বৃহস্পতিবার, ১৩ জুলাই, ২০২৩ ০০:০০ টা

এখনো সেবাবঞ্চিত দহগ্রাম আঙ্গরপোতার মানুষ

লালমনিরহাট প্রতিনিধি

এখনো সেবাবঞ্চিত দহগ্রাম আঙ্গরপোতার মানুষ

লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলায় অবস্থিত দহগ্রাম-আঙ্গরপোতার মানুষ স্বাধীনতার ৫২ বছর পরও অনেক সুবিধা থেকে বঞ্চিত। শিক্ষা, চিকিৎসা থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রেই তারা অবহেলিত। দহগ্রাম আঙ্গরপোতা এলাকায় ১০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতাল থাকলেও নেই কোনো চিকিৎসা সেবা। হাসপাতালের নামে একটি অ্যাম্বুলেন্স থাকলেও তা পাটগ্রাম মেডিকেল স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে চলাচল করে। দহগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলো হয়নি পাকা। দহগ্রামের মানুষ তিনবিঘা করিডর দিয়ে বের হলেই ব্যাক তল্লাশি করার নামে পদে পদে বিএসএফের হাতে হয় লাঞ্ছিত। একজন কৃষক একটি গরু লালন-পালন করে সঠিক সময় বিক্রি করতে পারে না। একটা গরু তিনবিঘা দিয়ে পার করলে নানান বিপত্তি দেখা দেয়। ইউনিয়ন পরিষদ কর্তৃক গরুর সিরিয়ালের নামে একজন কৃষক ভোগান্তির শিকার হয়। প্রতি বছর বন্যায় দহগ্রাম ইউনিয়নের প্রবেশ করে বন্যার পানি। প্রতি বছর তিস্তার ভয়াবহ ভাঙনে ছোট হয়ে আসছে দহগ্রাম ইউনিয়নটি। দহগ্রামবাসীর জায়গা-জমিগুলো রেকর্ডভুক্ত না হওয়ায় দিশাহারা করছেন দহগ্রামের হাজারো মানুষ। ৫১ বছরেও গড়ে ওঠেনি তেমন কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১০ শয্যা বিশিষ্ট দহগ্রামে একটি হাসপাতাল উদ্বোধন করলেও, সেখানে নিয়মিত কোনো চিকিৎসক নেই। মুখ থুবড়ে পড়ে আছে হাসপাতালটি। দহগ্রাম এলাকার জায়গা-জমি রেকর্ডভুক্ত নেই। দখল সূত্রে তারা মালিক। দহগ্রামবাসী মনে করেন সরকার যদি জমিগুলো রেকর্ডভুক্ত করে তাহলে আমরা সম্পূর্ণরূপে স্বাধীন হব। দহগ্রামের মানুষ করিডর দিয়ে প্রতি সপ্তাহে ভারতীয় বিএসএফ ৬০টি গরু পারাপারের অনুমতি দিলেও প্রকৃত গরু খামারিরা এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত। অনেক রাস্তাঘাট কাঁচা রয়েছে। বর্ষাকালের দুর্ভোগে পড়েন তিস্তা চরের মানুষগুলো। দহগ্রাম ইউনিয়ন পরিষদের কাছে গত পাঁচ বছর পূর্বে বন্যায় ভেঙে গেলেও সেই ব্রিজটি মেরামতের কোনো উদ্যোগ নেই। সেই ব্রিজ দিয়ে ঝুঁকি নিয়ে শত শত মানুষ পারাপার হচ্ছে। দহগ্রাম এলাকায় ১৩০টি পরিবারের গুচ্ছগ্রাম থাকলেও সেখানে মাত্র ৫০টি পরিবার অবস্থান করছেন। টিনশেড ঘরগুলোতে থাকার অনুপযোগী তাই ধীরে ধীরে গুচ্ছগ্রাম ছাড়ছে সাধারণ মানুষ। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ব্রিটিশদের হস্তক্ষেপে ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান বিভক্তের পর ভারতের অভ্যন্তরে ২২.৬৮ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা পূর্ব পাকিস্তানের অংশে পড়ে। ১৯৭৪ সালে মুজিব ইন্দিরা চুক্তির সময়, ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী দহগ্রাম-আঙ্গরপোতাকে ভারতভুক্ত করার প্রস্তাব পেশ করেন। মুজিব ইন্দিরা চুক্তি মতে দৈর্ঘ্য ১৭৮ ও প্রস্থ ৮৫ মিটার তিনবিঘার জমিটুকু ৯৯ বছরের চুক্তিতে ভারত সরকার লিজ দেয় বাংলাদেশকে। ১৯৯২ সালের ২৬ জুন রেশনিং পদ্ধতিতে ‘তিনবিঘা করিডর’ এক ঘণ্টা পরপর দিনে ৬ ঘণ্টা খোলা রাখা শুরু করে। তখন কিছুটা হলেও মুক্তির স্বাদ পায় দহগ্রাম ও আঙ্গরপোতা দুই ছিটমহলের ২০ হাজার মানুষ। ২০০১ সালের ২১ এপ্রিল আরও ৬ ঘণ্টা বাড়িয়ে সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত করিডর গেট খোলা রাখার সিদ্ধান্ত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১১ সালে ৪ সেপ্টেম্বর তিন দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং বাংলাদেশ সফরে এলে গেটটি ২৪ ঘণ্টা খোলা রাখার সিদ্ধান্ত হয়। ওই সালের ১৯ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দহগ্রাম সফরের মধ্য দিয়ে তিনবিঘা করিডর ২৪ ঘণ্টা উন্মুক্ত ঘোষণা করেন। সেই থেকে উন্নয়নের ছোঁয়া লাগে অবহেলিত দহগ্রাম-আঙ্গরপোতায়। তৈরি হয় সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। নির্মিত হয় নতুন নতুন ভবন, উন্নতি ঘটে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার। এর পর ১৯৮৫ সালে দহগ্রাম একটি স্বতন্ত্র ইউনিয়ন পরিষদ হিসেবে লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার সঙ্গে যুক্ত হয়। দহগ্রামে চর সৈয়দ পাড়া গ্রামের কুরফান আলী (৫০) বলেন, আমরা মুক্ত হয়েও কিছু জিনিস বঞ্চিত হয়ে আছি। পাটগ্রাম শহরের হাট বাজার করতে গিয়ে বিজিবি-বিএসএফের তল্লাশি বাড়ি ফেরার পথে একবার তল্লাশি করে। এভাবেই আমরা দিন দিন ভোগান্তিতে পড়েছি। তিনবিঘা করিডর এলাকায় এমন তল্লাশিতে আমরা স্বাধীনভাবে বসবাস করতে পারছি না। দহগ্রাম ইউনিয়নের বাসিন্দার আনিসুর রহমান বলেন, বিক্রির জন্য প্রতি সপ্তাহের ৬০টি গরুর অনুমতি দেয় ভারতীয় বিএসএফ। আমরা নির্ধারিত সময় গরু বিক্রি করতে পারি না। এ এলাকায় খামারও করতে পারি না আমরা অনেক কষ্টের মধ্যে রয়েছি। স্বাধীন বাংলায় থেকে ভারতীয় বিএসএফের এমন সিদ্ধান্তে আমরা মেনে নিতে পারি না। আমাদের পালিত গরু-ছাগল বিক্রি করতে যাতে কোনো সমস্যা বিঘ্ন না হয় এটাই আমরা সরকারের কাছে দাবি জানাই।

সর্বশেষ খবর