সোমবার, ১২ জুন, ২০২৩ ০০:০০ টা

কারখানার বিষাক্ত বর্জ্যরে বিষক্রিয়ায় মরছে মাছ

সঞ্জিত সাহা, নরসিংদী

কারখানার বিষাক্ত বর্জ্যরে বিষক্রিয়ায় মরছে মাছ

শীতলক্ষ্যা নদীর চরসিন্ধুর ফেরিঘাটে মৃত মাছ দেখতে এলাকাবাসীর ভিড়

নরসিংদীর পলাশে শিল্পকারখানার বিষাক্ত বর্জ্যে মরে যাচ্ছে একসময়ের খরস্রোতা শীতলক্ষ্যা নদী। দখল আর দূষণের শিকার হয়ে বিবর্ণ হচ্ছে এই নদীর জীববৈচিত্র্য। মরে ভেসে উঠছে নদীর বিভিন্ন প্রজাতির মাছ। আর সেই মাছ সংগ্রহ করতে নদীপাড়ে ভিড় জমাচ্ছে শত শত মানুষ। বিভিন্ন শিল্পকারখানর বিশাক্ত বর্জ্যরে বিষক্রিয়ায় ৪ কেজি থেকে শুরু করে ১১ কেজি ওজনের ডিমওয়ালা মাছও মারা যাচ্ছে। ফলে দুশ্চিন্তায় পড়েছে স্থানীয় জেলেরা। নদীতে মাছ না পেয়ে পেশা ছাড়ছেন অনেক জেলে।  জানা যায়, নরসিংদীর পলাশ উপজেলার চরসিন্দুর ফেরিঘাট এলাকায় শীতলক্ষ্যা নদীতে ৩১ মে থেকে ৫ জুন পর্যন্ত বিপুল পরিমাণ মাছ মরে ভেসে উঠেছে। রুই, কাতলা, বোয়াল, আইড়, পাঙাশসহ শতাধিক প্রজাতির মাছ মরে ভেসে উঠছে। এ ছাড়া ‘মা’ মাছগুলো মরে যাওয়ার কারণে মাছের সংকট দেখা দিতে পারে নদীতে। শীতলক্ষ্যায় মরে ভেসে উঠা মাছ সংগ্রহ করতে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ছে নদীতীরবর্তী এলাকার সাধারণ মানুষ। মশারি, খেয়াজাল, মইজাল, কনীকাল, টানাজাল, ঠেলাজাল ও পলো নিয়ে এসব বিষাক্ত মাছ সংগ্রহ করতে শিশু-কিশোর, যুবক, বৃদ্ধসহ নারীরাও নেমেছেন নদীতে। শুধু তাই নয়, মাছ ব্যবসায়ী ও জেলেরা এসব মাছ বিক্রি করতে হাটবাজারে নিয়ে যাচ্ছে। তবে শীতলক্ষ্যার এসব মরা মাছ স্বাদ নয় বলে জানিয়েছেন এলাকাবাসী। তাছাড়া এসব মা মাছ থেকে কোটি কোটি রেণু পোনা উৎপাদিত হতো। ডিমওয়ালা মাছগুলো মরে ভেসে উঠার কারণে এখন নদী প্রায় মাছশূন্য হয়ে পড়েছে।

