর আনাগোনা

চোখে পড়ার মতো। বাগেরহাটের সম্ভাবনা ও সমস্য নিয়ে বিশিষ্টজনদের সঙ্গে কথা বলেছেন জেলা প্রতিনিধি শেখ আহসানুল করিম—

 

গড়ে উঠছে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল

—শাহজাহান মিনা

বাগেরহাট চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি মো. শাহজাহান মিনা বলেন, দেশের অর্থনীতির দ্বিতীয় লাইফলাইন বাগেরহাটের মংলা সমুদ্র বন্দর। মংলা বন্দর কেন্দ্রিক শিল্পাঞ্চল ও ইপিজেডের পাশাপাশি দ্রুত গড়ে উঠছে একাধিক বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল। দেশের শীর্ষ বিনিয়োগকারী বসুন্ধরা গ্রুপের একাধিক শিল্প প্রতিষ্ঠানসহ বেসরকারি উদ্যোগে এখানে তৈরি হচ্ছে কল-কারখানা। মংলা-খুলনা, মংলা-মাওয়া ও বাগেরহাট-খুলনা মহাসড়কের পাশে জমি কেনার ধুম পড়েছে। এসব মহাসড়ককে গ্যাস পাইপলাইনের সঙ্গে সংযুক্ত করে শিল্প প্রতিষ্ঠানে সংযোগ দিতে হবে। শাহজাহান মিনার মতে, মংলা-খুলনা রেলপথ ও খানজাহান আলী বিমান বন্দর নির্মাণসহ বন্দরে আরও জেটি-ইয়ার্ড ও আধুনিক যন্ত্রপাতি দিয়ে মংলাকে রূপান্তর করতে হবে উন্নত বন্দরে। এ ব্যবসায়ী নেতা জানান, বাগেরহাট ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে এতোটাই এগিয়েছে যে বিসিক নগরীতে উদ্যোক্তারা প্লট পাচ্ছেন না। পদ্মা সেতু চালু হলে আরও চাপ বাড়বে এ অঞ্চলের ওপর। পশুর চ্যানেলে ডুবে যাওয়া ১৫টি জাহাজ সম্পূর্ণভাবে অপসারণ করতে হবে। দ্রুত মংলা-মাওয়া-ঢাকা রেলপথ নির্মাণসহ মহাসড়কটি ছয় লেনে রূপান্তর করা দরকার। রপ্তনিযোগ্য চিংড়ির অর্ধেক উৎপাদন হয় বাগেরহাটে। এ শিল্প আরও বেগবান করতে চিংড়ি চাষি ও খামারিদের কম সুদে লোনের ব্যবস্থা করতে হবে।

 

নৌ-প্রটোকলভুক্ত দুটি রুট বন্ধ করতে হবে

—শেখ ফরিদুল ইসলাম

মংলা বন্দর, ইপিজেড, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, চিংড়ি শিল্প, দুটি ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ সুন্দরবন ও ষাটগুম্বজ মসজিদ,সুন্দরবন উপকূলে দ্বিতীয় সেন্টমার্টিনখ্যাত বঙ্গবন্ধু আইল্যান্ড ঘিরে আজকের বাগেরহাটের পরিচিতি। জেলাজুড়ে সবুজ অরণ্য। প্রতিনিয়ত গড়ে উঠছে নতুন-নতুন শিল্প কারখানা। সেভ দ্যা সুন্দরবন ফাইন্ডেশনের চেয়ারম্যান ড. শেখ ফরিদুল ইসলাম এভাবেই গর্বভরে বর্ণনা করলেন নিজ এলাকার। তিনি বলেন, বাগেরহাটবাসীর প্রাপ্তি অনেক হলেও ক্ষতি হচ্ছে পরিবেশের। ঐতিহ্য এখন রক্ষা করা যাচ্ছে না। খানজাহানের মাজার শরীফের দীঘির ঘাটের লাল ইটের সিঁড়ির ঐতিহ্য নষ্ট করে সাদা টাইলস লাগানো হয়েছে। শাসকদলের নেতারা খালে বাঁধ দিয়ে চিংড়ি চাষ করায় মরে যাচ্ছে নদী। সরকার শত শত কোটি টাকা ব্যয়ে আবার সেই নদী খনন করছে। খননে উঠে আসা বালু কৃষি জমিতে ফেলায় তা সম্পূর্ণ আবাদ অযোগ্য হয়ে পড়ছে। ফরিদুল ইসলাম বলেন, সুন্দরবনের ভিতর দিয়ে দুটি নৌ-প্রটোকলভুক্ত রুট বন্ধ করতে হবে। বনের অদূরে কয়লাভিত্তিক তাপবিদুৎ কেন্দ্র  নির্মাণ হলে ধ্বংস হয়ে যাবে আমাদের গর্ব সুন্দরবন। বন্ধ করতে হবে এ প্রকল্পের কাজ। বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিকল্প আছে, সুন্দরবনের নেই। সুন্দরবন বাঁচালে সুন্দর প্রকৃতিসহ উপকূলের ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের হাত থেকে বাঁচবে তিন কোটি মানুষ।

