মঙ্গলবার, ১৮ জুলাই, ২০২৩ ০০:০০ টা

উন্নয়নে বদলে গেছে সাবেক ছিটমহল দাসিয়ারছড়া

খন্দকার একরামুল হক সম্রাট, কুড়িগ্রাম

উন্নয়নে বদলে গেছে সাবেক ছিটমহল দাসিয়ারছড়া

দীর্ঘ ৬৮ বছরের অন্ধকার জীবন থেকে মুক্তি পেয়ে কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার দাসিয়ারছড়ার সাবেক ছিটমহলের বাসিন্দারা এখন উন্নয়নের জোয়ারে ভাসছেন। তাদের চোখে-মুখে এখন অনেক আনন্দ ও হাসির ঝিলিক। বন্দিদশা থেকে যাদের মুক্তি ছিল একেবারেই স্বপ্ন, তারা এখন পুরো মুক্ত স্বাধীন। শুধু তাই নয়, এখন তারা সব দিক থেকে যথেষ্ট উন্নতি লাভ করেছেন। সব পর্যায়ে তাদের চাওয়া-পাওয়া পূরণ হয়েছে বলে সরেজমিন জানা যায়। সে সময় এ ছিটে ছিল না চিকিৎসা ও শিক্ষার ব্যবস্থা। আধুনিক ঘরবাড়ি তো দূরের কথা, চলাচলের কোনো রাস্তাঘাট ছিল না। অনেকেই নাগরিকত্ব না থাকায় পরিচয় গোপন করে অন্য কোথাও থেকে নিজে কিংবা সন্তান- সন্ততিকে পড়াশোনা করাতে হয়। আবার অসুস্থ রোগীর চিকিৎসাও নেন গোপন পরিচয়ে। এভাবেই চলত তাদের দীর্ঘ সময়ের একটি অবরুদ্ধ জীবন। নাগরিকত্ব পাওয়ার বেশ কয়েক বছর পেরিয়ে গেছে তাদের। তাই তাদের আধুনিক জীবনযাপনের ছোঁয়াও লেগেছে এ সাবেক ছিটমহলে। বিগত ২০১৫ সালের ৩১ জুলাই ভারত বাংলাদেশ ছিটমহল বিনিময়ের মধ্য দিয়ে  দুই দেশে থাকা ছিটমহলগুলো দুই দেশের মূল ভূখে র সঙ্গে সংযুক্ত হয়। এতে ১৬২ ছিটমহলবাসীর ৬৮ বছরের বন্দিদশার সমাপ্তি ঘটে। ছিটমহল বিনিময়ের পর থেকেই বঞ্চিত এ মানুষগুলোকে মূলধারায় যুক্ত করতে বিভিন্ন উন্নয়ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার। এখন আর তাদের নেই কোনো সুযোগ-সুবিধার সংকট। বিগত কয়েক বছরে আমূল পরিবর্তন এসেছে তাদের। যোগাযোগ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্যসহ সামাজিক নিরাপত্তার মতো নাগরিকের মৌলিক অধিকারের সব কিছুই এখন তাদের হাতের নাগালে। এসব করেছে বর্তমান সরকার। দেশের অভ্যন্তরে অন্যান্য ছিটমহলগুলোর মতো উন্নয়ন ঘটেছে কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার দাসিয়ারছড়া ছিটমহলেও। উন্নয়নের ছোঁয়ায় পাল্টে গেছে দাসিয়ারছড়াবাসীর জীবনমান। প্রতি বছর এখানকার বাসিন্দারা তাদের আগের অন্ধকার দিনগুলো স্মরণ করে দিবসটি পালন করেন। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতের যে ১১১টি ছিটমহল রয়েছে তার সবচেয়ে বড় এবং আয়তন ৬ দশমিক ৬৫ বর্গকিলোমিটার ফুলবাড়ী উপজেলার দাসিয়ারছড়া। ভারত ও বাংলাদেশের যৌথ হেড কাউন্টিং ২০১৫ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী বর্তমানে এখানে ১ হাজার ৩৬৪টি পরিবারের ৬ হাজার ৫২৯ জন মানুষের বসবাস। জেলা ও উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, এখন এ ছিটের বাসিন্দাদের প্রত্যেকের ঘরে ঘরে রয়েছে বিদ্যুৎ সংযোগ। ৫৭ কিমি নতুন লাইনে প্রায় ২ হাজারেরও বেশি পরিবার পান এ সংযোগ।

