রবিবার, ৯ এপ্রিল, ২০২৩ ০০:০০ টা

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পাদুকা শিল্পে মন্দা

কয়েক বছর ধরে ধস

মোশাররফ হোসেন বেলাল, ব্রাহ্মণবাড়িয়া

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পাদুকা শিল্পে মন্দা

পবিত্র ঈদুল ফিতরকে সামনে রেখে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পাদুকা শিল্পের জৌলুসে ভাটা পড়েছে। অন্যান্য বছর বৃহৎ এ উৎসবকে সামনে রেখে জেলার পাদুকা পল্লীতে চরম ব্যস্ততা থাকলেও এবারের চিত্র ভিন্ন। নেই তেমন কাজের অর্ডার। এতে করে কারখানা মালিকদের কপালে যেমন চিন্তার ভাঁজ রয়েছে, তেমনি হতাশ পাদুকা শিল্পের সঙ্গে জড়িত কারিগররাও। ব্যবসায়ীদের মতে, অর্থনৈতিক মন্দার আঁচ লেগেছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পাদুকা শিল্পে। এ ছাড়াও লোডশেডিংসহ নানা সমস্যা থাকায় সম্ভাবনাময় এই শিল্পটি এখন অনেকটাই হুমকির মুখে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১৯৬৩ সাল থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় পাদুকা শিল্পের যাত্রা শুরু। নান্দনিক ডিজাইন ও গুণগত মান ভালো হওয়ায় ক্রমেই বিকাশ ঘটতে থাকে এ শিল্পের। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এখানকার জুতার চাহিদা রয়েছে। তবে গেল কয়েক বছর ধরে ধস নেমেছে জেলার গুরুত্বপূর্ণ এই শিল্প খাতে। মাত্র কয়েক বছর আগেও জেলায় ৫ শতাধিক পাদুকা কারখানা থাকলেও এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৫০ এ। কোনো রকমে টিকে থাকা অবশিষ্ট কারখানাগুলোও চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। এসব কারখানার মধ্যে ২৫টি অটোমেটিক মেশিন এবং বাকিগুলোতে হাতে তৈরি হচ্ছে লেডিস, জেন্টস, শিশুদের জন্য বিভিন্ন ডিজাইনের জুতা। দেশব্যাপী এখানকার জুতার কদর থাকলেও চামড়াসহ প্রয়োজনীয় উপকরণের মূল্য  বেড়ে যাওয়ায় এবং জুতার তৈরির কাক্সিক্ষত অর্ডার না থাকায় ঈদ মৌসুমেও তাদের ব্যস্ততা অনেক কম। ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, করোনার পর অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাব পড়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পাদুকা শিল্পে। অন্যান্য বছর ঈদ মৌসুমকে সামনে রেখে জুতা তৈরির ব্যাপক ধুম থাকে। তবে এ মৌসুমে কাক্সিক্ষত অর্ডার মিলছে না। আর যেটুকু জুতা তৈরির অর্ডার মিলেছে লোডশেডিংয়ের কারণে তাও করতে গিয়ে বিপাকে পড়তে হচ্ছে। প্রায় প্রতিদিনই লোডশেডিং হয়। এতে করে সঠিক সময়ে জুতা উৎপাদন যেমন বিঘিœত হচ্ছে তেমনি আর্থিক লোকসানও হচ্ছে। সে সঙ্গে জুতা তৈরির উপকরণের মূল্য বৃদ্ধির পাশাপাশি মন্দার প্রভাবে কাজ কমে যাওয়ায় কারখানা টিকিয়ে রাখতে তাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। এদিকে, জেলায় থাকা অটোমেটিক মেশিন কারখানার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কুলিয়ে উঠতে না পেরে হুমকির মুখে রয়েছে শতাধিক হাতে জুতা তৈরির আদি কারখানাগুলো। এতে মালিক লাভবান না হওয়ায় কারিগররাও ন্যায্য মজুরি পাচ্ছেন না। ফলে আর্থিক সংকটের কারণে অনেক কারিগর পেশা পাল্টাচ্ছেন। তারা এ শিল্পটিকে টিকিয়ে রাখতে সরকারের সহযোগিতা কামনা করেছেন। পাদুকা শিল্পে কর্মরত কয়েকজন কারিগরের সঙ্গে কথা হলে তারা জানান, অটোমেটিক মেশিন কারখানাগুলোর সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে আদি কারখানাগুলোকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। কারণ হাতে জুতা তৈরির কারখানার শ্রমিকদের অ্যাডভান্স দিতে হয়, দৈনিক খরচ দিতে হয়। কিন্তু অটোমেটিক মেশিন কারখানাগুলোতে এমনটা নয়। সেখানে প্রতিমাসের কাজ বুঝে মাসিক ভিত্তিতে তাদের পারিশ্রমিক দিতে হয়। এ ছাড়া সেখানে কম সময়ে অধিক জুতা উৎপাদিত হয়ে থাকে। মূলত এসব কারণে খরচ বেড়ে যাওয়ায় ও বাজার মূল্যের প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে আদি কারখানাগুলোর দুর্দিন চলছে।