 

পর্যটন থেকে বিপুল অর্থ আয় সম্ভব

—সরদার আনছার উদ্দিন

সুন্দরবনে ডলফিনের অভয়ারণ্য ও কটকা সীবিচ থেকে সূর্যোদয়-সূর্যাস্ত দেখার সুযোগসহ জীববৈচিত্র্যে ভরপুর ম্যানগ্রোভ এ বনের প্রায় সব পর্যটন স্পটের অবস্থান বাগেরহাটে। খান জাহানের স্থাপত্য ছাড়াও বাগেরহাটের সুন্দরবনে নদীতে বিরল প্রজাতির ইরাবতিসহ ছয় প্রজাতির ডলফিন, কুমির, রয়েল বেঙ্গল টাইগার, চিত্রল হরিণসহ ৩৭৫ প্রজাতির বন্যপ্রণী, ৩০০ প্রজাতির পাখি ও প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দার্য্য দেখতে প্রতিদিন দেশ-বিদেশের পর্যটকরা ছুটে আসেন এখানে। এসব পর্যটন স্পটগুলোর নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা, সহজ ও দ্রুত আসা-যাওয়ার ব্যবস্থা নিশ্চিতের পাশাপাশি দর্শনার্থীদের জন্য জেলা সদর, মংলা ও শরণখোলায় পর্যাপ্ত আধুনিক হোটেল-মোটেল, বার নির্মাণ করতে হবে। তবেই জেলার পর্যটন খাত থেকে বছরে ১০ হাজার কোটি বৈদেশিক মুদ্রা আয় সম্ভব বলে মনে করেন বাগেরহাট নাগরিক ফোরামের মহাসচিব সরদার আনছার উদ্দিন। এলাকার উন্নয়নসহ পদ্মা সেতু ও মংলা-মাওয়া-ঢাকা রেলপথের দাবিতে সোচ্চার সর্বজন গ্রহণযোগ্য এই নাগরিক নেতার মতে, পর্যটকবান্ধব পরিবেশের পাশাপাশি মানসম্মত হোটেল-মোটেল নির্মাণ, বাগেরহাটের জলাবদ্ধতা দূরসহ শহরে আধুনিক গার্ভেজ-ড্রেনেজ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। তাছাড়া সুপেয় পানি, সড়ক-মহাসড়ক প্রসস্তকরণও জরুরি। ঐতিহ্য রক্ষায় ফের চালু করতে হবে বাগেরহাট-রূপসা রেলপথ।

 

তৈরি করতে হবে দক্ষ মানবসম্পদ

     —শাহ্ আলম টুকু

অগ্রসর বাগেরহাটকে আরও এগিয়ে নিতে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরিতে আধুনিক ও প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষার বিকল্প নেই। এ জন্য সরকারি উদ্যোগে বাগেরহাটে কৃষি-মেস্যর মতো বিশেষায়িত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল ও ক্যাডেট কলেজ প্রতিষ্ঠাসহ মেরিন ইনস্টিটিউটকে একাডেমি ও নার্সিং ইনস্টিটিউটকে কলেজে রূপান্তর করা দরকার। আইটিপার্ক, ফরেস্ট রিসার্স একাডেমি, সাবমেরিন ক্যাবলের সাবস্টেশন, বিভিন্ন ট্রেডের কারিগরি ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠাসহ অটিস্টিক শিশুদের জন্য আধুনিক চিকিৎসা কেন্দ  তৈরি এখন সময়ের দাবি। এমনটাই জানালেন প্রবীণ সমাজকর্মী ও বাগেরহাট প্রেসক্লাবের সভাপতি অ্যাডভোকেট মো. শাহ্ আলম টুকু। তিনি বলেন, অনেক কিছুতে আমরা এগিয়ে থাকলেও সমাজের অবহেলিত অংশ পিছিয়ে রয়েছে আধুনিক ও প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষার ক্ষেত্রে। শাহ আলমের ভাষ্য, বাগেরহাটে নেই কোনো পাবলিক-প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়। এমনকি উচ্চশিক্ষা গ্রহণের বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠানও নেই। এ কারণে জেলার মধ্যবিত্ত ও দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীরা উচ্চশিক্ষায় পিছিয়ে পড়ছেন। শিক্ষা নিয়ে দেখা দিয়েছে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য। সরকারকে এই বৈষম্য দূর করতে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। পাশাপাশি জেলার দুটি সরকারি কলেজ ও সরকারি-বেসরকারি স্কুলগুলোতে অবকাঠামো উন্নয়নসহ মানসম্পন্ন প্রয়োজনীয় সংখ্যক শিক্ষক পদায়ন করতে হবে।

সর্বশেষ খবর