মঙ্গলবার, ১ আগস্ট, ২০২৩ ০০:০০ টা

পুঁজির অভাবে হারিয়ে যাচ্ছে মৃৎশিল্প

নাটোর প্রতিনিধি

পুঁজির অভাবে হারিয়ে যাচ্ছে মৃৎশিল্প

নাটোরের ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প পুঁজির অভাবে দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে। উত্তরবঙ্গের এই ছোট জেলা মৃৎশিল্পের জন্য সুপ্রসিদ্ধ ছিল। এক সময় ছিল যখন, বাংলার ঘরে ঘরে মাটির তৈরির হাঁড়ি-পাতিল, কলসি, থালা, বাটি, ফুলের টব, ফুলদানি, ব্যাংক, খাবার টেবিল, টালি, টাইলস, খেলনা, শৌখিন সামগ্রীসহ নানা জিনিসপত্রের ব্যবহার হতো। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পাইকারি ব্যবসায়ীরা এখানে এসে মাটির তৈরি জিনিসপত্র কিনে নিয়ে যেত। মৃৎশিল্পের বিভিন্ন উপাদানে গ্রামীণ বাংলার হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখ, রোমাঞ্চকর, মনোমুগ্ধকর ছবি ফুটিয়ে তুলতেন শিল্পীরা। মৃৎশিল্পীরা এই শিল্পের ওপর ভিত্তি করে একসময় শক্তিশালী অর্থনৈতিক ভীত করে তোলে। দেশের অর্থনৈতিক বাজার চাঙা রাখতে মৃৎশিল্পের কোনো বিকল্প ছিল না। তবে বর্তমান দৈনন্দিন জীবনে প্লাস্টিক, স্টিল, ম্যালামাইন, চিনামাটি, সিলভারসহ বিভিন্ন ধরনের ধাতব পদার্থের তৈরি হাঁড়ি-পাতিল, খেলনা, শৌখিন জিনিসপত্রের ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে ধ্বংসের মুখে প্রাচীন বাংলার ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প। ব্যবসা চালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে থাকলেও পর্যাপ্ত পুঁজির অভাবে অনেক শিল্পী বাপ-দাদার রেখে যাওয়া এই শিল্পকে ছেড়ে ভিন্ন পেশা বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছেন। এক সময় পয়লা বৈশাখ মেলাসহ বছরের অন্যান্য সময়ে অনুষ্ঠিত মেলা পূজা-পার্বণে মাটির তৈরি মনোমুগ্ধকর খেলনা, শৌখিন জিনিসপত্র তৈরিতে পাল পাড়ায় মহাধুম পড়ে গেলেও বর্তমানে তা শুধুই স্বপ্ন। তবে গত বছরগুলোর তুলনায় এবার বৈশাখী মেলাতে দেশের বিভিন্ন স্থানে মৃৎশিল্পের বিভিন্ন উপাদান জোগান দিতে শিল্পীদের মাঝে দেখা যায়নি উৎসাহ ও উদ্দীপনা। সদর ও নলডাঙ্গা উপজেলার তেবাড়িয়া হাট পালপাড়া, আমহাটি, কাইশাবাড়ী, জগদ্বীশপুর, বাঙ্গালপাড়া গ্রামের বেশির ভাগ শিল্পী ব্যবসা ধরে রাখতে এ বছর শুধু হাঁড়ি-পাতিল, ফুলের টব স্যানিটারি পায়খানার রিং তৈরিতেই ব্যস্ত সময় পার করছেন। মৃৎশিল্পীরা অনেকটা ভালোবেসেই শতকষ্টের মধ্যেও এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন। শিল্পীদের মাঝে উৎসাহ-উদ্দীপনার অভাব মৃৎশিল্পের অস্তিত্বকে ক্রমান্বয়ে সংকটাপন্ন করে তুলছে। পুঁজির স্বল্পতা, আর্থিকভাবে ক্রমাগত লোকসান মৃৎশিল্পের স্থায়িত্ব ও প্রসারকে ব্যাপকভাবে বাধাগ্রস্ত করছে। নলডাঙ্গা উপজেলার সীমান্ত ঘেঁষা গ্রাম বাঙ্গাল পাড়া, কাইসাবাড়ী, জগদ্বীশপুর পালপাড়া মৃৎশিল্পের জন্য বিখ্যাত। এখানে দেখা হয় তিন সন্তানের জননী রচনা দাসের সঙ্গে। তার বাড়িতে ঢুকতেই চোখে পড়ল, বারান্দায় দরজার সামনে বসে মা-মেয়ে চানাচুর প্যাকেটিং করছেন। মৃৎশিল্পের দুরবস্থার কারণে বিকল্প পেশা হিসেবে চানাচুর ভেজে মোড়কজাত করে বাজারে বিক্রি করে সংসার চালান। তিন মেয়ের পড়ালেখা ও ভরণ-পোষণের অর্থ জোগাড় করতে অনিচ্ছা সত্ত্বেও তিনি অন্য পেশায় যেতে বাধ্য হচ্ছেন। তার মতো অবস্থা এ গ্রামের অনেকেরই। কেউ বা কৃষিকাজ, ড্রাইভারি, ব্যবসাসহ অন্য পেশায় জীবিকা অর্জনের চেষ্টা করছেন। এখানে প্রায় প্রতিটি পরিবারই মৃৎশিল্পের সঙ্গে জড়িত। বংশানুক্রমে তারা এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত। মৃৎশিল্পের বর্তমান অবস্থা নাজুক হলেও এই শিল্প ছেড়ে অন্য কোনো পেশা গ্রহণ করার কথা এখানকার শিল্পীরা যেন ভাবতেই পারেন না। মৃৎশিল্পী মোহন দাস জানান, বর্তমানে মৃৎশিল্পের বাজার খুবই খারাপ। কোনো রকমে খেয়ে-পরে চলে। শিল্পী না বাঁচলে শিল্প বাঁচে না উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, সরকার এই শিল্পের জন্য আলাদা ব্যাংক ঋণ, সরকারি বেসরকারি অনুদানের ব্যবস্থা করলে মৃৎশিল্পকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী এ শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা, নানা উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন। তা না হলে অচিরেই বাংলার বুক থেকে হারিয়ে যাবে এক সময়ের ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প।

সর্বশেষ খবর