সোমবার, ২৬ জুন, ২০২৩ ০০:০০ টা

প্রভাবশালীদের দখলে হাওর-বাঁওড়

কুষ্টিয়া প্রতিনিধি

প্রভাবশালীদের দখলে হাওর-বাঁওড়

এক সময় কুষ্টিয়া জেলায় কয়েকটি হাওর-বাঁওড় ছিল। এসব হাওর-বাঁওড় ছিল মৎস্যজীবীদের মৎস্য আহরণ ও আয়ের অন্যতম উৎস। নদ-নদী, হাওর-বাঁওড়কে ঘিরে বিপুল মৎস্যজীবী এবং ব্যবসায়ীদের জীবন-জীবিকা চলত। দখল ও দূষণে একদিকে যেমন কুষ্টিয়া জেলার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া আটটি নদনদী হারিয়ে যেতে বসেছে। অন্যদিকে হাওর-বাঁওড় বলতে গেলে এখন আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। অনেক আগেই দখলদারের পেটে চলে গেছে হাওর-বাঁওড়। সেখানে গড়ে উঠেছে ঘরবসতি। জেলায় বর্তমানে যে দুটি হাওর-বাঁওড় রয়েছে সে দুটিও রয়েছে অস্তিত্ব সংকটে। এসব হাওর-বাঁওড়ে প্রকৃত মৎস্যজীবীদের মাছ চাষের কোনো সুযোগ নেই। দখলদারিত্ব চলে গেছে প্রভাবশালীদের হাতে। যে কারণে কুষ্টিয়ার দুটি হাওর-বাঁওড়ে দীর্ঘদিন ধরে মৎস্য চাষের সুফল থেকে বঞ্চিত প্রকৃত মৎস্যজীবীরা। প্রশস্ততা কমিয়ে ভুল পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে কুষ্টিয়ার খোকসার সিরাজপুর হাওরটি এখন মৃত খালে পরিণত হয়েছে। বর্ষায়ও পানি নেই। ইতোমধ্যে নদীর দুই তীরের কয়েক লাখ বিঘা কৃষি জমির সেচ সুবিধা বন্ধ হয়ে গেছে। মৎস্য চাষের প্রকল্পটি বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। সর্বশেষ খননের পর এক ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নিজে মাছ চাষ করার জন্য এপার-ওপার করে বাঁধ দিয়ে হাওর দখল করে নিয়েছেন। ওদিকে কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার লাহিনী এলাকায় কালিগঙ্গা-বাদলবাসা বাঁওড়টিও প্রভাবশালীরা দখলে নিয়ে মৎস্য চাষ করে। যে কারণে প্রকৃত মৎস্যজীবীরা এখানে মাছ চাষ করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছেন। কুমারখালী উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মাহামুদুল হাসান জানান, ২০২১ সালে বাঁওড়ের ইজারার মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পর থেকে বাঁওড়টি আর ইজারা দেওয়া সম্ভব হয়নি। প্রভাবশালী মহল উচ্চ আদালতে রিট করে নিজেদের দখলে রেখে সেখানে প্রায় দুই বছর ধরে মৎস্য চাষ করে আসছে। জেলার একমাত্র প্রাকৃতিক হাওর নদী খোকসার সিরাজপুর মৌজায় গড়াই নদী থেকে উৎপত্তি। তবে  হাওরটি ২১ কিলোমিটার ভাটিতে মাগুরা জেলার শ্রীপুরের আলমসা ইউনিয়নে গিয়ে আবার গড়াই নদীতে মিশেছে। চার দশক আগে বর্ষা মৌসুমে হাওর নদীতে ইলিশ মাছ ধরার বান পড়ত। বাইরে থেকে জেলেরা নৌকা নিয়ে আসত। ৯১ সালের পরবর্তী সময়ে নদী দুই তীরের লক্ষাধিক বিঘা আবাদি জমি সেচের আওতায় নেওয়া হয়। হাওরে মৎস্য সমিতির মাধ্যমে আধুনিক পদ্ধতির মাছ চাষের প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। ওই সময়ের কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে ১৫০ মিটার প্রশস্ত নদী ৩৫ মিটার প্রশস্ত করা হয়। নদীর স্বভাবিক প্রবাহ ঠেকাতে নদীর উৎসমুখ ও ভাটির মিলনস্থলে একাধিক স্লুইচ গেট তৈরি করা হয়। ফলে উৎস নদী গড়াই থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে হাওর নদী শুকিয়ে মৃত খালে পরিণত হয়।