 তারা আরও জানান, চামড়াসহ জুতা তৈরির সব উপকরণের দাম বেড়েছে কিন্তু জুতার দাম তেমন বাড়েনি। এতে করে মালিক লাভবান না হওয়ায় শ্রমিকরাও ন্যায্য মজুরি পাচ্ছেন না। দৈনিক ১০/১২ ঘণ্টা কাজ করেও দৈনিক ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা মিলে। বর্তমানে সব জিনিসের দাম বেড়ে যাওয়ায় যে মজুরি পাওয়া যায় তা দিয়ে চলা মুশকিল। এতে পরিবার পরিজন নিয়ে কষ্টেই দিন কাটে। এই শিল্পটিকে টিকিয়ে রাখতে হলে উপকরণের মূল্যবৃদ্ধির ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ আনতে হবে। 

ব্রাহ্মণবাড়িয়া ফুট ওয়ের অ্যাসোসিয়েশন (অটো কারখানা) সাধারণ সম্পাদক মো. হানিফ মিয়া বলেন, দেশের অর্থনৈতিক মন্দার কারণে এবার জুতার চাহিদা অনেক কম। জেলায় পাদুকা শিল্পের ইতিহাসে এবারই এত কম চাহিদা লক্ষ্য করা গেছে। লোডশেংিয়ের কারণে উৎপাদন বিঘিœত হয়। ঈদ মৌসুম সামনে রেখে লোডশেডিং না হলে উৎপাদন বাড়ার পাশাপাশি পাদুকা শিল্পের সঙ্গে জড়িতরাও লাভবান হতো। তিনি এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে সরকারি সহযোগিতার দাবি জানান। হাতে তৈরি জুতা কারখানা ওয়ান্ডার সুজের মালিক মো. ওয়াসিম জানান, উপকরণের অত্যধিক মূলবৃদ্ধির কারণে আমাদের মারাত্মক আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে। জুতা উৎপাদনে যে খরচ হচ্ছে। বাজারে তেমন দাম পাওয়া যাচ্ছে না। পাশাপাশি অটো কারখানাগুলো উৎপাদন খরচ কম থাকায় তারা কমে জুতা বিক্রি করতে পারছে। যা আদি কারখানাগুলোর জন্য কঠিন। এতে করে উৎপাদন ও মুনাফার মধ্যে ঘাটতি থাকায় আদি কারখানাগুলোর অবস্থা নাজুক। সরকারের পক্ষ থেকে সহজ শর্তে ঋণ সুবিধা পাওয়া গেলে ব্যবসার আধুনিকতার মাধ্যমে এই শিল্পটিকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব।

সর্বশেষ খবর