১৯ অক্টোবর, ২০১৫ ১৬:০৩

পূজায় মন্দিরে মন্দিরে

পূজায় মন্দিরে মন্দিরে

বাংলাদেশের প্রতিটি জেলাতেই প্রাচীন প্রত্নতত্ত স্থাপনা রয়েছে, যা আমাদের ঐতিহ্য। এসব প্রাচীন স্থাপত্যের মধ্যে সনাতন হিন্দুধর্মাবলম্বীদের উপাসনালয়ও রয়েছে। হাজার বছরের ইতিহাস রয়েছে এসব মন্দিরের। এবারের পূজায় এসব প্রাচীন সাম্রাজ্য থেকে ঘুরে আসতে পারেন।

 

<<  ঢাকেশ্বরী মন্দির : পুরান ঢাকার সবচেয়ে প্রাচীন মন্দির এটি। পুরান ঢাকার বকশীবাজারে মন্দিরটি অবস্থিত। প্রাচ্যের অক্সফোর্ড ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একেবারে দক্ষিণ-পশ্চিমে মন্দিরটির অবস্থান। নামকরণে আর স্থাপত্য নিয়ে বিতর্ক থাকলেও ধারণা করা হয় খিস্টপূর্ব ১২০০ সালে মন্দিরটি নির্মাণ করা হয়। মন্দিরটি নির্মাণে মজার গল্প কথিত আছে। কিংবদন্তি রাজা বল­াল সেন স্বপ্নে দেখেন, বুড়িগঙ্গার তীরের জঙ্গলে দুর্গাদেবী পড়ে আছেন। তিনি সেই দেবীকে উদ্ধার করে সেখানে মন্দির স্থাপন করেন, যার নাম ঢাকেশ্বরী মন্দির। অনেকের মতে, এই ঢাকেশ্বরী থেকেই ঢাকার উৎপত্তি। এর নির্মাণশৈলী ও গঠন প্রণালি থেকে ধারণা করা যায় প্রথমে তা বৌদ্ধ মন্দির ছিল। পরবর্তী সময়ে যা রূপান্তরিত হয় হিন্দু মন্দিরে। ষোরশ শতাব্দীতে সেনাপতি মানসিংহ মন্দিরটির সংস্কার কাজ করেন। তখন তিনি চারটি শিবলিঙ্গ স্থাপন করে চারটি শিবমন্দির নির্মাণ করেন। মন্দিরের জলাশয় ও বিশ্রামাগারের পূর্ব পাশে সাধুদের সমাধি রয়েছে। এ মন্দিরে সবচেয়ে আকর্ষণীয় হলো শিবলিঙ্গ। মন্দিরটির শ্রী শ্রী দুর্গামাতা সোনা দিয়ে নির্মিত বলে গোটা উপমহাদেশেই বিখ্যাত। মন্দিরটির নির্মাণকাল থেকে আজ অবধি এটি ঢাকাসহ সারা দেশের জাতীয় মন্দির।

 কীভাবে যাবেন : ঢাকা বা তার আশপাশের যে কোনো স্থান থেকেই যাতায়াত সহজ। ঠিকানা ১০ অরফানেজ রোড, লালবাগ, ঢাকা-১২১১।

 

<< আদিনাথ মন্দির : বাংলাদেশের বিখ্যাত অন্যতম প্রধান হিন্দু মন্দির। হিন্দুধর্মাবলম্বীদের জন্য মন্দিরটি প্রাচীন তীর্থস্থান। কক্সবাজার থেকে মাত্র ১২ কিমি দূরে মহেশখালীর গোরকঘাটা ইউনিয়নের ঠাকুরতলা গ্রামে মৈনাক পাহাড়ের চূড়ায় এই বিখ্যাত আদিনাথ মন্দিরটির অবস্থান। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৮৫ মিটার উচ্চতায় মন্দিরটির অবস্থান। মন্দিরটির দৈর্ঘ্য ১০.৫০ মিটার, প্রস্থ ৯.৭৫ মিটার এবং উচ্চতা প্রায় ৬ মিটার। মৈনাক পাহাড়ের চূড়ায় ৬৯টি সিঁড়ি ভেঙে উঠতে হয়। অনেকে আবার মন্দিরটিকে শিবমন্দিরও বলে থাকেন। কথিত আছে, স্থানীয় জমিদার শিকদার সাহেব, রামুর জমিদার প্রভাবতী দেবী ও নেপাল রাজার পৃষ্ঠপোষকতায় মন্দিরটি নির্মাণ করা হয়। মন্দির ছোট হলেও অনেক প্রাচীন। সিঁড়ির মুখে গেট পেরুলে খোলা চত্বর নাথ মন্দির। এরপর সাদা দালানের পাশাপাশি ছয়টি কক্ষে আদিনাথ ও অষ্টভুজার মন্দির। পাহাড় বেষ্টিত মন্দিরটির তিন দিকেই সমুদ্র। আদিনাথ মন্দিরে শিবচতুর্দশীতে বিশেষ পূজা ও উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। রূপ-বৈচিত্রের দিক থেকেও আদিনাথ মন্দিরটি বেশ আকর্ষণীয়।

