বুধবার, ৫ জুলাই, ২০২৩ ০০:০০ টা

নাটোরে লবণের দাম দ্বিগুণ বিপাকে চামড়া ব্যবসায়ী

নাটোর প্রতিনিধি

নাটোরে লবণের দাম দ্বিগুণ  বিপাকে চামড়া ব্যবসায়ী

ঈদের দিন থেকে নাটোরের আড়তগুলোতে আসছে লবণযুক্ত কাঁচা চামড়া। আশপাশের দুই-একটি জেলা থেকে চামড়া আসা শুরু করেছে। তবে নাটোরের মোকামে এখন যা আসছে তা লবণ দিয়ে সংরক্ষিত চামড়া। এর দাম লবণমুক্ত চামড়ার চেয়ে বেশি। তবে এক সপ্তাহ পর থেকে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে লবণযুক্ত চামড়া আসার কথা জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। সরকারের বেঁধে দেওয়া দামে কাঁচা চামড়া কিনে লোকসান গুনছেন ব্যবসায়ীরা। এবার চামড়ার দাম কমলেও লবণের দাম দ্বিগুণ হওয়ায় সংরক্ষণে খরচ বেশি এবং বিপাকে চামড়া ব্যবসায়ীরা। কোরবানির পশুর চামড়া কিনে লোকসানের শঙ্কায় তারা। ঢাকার ট্যানারি মালিকদের কাছে বকেয়া টাকা না পাওয়ায় নগদ টাকায় চামড়া কিনতে গিয়ে তাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। গতকাল সকালে গিয়ে দেখা যায়, ঈদের দিন থেকেই নাটোর স্টেশন বাজার-সংলগ্ন কাঁচা চামড়ার মোকাম হিসেবে খ্যাত চকবৈদ্যনাথ বাজারে চামড়া আসা শুরু করেছে। চামড়া সংরক্ষণের জন্য লবণজাত করতে ব্যস্ত সময় পার করেন শ্রমিকরা। ইতোমধ্যে রাজশাহী অঞ্চল এবং আশপাশের জেলা থেকে নাটোর মোকামে আসতে শুরু করেছে লবণযুক্ত কিছু চামড়া। এখানে প্রায় দেড় শতাধিক আড়ত রয়েছে। এসব আড়ত মালিকরা সাড়ে ৫০০ থেকে ১১০০ টাকা পর্যন্ত কম-বেশি কোরবানি পশুর চামড়া ক্রয় করছেন। এ ছাড়া ছাগল-বকরির চামড়া বিক্রি হয়েছে ১০ থেকে ৩০ টাকায়। আর লবণযুক্ত চামড়া বিক্রয় হচ্ছে ১০০ টাকায়। তবে চামড়া ক্রেতাদের দাম নিয়ে অভিযোগ না থাকলেও বিক্রেতারা বলেছেন, অল্প দামে কেনাবেচা হয়েছে কোরবারির পশুর চামড়া। রাজশাহী বাঘা এলাকার মৌসুমি ব্যবসায়ী মহিদুল হোসেন বলেন, সরকার চামড়ার দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে। তাই বেশি দামে কিনেও চামড়া বেশি দামে বিক্রি করা সম্ভব না। সরকারের বেঁধে দেওয়া দামের ওপর টার্গেট করে পশুর চামড়া কিনতে হচ্ছে। তিনি সর্বোচ্চ গরুর চামড়া কিনেছেন ১ হাজার টাকায়। আর সর্বনিম্ন ৫০০ টাকায়। এ ছাড়া ছাগলের চামড়া কিনেছেন ৩০ টাকায়। আর বকরি চামড়া কিনেছেন ১০ থেকে ১৫ টাকায়। জেলা চামড়া ব্যবসায়ী গ্রুপ ও আড়তদাররা জানান, গত দুই মৌসুমে নগদে বেচাকেনা হলেও ঢাকার ট্যানারি মালিকদের কাছে এখনো বকেয়া প্রায় ৫০-৬০ কোটি টাকা। তারপরও ধারদেনা করে চামড়া কিনতে প্রস্তুত পুঁজি হারানো অনেকেই। তবে শেষ সময়ে চামড়া সংরক্ষণের প্রধান অনুষঙ্গ লবণের অস্বাভাবিক দাম বাড়ায় বিপাকে ব্যবসায়ীরা। নগদ টাকায় চামড়া বেচাকেনা হওয়ায় পুঁজি সংকটে রয়েছেন নাটোর মোকামের অনেক ব্যবসায়ী। তার পরেও কোরবানি ঈদের সময়েই দেশের মোট ৫০ ভাগ চামড়া ঢাকার ট্যানারিগুলোতে পাঠানো হয়।

 নাটোর শহরের চালপট্রির মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ী শাহ আলম বলেন, ৫ থেকে ৭ বছর আগেও ১ হাজার ৫০০ থেকে ১ হাজার ৭০০ টাকা দিয়ে চামড়া কিনে তারা ২ হাজার থেকে আড়াই হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি করতেন। চামড়ার সেই সুদিন এখন আর নেই। এখন চামড়া কিনতে হয় ভয়ে ভয়ে, যদি বিক্রি না করতে পারি। তার পরে তিনি এ বছর ১৩টি গরুর চামড়া কিনে ২০০ টাকা কমে বিক্রয় করছেন।

 স্থানীয় আড়তদার খাইরুল ইসলাম বলেন, শ্রমিকের মজুরি ও লবণের দাম বেশি হওয়ায় সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে  তাদের চামড়ার দাম অনেক বেশি পড়েছে। চামড়া থেকে লবণের দাম বেশি। ছোট চামড়ায় পাঁচ কেজি ও বড় চামড়ায় ১০ কেজি লবণ লাগে। লবণের এত দাম হয়েছে যে চামড়া বাঁচানো দায় হয়ে যাচ্ছে। ব্যবসায়ী মুঞ্জুর-উল আলম  হিরু বলেন, লবণের দাম বেশি হওয়ার কারণে এ বছর ক্ষতির আশঙ্কা করছি। গত বছর দর ছিল ৭০০-৭৫০, এবার চলছে ১২০০-১২৫০ টাকা।