 নরসিংদী জেলার পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া শীতলক্ষ্যা নদীটি একসময় ছিল ব্যবসা-বাণিজ্যের মূল চালিকাশক্তি। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে নদীর দুই পাড় নরসিংদীর পলাশ ও গাজীপুর উপজেলার বিভিন্ন শিল্পকারখানার বিষাক্ত বর্জ্য সরাসরি ফেলা হচ্ছে নদীতে। লাল রঙের বিষাক্ত পানি সরাসরি নদীতে ফেলার কারণে নদীর পানি পচে গেছে। ফলে মরে যাচ্ছে নদীর মাছ। এ ছাড়া শিল্পপ্রতিষ্ঠানের বেশির ভাগেরই ইটিপি প্লান্ট না থাকায় বর্জ্য ফেলা হচ্ছে এ নদীতে। কিছু প্রতিষ্ঠানের ইটিপি প্লান্ট থাকলেও রাতের আঁধারে বর্জ্যগুলো সরাসরি ফেলছে নদীতে। এসব বর্জ্যরে প্রভাবে নদীর পানি কোথাও লাল, কোথাও আবার ধারণ করেছে কালচে বর্ণ। এতে বিপন্ন হয়ে পড়েছে নদীতে জীববৈচিত্র্যের অস্তিত্ব। এতে নদীর পানি দূষিত হয়ে দুর্গন্ধ বের হচ্ছে। নদীতে এখন কেউ গোসল করতে নামতে পারছে না। স্বাস্থ্যগত ঝুঁকিতে রয়েছে এ অঞ্চলের বাসিন্দারা। স্থানীয় জেলে হজরত আলী জানান, এ নদীর মাছ ধরে আমরা জীবিকা নির্বাহ করতাম। বড় বড় মাছ ধরে নিয়ে বাজারে বিক্রি করে পরিবার-পরিজন নিয়ে আনন্দ-উৎসাহে জীবনযাপন করতাম। কিন্তু এখন নদী দূষণের কারণে মাছ মরে ভেসে উঠায় আমাদের রোজগারের পথ বন্ধ হয়ে গেছে। নদীটাকে বাঁচাতে আমরা সরকারের সহযোগিতা চাই। অপর জেলে শফিকুল ইসলাম জানান, এক সপ্তাহ আগে নদীতে একটি মহামারি হয়ে গেছে। মহামারির কারণে নদীর বড় বড় রুই, কাতলা, আইড়সহ ১৫ থেকে ২০ কেজি ওজনের বড় বড় মাছ মরে ভেসে উঠেছে। টনের পর টন মাছ মানুষ ধরে নিয়েছে। তিনি আরও বলেন, মূলত বর্মি এলাকায় একটি কয়েল ফ্যাক্টরি রয়েছে। সেই ফ্যাক্টরির ক্যামিক্যালের বিষাক্ত পানি সরাসরি নদীতে ফেলে। যার ফলে বিষক্রিয়ায় নদীর সব মাছ মৃত ও অর্ধমৃত হয়ে ভেসে উঠেছে। শফিকুল বলেন, যেসব মাছ নদীর গভীরে থাকে, সহসাই জেলেরাও ওইসব মাছের দেখা পায় না, বিষাক্ত ক্যামিক্যালে সেসব মাছ মরে ভেসে উঠছে। শীতলক্ষ্যার পাড়ের মুদি দোকানদার আনোয়ার হোসেন ভূঁইয়া বলেন, গত সপ্তাহে হঠাৎ সন্ধ্যার পর শত শত মানুষ মাছ ধরতে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। গিয়ে দেখি বড় বড় মাছ মরে ভেসে উঠছে। আর সেই মাছ মানুষ ধরে নিয়ে যাচ্ছে। আমার ৫৫ বছর বয়সে নদীতে এত বড় ম্যাসাকার বা ধ্বংস আর কখনো দেখিনি। মূলত নরসিংদীর পলাশ ও গাজীপুর উপজেলায় অবস্থিত বিভিন্ন কারখানার বিষাক্ত বর্জ্য সরাসরি নদীতে ফেলা হচ্ছে। যার কারণে নদী নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। লেখক, বণ্যপ্রাণী সংরক্ষক ও পরিবেশকর্মী সরোয়ার পাঠান বলেন, কারখানার দূষিত বর্জ্যে শীতলক্ষ্যার পানি মাঝে মাঝে আলকাতরার রং ধারণ করে। ফলে নদীতে এখন আর কোনো জলজ প্রাণী, উদ্ভিদের অস্তিত্ব নেই বললেই চলে। শত শত মৎস্যজীবী এখন বেকার হয়ে পড়েছে। তার ওপর কয়েক দিন পর পর ফ্যাক্টরির বিষাক্ত বর্জ্যে নদীর ডিমওয়ালা মাছ মারা যাচ্ছে। এসব মাছ নদীতে থাকলে কোটি কোটি রেণু পোনা জন্ম নিত। নদী বাঁচাতে সরকারি হস্তক্ষেপ চাই। পলাশ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রবিউল আলম জানিয়েছেন, নদীসহ জীববৈচিত্র্য রক্ষায় জেলা ও উপজেলা প্রশাসন কাজ করছে। এই মুহূর্তে শীতলক্ষ্যায় যে ক্রাইসিস সৃষ্টি হয়েছে, তা যদি মনুষ্য সৃষ্ট হয়, তাহলে আমরা ব্যবস্থা নেব। আর যদি প্রাকৃতিক সৃষ্ট হয় তাহলে পরিবেশ ও নদী বিশেষজ্ঞদের নিয়ে মোকাবিলা করব। ফ্যাক্টরির বর্জ্য নদীতে ফেলার বিষয়ে তিনি বলেন, শীতলক্ষ্যার পাড়ে পলাশ ও গাজীপুরের বিভিন্ন কারখানা রয়েছে। নরসিংদীর অংশের কারখানাগুলোতে শতভাগ ইটিপির ব্যবহার নিশ্চিতে মনিটরিংয়ের পাশাপাশি আমার আইপি ক্যামেরা চালু করে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছি।

সর্বশেষ খবর