 কীভাবে যাবেন : কক্সবাজার শহরের কস্তুরাঘাট থেকে সমুদ্রপথে যাত্রা করে মহেশখালী যেতে প্রায় ৩০ মিনিট লাগে। জনপ্রতি ভাড়া পড়বে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা। এ ছাড়া ইঞ্জিনচালিত নৌকা ও সাম্পানে গোরকঘাটা ঘাটে গিয়ে নামতে হয়।

 

<< চন্দ্রনাথ মন্দির : চারদিকে চিরহরিৎ সবুজের বাগান, ছোট-বড় পাহাড়-টিলা, আর সামনে একটু নিচু এক পাহাড়ের চূড়ায় একটা মন্দির দেখতে একেবারে খেলনা বিন্দুর মতো। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে অবস্থিত চন্দ্রনাথ পাহাড়ের উপরে একটি প্রাচীন ও বিখ্যাত মন্দির। সীতাকুণ্ড অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভ‚মি। এলাকাটিকে হিন্দু এলাকাই বলা চলে। সীতাকুণ্ড বাজার দিয়ে ছোট্ট মেঠোপথ গিয়ে ঠেকেছে চন্দ্রনাথ পাহাড়ে। মাত্র ২ কিলোমিটার দূরত্বে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১২০০ ফুট উঁচু কাঁচা মাটির পথ পেরিয়ে মন্দিরে যেতে হয়।  চন্দ্রনাথ মন্দির হিন্দুদের জন্য এক পবিত্র স্থান। যার পুরো নাম ছিল সীতার কুণ্ড মন্দির। দক্ষিণে বিস্তীর্ণ সাগর আর পাহাড়ি সৌন্দর্যে আবৃত এই মন্দিরটি। মন্দিরের পথ ধরে যেতে প্রথমেই পড়বে ভবানী মন্দির। তারপর শয়মভুনাথ, এরপরই মনকাড়া সৌন্দর্যের ছোট্ট পাহাড়ি ঝরনা। এরপরই দুর্গম এলাকার পাহাড় কেটে বানানো উঁচু সিঁড়ি। পথে পড়বে বটগাছের প্রাচীন দুটি মন্দির। পুরো দৃশ্যটিই যে শিল্পীর নিখুঁত কারুকাজ।

 কীভাবে যাবেন : ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের বাসে করে সীতাকুণ্ড যাওয়া যায়। পাহাড়ি দুর্গম এলাকা বলে রাত কাটানোর কোনো ভালো ব্যবস্থা নেই।

 

 

<< নবরত্ন মন্দির : দেশের সবচেয়ে বড় নবরত্ন মন্দির। প্রায় পাঁচশ বছরের পুরনো ঐতিহ্য এই হাটিকুমরুল নবরত্ন মন্দির। সিরাজগঞ্জের উল­াপাড়া উপজেলার হাটিকুমরুল ইউনিয়নে অবস্থিত। তিন তলাবিশিষ্ট মন্দিরটির আয়তন ১৫ বর্গ মিটারেরও বেশি। স্থানীয়দের কাছে দোলমঞ্চ নামে পরিচিত। মন্দিরের চারপাশের দেয়ালে পোড়ামাটির অলঙ্করণে ভরপুর। দেখতে অনেকটা কান্তজিউ মন্দিরের মতো। ধারণা করা হয়, ১৭০৪-১৭২৮ সালের মধ্যে নবাব মুর্শিদকুলি খানের সময় রামনাথ ভাদুরী মন্দিরটি নির্মাণ করেন। কথিত আছে রামনাথ জমিদার ছিলেন। দুই পাশে ধান খেতের বুক চিড়ে ছোট্ট মেঠো পথ ধরে চলে যাওয়া পথ ধরে গেলেই দেখা মিলবে পোড়ামাটির কাব্যে গাঁথা অনন্য শিল্প। উঁচু বেদীর ওপর নবরত পরিকল্পনায় নির্মিত মন্দিরের প্রতিটি বাহু ১৫.৪ মিটার দৈর্ঘ্য ও ১৩.২৫ মিটার প্রস্থ। মন্দিরের বারান্দায় সাতটি ও ভিতরে পাঁচটি প্রবেশপথ রয়েছে। তবে দ্বিতীয় তলায় কোনো বারান্দা নেই। পুরো মন্দিরটির বাইরে পোড়ামাটির কারুশিল্প দিয়ে তৈরি। বিভিন্ন দেব-দেবীর আকৃতি, লতা-পাতার আকার দিয়ে শৈল্পিক কাজ করা। আশপাশে শিব-পার্বতী মন্দির, চণ্ডি মন্দির, শিব মন্দির নামের আরও তিনটি ছোট মন্দির রয়েছে।