অন্তত ৪০ কিলোমিটারের বেশি সড়ক পাকা করা হয়েছে। নির্মাণ করা হয়েছে ১টি ৩৬ মিটারের ব্রিজসহ ৫টি ব্রিজ ও বেশ কিছু কালভার্ট। স্থাপিত হয়েছে তিনটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, একটি দাখিল মাদরাসাকে সরকারিকরণের ঘোষণা করা হয়েছে, এমপিওভুক্ত হয়েছে ৪টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তিনটি কমিউনিটি ক্লিনিক। মসজিদ, মন্দিরসহ রিসোর্স সেন্টার। ডিজিটাল আইসিটি ট্রেনিং সেন্টার। এ ছাড়াও শতভাগ সেচের আওতায় আনা হয়েছে এখানকার আবাদি সব কৃষি জমি। ৩ হাজার ভিজিডিসহ শতভাগ বাড়িতে নিশ্চিত করা হয়েছে সুপেয় পানি ও স্যানিটেশন ব্যবস্থা। বাংলাদেশ শিশু একাডেমি স্থাপন করেছে ১৫টি প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা কেন্দ্র। এ ছাড়া ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেছে ১৪টি মসজিদভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কেন্দ্র। সেখানকার বাসিন্দাদের দেওয়া হয়েছে জাতীয় পরিচয়পত্র ও স্মার্ট কার্ড। উন্নয়নের ছোঁয়ায় এখানকার মানুষ বদলেছে। জীবনচিত্রের পরিবর্তন ঘটেছে এখানকার মানুষের। দাসিয়ারছড়া সমন্বয় পাড়া নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের  প্রধান শিক্ষক  নুর ইসলাম জানান, বর্তমান সরকার ছিটমহলের ৪টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্ত করায় আমরা ছিটমহলবাসী চিরকৃতজ্ঞ। তাই আমরা ছিটমহলবাসী আজীবন মনে রাখব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। ছিটমহলের বাসিন্দা ও এক মুদি দোকানদার লুৎফর রহমান জানান, শেখ হাসিনা সরকার আমাদেরকে ৬৮ বছরের অন্ধকার জীবন থেকে সব নাগরিককে মুক্তি দিয়েছে। সরকার আমাদের অনেক উন্নয়ন করেছে। আমার এক ছেলে বিনা টাকায় বিনা সুপারিশে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ বিজিবিতে চাকরি পেয়েছে। শুধু আমার ছেলে নয় ছিটমহলের অনেকেই আর্মি, বিজিবিসহ ভালো ভালো স্থানে চাকরি করছে। বাংলাদেশ না হলে এটা সম্ভব হতো না। আমরা এখন গর্ব করে বলি আমরা বাঙালি। বাংলাদেশ-ভারত ছিটমহল বিনিময় বাংলাদেশ শাখার দাসিয়ারছড়া ইউনিটের সভাপতি আলতাফ হোসেন জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছিটমহল বিনিময়ের মাধ্যমেই দীর্ঘ ৬৮ বছরের অন্ধকার জীবন থেকে আমাদের মুক্তি দিয়েছেন। তিনি অনেক উন্নয়ন ঘটিয়েছেন এখানে। রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট, স্কুল-কলেজ, ঘরে ঘরে বিদ্যুৎসহ ব্যাপক উন্নয়ন করা হয়েছে ইতোমধ্যে। আমরা জীবনে এত উন্নয়নের কথা ভাবিনি। আমাদের এখানে হিন্দু মুসলিম সবাই মিলে অনেক ভালো আছি। বর্তমান সরকার আমাদের ভালো রেখেছে। তাই এই সরকারের দীর্ঘায়ু কামনা করি। জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাঈদুল আরীফ জানান, এ পর্যন্ত দাসিয়ারছড়ায় শিক্ষা, স্বাস্থ্য, রাস্তাঘাট, কালভার্ট, ব্রিজ, বিদ্যুৎসহ ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। প্রয়োজন অনুযায়ী আরও যা যা দরকার হবে তা সরকার করবে।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ছিটমহল নিয়ে স্থায়ী সমাধানের জন্য ১৯৭৪ সালের ১৬ মে বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ‘মুজিব-ইন্দিরা’ স্থলসীমানা চুক্তি  করেন। এ চুক্তি দীর্ঘ সময় নানা কারণে বাস্তবায়ন না হলেও আওয়ামী লীগ সরকারের কূটনৈতিক তৎপরতায় ২০১৫ সালের ৩১ জুলাই মধ্য রাতে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ছিটমহল বিনিময় সম্পন্ন হয়।

সর্বশেষ খবর