 সরেজমিন দেখা গেছে, চলতি বছরে এলজিইডির মাধ্যমে খননের পর ইতোমধ্যে নদীর দুই তীরের জেগে ওঠা চরের জমি প্রভাবশালীরা দখল করে ঘরবাড়ি তৈরি করে বসবাস করছে। অনেকেই ফসল আবাদ করে দখল পোক্ত করেছে। কুষ্টিয়া, রাজবাড়ী ও মাগুড়া জেলার প্রায় ৩০টি গ্রাম স্পর্শ করে গেছে হাওরটি। এসব গ্রাম ও মাঠের পানি নিষ্কাশনের ৩০টি খাল এসে মিলেছে হাওরে। দুই পাড়ের হাজার হাজার একর জমি নানাভাবে প্রভাবশালীদের দখলে করে নিয়েছে। খোকসা অংশে জানিপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মজিবর রহমান মজিদ নিজে মাছ চাষের জন্য একতারপুর ব্রিজের পশ্চিম পাশ দিয়ে মাটি ফেলে চওড়া বাঁধ দিয়ে নদী ও হাওরটিকে দুই ভাগে বিভক্ত করেছেন। ফলে আসন্ন বর্ষা মৌসুমে পানি প্রবাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন স্থানীয় কৃষকরা। বাঁধ দিয়ে পানির প্রবাহ বন্ধ করে দেওয়ার ফলে বিস্তীর্ণ এলাকায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।  

জানিপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যাান হবিবর রহমান হবি বলেন, নদীটির প্রশস্ততা (চওড়া) কমিয়ে খাল বানানো হয়েছে। প্রাকৃতিক পানি প্রবাহ ঠিক থাকলে নদী তীরের লাখ লাখ বিঘা জমিতে সেচ সুবিধা দেওয়া যেত। প্রচুর পরিমাণে প্রাকৃতিক মাছ উৎপাদন হতো। নদীর প্রবাহ ঠিক রেখে পরিকল্পিতভাবে নদী খনন করা হলে নদীটি মারা যেত না। বর্তমান চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের বহিষ্কৃত সাধারণ সম্পাদক মজিবর রহমান মজিদ বাঁধ দিয়ে নদী দখল করে নিয়েছেন। হাওর নদীর জলকর ইজারাদার আবদুল মান্নান বলেন, তিনি গত বছর হাওরের ইজারা নিয়ে মাছ চাষ করেছিলেন। বেতবাড়িয়া মোড় থেকে চর দশকাহুনিয়া পর্যন্ত কিছু জায়গায় সাত মাস পানি থাকে। কিন্তু এবারে নদী খননের নামে খাল তৈরি করা হয়েছে। এতে করে এবার এ হাওরে মাছ চাষ করা যাবে না। হাওর নদীর পানি ব্যবস্থাপনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক অনিতা বিশ্বাস বলেন, শুনেছেন নদী কাটা হচ্ছে। এখন দেখি নদী কেটে খাল বানানো হচ্ছে। জানিপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মজিবর রহমান মজিদ তার বিরুদ্ধে নদী-হাওর দখলের অভিযোগ উঠেছে তা সঠিক নয় উল্লেখ করে দাবি করেন খননের প্রয়োজনে সেখানে বাঁধ দেওয়া হয়েছে।  খোকসা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রিপন কুমার বিশ্বাস বলেন, নদী বা হাওর দখলের কোনো সুযোগ নেই। এ ব্যাপারে কেউ কোনো অভিযোগ করেনি। অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

সর্বশেষ খবর