 কীভাবে যাবেন : ঢাকা থেকে এক দিন সময় নিয়ে বেড়িয়ে আসুন প্রাচীন এই শৈল্পিক হাটিকুমরুল নবরত্ন মন্দির থেকে। বগুড়াগামী যে কোনো বাসে উঠে নেমে পড়তে পারবেন হাটিকুমরুল।

 

<< কান্তজিউ মন্দির : দিনাজপুর শহর থেকে মাত্র ২১ কিলোমিটার দূরত্বে সুন্দরপুর ইউনিয়নে মন্দিরটির অবস্থান। ১৮ শতকের চমৎকার ধর্মীয় স্থাপনা এটি। এটি নবরত্ন নামেও পরিচিত, কারণ মন্দিরটির চূড়ায় নয়টি চূড়া বা রত্ন ছিল। এ ছাড়াও মন্দিরটি হিন্দু সম্প্রদায়ের কান্ত বা কৃষ্ণের মন্দির হিসেবে পরিচিত, যা লৌকিক রাধা-কৃষ্ণের ধর্মীয় প্রথা হিসেবে প্রচলিত ছিল। প্রায় তিন ফুট উঁচু ও ৬০ ফুট বাহুবিশিষ্ট পাথর দিয়ে নির্মিত বর্গাকৃতি জায়গার ওপর মন্দিরটি স্থাপিত। প্রত্যেকটি বাহুর দৈর্ঘ্য ৫২ ফুট ও উচ্চতা ৭০ ফুট। দেখতে অনেকটা রথের মতো। প্রচলিত কাহিনী থেকে জানা যায়, মহারাজা জমিদার প্রাণনাথ রায় মন্দিরটি নির্মাণকাজ শুরু করেন ১৭২২ সালে আর তার মৃত্যুর পর তার ছেলে মহারাজা রামনাথ রায় ১৭৫২ সালে নির্মাণকাজ শেষ করেন। মন্দিরের বাইরের দেয়ালজুড়ে পোড়ামাটির অলঙ্কৃত রামায়ণ, মহাভারতসহ বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনী। বারান্দার সামনে রয়েছে ইটের তৈরি দুটি করে স্তম্ভ। এই স্তম্ভের সাহায্যে দেয়ালের সঙ্গে প্রত্যেক পাশে সংযুক্ত রয়েছে তিনটি খোলা দরজা। দ্বিতীয় তলার ভিতরে মূল কামরাসহ মোট ১৮টি কক্ষ রয়েছে। মন্দিরের বেদির নিচে ও দেয়ালের গায়ে পোড়ামাটি খচিত ছবি রয়েছে।

কীভাবে যাবেন : দিনাজপুর বাস স্টেশন থেকে পীরগঞ্জের বাসে কান্তগর নামতে হবে। সেখান থেকে নৌকাতে করে ঢেপা নদী পার হয়ে একটু সামনেই মন্দিরটি।

 

<< পুঠিয়ার মন্দির : রাজশাহী শহর থেকে ৩২ কিলোমিটার দূরের শহর পুঠিয়া। রাজশাহীর পুঠিয়া রাজবাড়ীর বিশাল চত্বরে রয়েছে বেশ কটি নজরকাড়া প্রাচীন মন্দির। পুঠিয়া রাজবাড়ীতে প্রবেশমুখেই পুকুর পাড়ে শিব মন্দির। রানী ভুবন মোহিনী দেবী ১৮২৩ সালে এটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ৬৫ ফুট দীর্ঘ শিব মন্দিরটি উঁচু ভিতের ওপর নির্মিত। চার কোণায় ও কেন্দ্রতে রত্ন আছে। ভিতরে কষ্টি পাথরের বিশাল এক শিব লিঙ্গ। মন্দিরটিকে উপমহাদেশের অন্যতম বড় শিব মন্দির বলা হয়। পাশেই গোল গম্বুজ আকৃতির আরেকটি মন্দির আছে। কিছু দূর গেলেই চোখে পড়বে চার তলাবিশিষ্ট দোলমন্দির। চতুর্থ তলার ওপরে আছে গম্বুজাকৃতির চূড়া। ঊনবিংশের শেষ দশকে রানী হেমন্ত কুমারী দেবী এ মন্দির নির্মাণ করেন। এ ছাড়া পোড়ামাটির অলঙ্করণে তৈরি গোবিন্দ মন্দির। মন্দিরটি ২৫০ বছরের পুরনো বলে প্রচলিত থাকলেও মন্দিরের গায়ে উলে­খ করা ঊনবিংশ শতাব্দীতে নির্মিত। এ মন্দিরটির দক্ষিণ পাশে ছোট আরেকটি মন্দির আছে। সব মন্দিরই প্রাচীন ঐতিহ্যের, তা দেখলেই বোঝা যায়।

 কীভাবে যাবেন : রাজশাহী কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল থেকে নাটোরগামী বাসে চড়ে পুঠিয়া নামতে পারবেন।

                                                                                                          ফ্রাইডে ডেস্ক                                                            

 

 

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর