বিদ্যুতে আলোকিত হবে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার চরাঞ্চলের ৮ হাজার পরিবার। জেলার পদ্মা নদীর তীর থেকে নৌপথেই সময় লাগে ১ ঘণ্টারও বেশি। পদ্মার ওপাড়ে বিচ্ছিন্ন জনপদ সীমান্ত ঘেঁষা প্রত্যন্ত চরাঞ্চল চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার নারায়ণপুর ও শিবগঞ্জ উপজেলার পাকা ইউনিয়ন। কিন্তু চরাঞ্চল হওয়ার কারণে সেখানকার মানুষ এখনো জানে না বিদ্যুতের ব্যবহার। বঞ্চিত বিদ্যুতের সব সুবিধা থেকে। তবে এবার পাল্টে যাচ্ছে সেই চিত্র। সীমান্তবর্তী এলাকার প্রায় ৮ হাজার পরিবার এবার বিদুৎ সেবার আওতায় আসছে। সাবমেরিন কেবলের মাধ্যমে পদ্মা নদীর তলদেশ দিয়ে বিদুৎ সংযোগ যাবে বিচ্ছিন্ন চরাঞ্চলে। প্রথমে চরাঞ্চলে সংযোগ দেওয়ার পরপরই প্রাথমিকভাবে উজিরপুর ইউনিয়নের ১টি, দুর্লভপুরের ১টি, নারায়ণপুরের ৮টি ওয়ার্ড এবং সুন্দরপুর ও পাকা ইউনিয়নের কিছু অংশ মিলে মোট ২৮টি গ্রামের ৪০ হাজার মানুষ বিদুৎ সেবার আওতায় আসবে। ইতিমধ্যে ১০৭ কিলোমিটারের মধ্যে দীর্ঘ ৯০ কিলোমিটার বৈদ্যুতিক তারের সংযোগ সম্পন্ন করা হয়েছে। পদ্মা নদীর তলদেশ দিয়ে বৈদ্যুতিক তার পরিবহনের জন্য সাবমেরিন কেবল নদী পাড়ে নিয়ে আসা হয়েছে। সীমান্ত ঘেঁষা চরাঞ্চলে বিদ্যুৎ সেবা একটি বড় মাইলফলক হতে যাচ্ছে। বিদ্যুৎ সুবিধার ফলে এই অঞ্চলের অনুন্নত জনপদে আসবে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। অর্থনৈতিক উন্নয়ন ছাড়াও কৃষি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, চিকিৎসায় ঘটবে উন্নয়ন। সেই সঙ্গে বাড়বে সামাজিক উন্নয়ন। ইতিমধ্যেই প্রায় বাড়ির সামনে বৈদ্যুতিক পোল ও তার সংযোগ দেওয়া সম্পন্ন হয়েছে। তবে এই চরাঞ্চলে বর্তমানে সোলার প্যানেলই একমাত্র ভরসা। কিন্তু সিংহভাগ খেটে-খাওয়া অসহায় দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বসবাস হওয়ায় হাতেগোনা কিছু পরিবার ছাড়া কোথাও সোলারের ব্যবহার নেই। বাধ্য হয়েই অন্ধকারে বসবাস করতে হয় সীমান্তবর্তী এলাকার হাজারও মানুষকে। ইতিমধ্যে সদর উপজেলার ইসলামপুর ইউনিয়নের হায়াত মোড়ে সাব-স্টেশন নির্মাণের কাজ শেষ হয়েছে।
বিদ্যুৎ প্রসঙ্গে সদর উপজেলার নারায়ণপুর দারুল আলিম মাদরাসার আলিম প্রথম বর্ষের ছাত্র আব্দুল আলিম বলেন, ঝড়বৃষ্টি হলেই আমরা ক্লাস করতে পারি না। মাদরাসায় একটি কম্পিউটার আছে। দু-এক দিন রোদ না উঠলে কম্পিউটার ক্লাস করতে পারি না। গরমের সময় ক্লাস করতে গিয়ে অনেক ছাত্রছাত্রী অসুস্থ হয়ে যায়। এমনকি গরমের সময় বিরতি দিয়েও ক্লাস করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। বিদ্যুতের সংযোগ আসলে এসব সমস্যা থেকে উত্তোরণ মিলবে। বিদ্যুৎ পেলে ফ্যান, কম্পিউটার চালু থাকবে। আমাদের পড়াশোনার গতিও বাড়বে। অন্যদিকে কৃষক ইব্রাহিম আলী জানান, চরাঞ্চলে বিদ্যুৎ না থাকায় নানারকম অসুবিধার মধ্যে পড়তে হয়। এক বিঘা ধান চাষ করতে ১০-১২ হাজার টাকা খরচ হয়ে যায়। বিদ্যুৎ সুবিধা পেলে কৃষিখাতে খরচ অর্ধেকে নেমে আসবে। এছাড়া আমরা এক কেজির বেশি মাংস কিনতে পারি না। কারণ এখানে ফ্রিজের কোনো সুবিধা নাই। চরাঞ্চলের মানুষের একটি বড় সমস্যা মোবাইল চার্জ করা নিয়ে। হাতেগোনা কয়েকটা বাড়িতে সোলার আছে। তাই প্রতিদিন মোবাইল চার্জ করা নিয়ে বাড়ি বাড়ি দৌড়াতে হয়। তবে বিদ্যুৎ সংযোগ পেলে এলাকার মানুষ সভ্যতার জগৎ ফিরে পাবে। অপরদিকে শিবগঞ্জ উপজেলার চরপাঁকা মসজিদের ইমাম মাওলানা মোহাম্মদ সেতাউর রহমান বলেন, এখানে বিদ্যুৎ আসলে এই অঞ্চলের ব্যাপক উন্নয়ন ঘটবে। গরমের সময় মসজিদে মুসল্লিরা ধীরেসুস্থে নামাজ আদায় করতে পারে না। মুসল্লিদের শারীরিক অবস্থা বিবেচনায় দ্রুত নামাজ শেষ করতে হয়। কিন্তু বিদ্যুৎ আসলে ফ্যানের বাতাসে সঠিকভাবে ঠান্ডা মস্তিষ্কে নামাজ আদায় করতে পারব। স্থানীয় স্বাস্থ্যকর্মী মিমিয়ারা খাতুন বলেন, চরাঞ্চলে একদিকে যেমন গাছপালা কম। তেমনি শতভাগ বাড়িঘর টিনের তৈরি। তাই গরম অনেক বেশি। এছাড়াও রান্নার কাজে ও খাবার পানি হিসেবে নদীর পানিই একমাত্র ভরসা। কিন্তু বিদ্যুৎ সুবিধা থাকলে মর্টারের মাধ্যমে নিরাপদ পানি পান করা যাবে। ছেলেমেয়েরা সন্ধ্যার পর পড়াশোনা করতে পারবে। এ ব্যাপারে চাঁপাইনবাবগঞ্জ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির সিনিয়র জেনারেল ম্যানেজার প্রকৌশলী মো. রফিকুল ইসলাম জানান, ‘প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগ, ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ’ স্লোগান বাস্তবায়নে চাঁপাইনবাবগঞ্জের ২৮টি সীমান্তবর্তী গ্রামে প্রাথমিকভাবে ৭ হাজার ৪০০ পরিবার বিদ্যুৎ সরবরাহ পাবে। বর্তমানে অফ গ্রিডের কাজ চলমান রয়েছে। বৈদ্যুতিক লাইনের কাজ শেষ হয়েছে। সদর উপজেলার মিরের চর এলাকায় ৪০ কিলোমিটার দীর্ঘ সাবমেরিন রাখা হয়েছে। এছাড়াও পাঁকা থেকে নারায়ণপুরের জন্য আরও ২০ কিলোমিটার সাবমেরিন আসবে। বর্তমানে পদ্মা নদীতে প্রচুর স্রোত রয়েছে। ফলে স্রোত কমতে শুরু করলে খুব শিগগিরই সাবমেরিন স্থাপনের কাজ শুরু হবে। তিনি আরও বলেন, প্রকল্পটির মেয়াদ ধরা হয়েছিল চলতি বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত। কিন্তু পদ্মায় অতিরিক্ত পানি প্রবাহ ও স্রোত থাকায় প্রকল্পের মেয়াদ বাড়াতে হয়েছে। এদিকে স্থানীয় সংসদ সদস্য ডা. শামিল উদ্দিন আহমেদ শিমুল বলেন, বাংলাদেশের কোনো প্রত্যন্ত এলাকা বিদ্যুৎবিহীন থাকবে না। প্রধানমন্ত্রীর এমন উদ্যোগের ফলে চরাঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রা পাল্টে যাবে।