ব্যবসায়ীরা জানান, লবণের বাড়তি দামে চামড়া সংরক্ষণ নিয়ে বিপাকে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা। খরচ বেড়ে যাওয়ায় চামড়া নষ্টের আশঙ্কা তাদের। তবে ভারতে চামড়ার দাম বেশি হওয়ার কারণে তৈরি হয়েছে পাচারের শঙ্কা। সরেজমিনে নাটোর শহরের চকবৈদ্যনাথে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম চামড়ার বাজারের শতাধিক আড়তে সরকার নির্ধারিত দামে চামড়া কিনছেন ব্যবসায়ীরা। নাটোর থেকে বছরের মোট চাহিদার ৫০ শতাংশ চামড়া সংগ্রহ হয় কোরবানির ঈদে। এর মধ্যে প্রায় ২০ শতাংশ জোগান দেয় দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম নাটোরের চকবৈদ্যনাথের চামড়া মোকাম। এ বছর লবণমুক্ত গরুর চামড়া প্রকারভেদে ৮০০ থেকে ৯০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর খাসির চামড়া বিক্রি হচ্ছে ১০ থেকে ২০ টাকায়। লবণ দিয়ে সংরক্ষণের পরে ছাগলের চামড়ার পেছনে যে খরচ হচ্ছে তা বিক্রি করে উঠানো সম্ভব না। মৌসুমি ব্যবসায়ী শফিক আহমেদ বলেন, তিনি ঈদে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকায় গরুর চামড়া কিনেছেন। আড়তে বিক্রি করতে হচ্ছে সাড়ে ৮০০ টাকা দরে। আর ছাগলের চামড়া কিনেছেন গড়ে ৩০-৪০ টাকা। বিক্রি দাম দিচ্ছে ২০ টাকা। গাড়ি ভাড়া দিয়ে লোকসান গুনতে হচ্ছে। চামড়া ব্যবসায়ী আল আমিন খাসির চামড়ার দাম হওয়ার পেছনে কারণ হিসেবে বলেন, এক পিস খাসির চামড়া লবণ দিয়ে সংরক্ষণ করতে ৪০ থেকে ৫০ টাকা লবণ খরচ হয়। সঙ্গে রয়েছে লেবার খরচ। সুতরাং খাসির চামড়া বেশি দামে কেনার সুযোগ নেই। কারণ, ব্যবসায়ীদের লোকসানের আশঙ্কা রয়েছে। নাটোরের আড়তদাররা বলেন, ট্যানারি মালিকরা লবণযুক্ত বকরির চামড়ার দাম নির্ধারণ করেছে ৪০ টাকা। বকরির চামড়ায় লবণ দিতে খরচ পড়ছে ৪৫ টাকা। ফলে তারা বকরির চামড়া কিনছেন না। আর গরুর চামড়া সরকার নির্ধারিত দামেই কিনছেন বলে দাবি তাদের। চামড়া ব্যবসায়ী আবদুল হালিম সিদ্দিকী জানান, নাটোর জেলায় প্রতি মৌসুমে কাঁচা চামড়া সংরক্ষণে প্রয়োজন হয় অন্তত ৫০০ টন লবণ, কিন্তু ট্যানারি মালিকদের কাছে বকেয়া টাকার পাশাপাশি লবণের দাম বৃদ্ধি বিপাকে পড়েছেন চামড়া ব্যবসায়ীরা।

তিনি বলেন, গত কোরবানির ঈদে আমরা প্রতি বস্তা লবণ কিনেছি ৭০০-৭৫০ টাকায়। কিন্তু এবার ঈদের আগে সিন্ডিকেট করে লবণের দাম বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে প্রতি বস্তা লবণ বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৩০০ থেকে ১ হাজার ৩৫০ টাকায়। এতে চামড়া লবণজাত করতে বাড়তি খরচ গুনতে হচ্ছে। খরচ বেড়ে যাওয়ায় চামড়া নষ্টের আশঙ্কা তাদের। তবে ভারতে চামড়ার দাম বেশি হওয়ার কারণে তৈরি হয়েছে পাচারের শঙ্কা। জেলা চামড়া ব্যবসায়ী গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক শহিদুল ইসলাম বলেন, চামড়া লবণ দিয়ে সংরক্ষণ করে রাখা হবে ট্যানারি মালিকদের কাছে বিক্রির জন্য। আর গত ২ বছর ট্যানারি মালিকরা নাটোর থেকে নগদ টাকায় চামড়া কেনায় চলতি বছর ৮ লাখ পিস গরু ও ১০ লাখ পিস ছাগলের চামড়া নাটোরে সরবরাহ হবে জানান তিনি। জেলা চামড়া ব্যবসায়ী গ্রুপের চেয়ারম্যান মকসেদ আলী বলেন, এবার আশা করছি ৫-৬ লাখ গরুর চামড়া এবং ৮-১০ লাখ ছাগলের চামড়া আমদানি হবে। চামড়া পাচাররোধে ভ্রাম্যমাণ আদালতসহ কঠোর নজরদারি করবে প্রশাসন। নাটোর জেলা প্রশাসক আবু নাছের ভুইয়া বলেন, চামড়া পাচারের বিষয়ে কঠোর নজরদারি রাখা হবে। মোবাইল কোর্ট থেকে শুরু করে সব ধরনের পুলিশি টহল থাকবে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর