১ আগস্ট, ২০২৩ ০৮:২৫

পলিতে কমেছে তিস্তার পানিধারণ ক্ষমতা

ভরা বর্ষায়ও যেন ডুবোচর ঝুঁকিতে উত্তরের তিন জেলা

লালমনিরহাট প্রতিনিধি

পলিতে কমেছে তিস্তার পানিধারণ ক্ষমতা

ফাইল ছবি

দফায় দফায় বন্যার পানিতে ভেসে আসা পলি আর নদীর ভয়াবহ ভাঙনে তিস্তার গভীরতা কমে গেছে। সৃষ্টি হয়েছে নতুন নতুন চর। সংস্কার বা খননের অভাবে গত ৩০ বছরে নদী তার মূল প্রবাহ থেকে সরে প্রায় ৩ কিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত হয়েছে। ফলে তিস্তায় অল্প পানিতেই বন্যা ও ভাঙনের মতো ক্ষতি বাড়ছে। ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট ও জমি হারিয়ে নিঃস্ব হচ্ছেন তিস্তাপাড়ের হাজারো মানুষ। আতঙ্ক, কান্না আর হতাশার মধ্যে দিন কাটছে তাদের। নদী গবেষক ড. তুহিন ওয়াদুদ মনে করেন, যদি অচিরেই তিস্তা খনন করা না হয় তাহলে এ অঞ্চলের প্রায় ২ কোটি মানুষের জীবনজীবিকা হুমকিতে পড়বে। মরুভূমিতে পরিণত হবে এ অঞ্চল। তিস্তা ঘিরে প্রতিদিনই নানা সংকট তৈরি হবে। তাই আগামীকাল প্রধানমন্ত্রীর সফরে যদি তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের ঘোষণা দেওয়া হয় এবং তা যদি বাস্তবায়ন করা হয়, তবেই রক্ষা পাবে এ অঞ্চল।

এই নদী গবেষক বলেন, ‘এখন ভরা বর্ষা। অথচ তিস্তায় পানি নেই। কখন ভারত থেকে পানি আসবে সে আশায় রয়েছি আমরা।’

সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, ভরা বর্ষায়ও তিস্তার বুকজুড়ে জেগে উঠেছে অসংখ্য চর। কোথাও হাঁটুপানি আবার কোথাও জেগে ওঠা চরের দীর্ঘশ্বাস, কান্না।

নদী আন্দোলনকারীরা বলছেন, তিস্তা পরিচর্যায় দ্রুতই উদ্যোগ নেওয়া না হলে বিশাল এক জনগোষ্ঠী দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাবে। সব থেকে বেশি ক্ষয়ক্ষতির ঝুঁকিতে তিস্তাতীরবর্তী লালমনিরহাট, রংপুর ও নিলফামারীর জেলার মানুষ।

লালমনিরহাটের হাতিবান্ধা উপজেলার গড্ডিমারীর বাসিন্দা আকবর আলী জানান, গত কয়েক বছরে পাঁচবার তার বসতভিটা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। সদর উপজেলার খুনিয়াগাছ ইউনিয়নের চোংগাডারা গ্রামের শফিকুল মিয়া বলেন, ‘তিন দিন ধরে বন্যার পানিতে কষ্ট ভোগ করলাম। এখন নদীর পানি নেমে যাচ্ছে তাই ভাঙনের আতঙ্কে আছি।’ একই এলাকার বাসিন্দা আবু হোসেন বলেন, ‘কিছুদিন আগে বাড়ি সরিয়ে অন্যের জমিতে ঠাঁই নিয়েছি। এবারসহ ১১ বার বাড়ি সরিয়ে নিলাম। আমার সব সম্পত্তি এখন নদীতে।’ আদিতমারী উপজেলার মহিষখোঁচা চণ্ডীমারীর বাসিন্দা খয়বর বলেন, ‘হঠাৎ বন্যা আসায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। আমার পরিবারের অধিকাংশ সদস্য চর্মরোগে আক্রান্ত হয়েছে। নদীর পাশাপাশি বাড়ি হওয়ায় ভাঙন আতঙ্কে রয়েছি।’ পার্শ্ববর্তী বাহাদুরপাড়ার বাসিন্দা মোফা মিয়া বলেন, ‘গত বছর নদীভাঙনে বাড়ি সরিয়ে নিয়েছি। এবারও ভাঙন শুরু হয়েছে। হয়তো আবার বাড়ি সরিয়ে নিতে হবে।’ একই রকম মন্তব্য করেন ওই এলাকার প্রায় অর্ধশত পরিবারের লোকজন। সবার দাবি, বন্যার সময় ত্রাণ বা অর্থ সহায়তা না দিয়ে নদীতে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ বা খননের মাধ্যমে স্থায়ী সমাধানের।

গবেষণায় দেখা গেছে, ৩০ বছরে মূল প্রবাহ থেকে ৩ থেকে ৪ কিলোমিটার পর্যন্ত সরে গেছে তিস্তা। একই সঙ্গে একাধিক চ্যানেল থাকায় দ্রুত পরিবর্তন আসছে তিস্তায়। বর্তমানে ডান দিকে সরে গেলেও ২০২৪ থেকে পুনরায় বাঁ দিকে সরে আসবে এই নদী। একই সঙ্গে পানির ধারণক্ষমতা কমে যাওয়ায় বাড়বে বন্যার ক্ষয়ক্ষতি। সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে জানা গেছে, তিস্তার মূল প্রবাহ ছিল একটি। কিন্তু বছর দুয়েক আগে ৩ কিলোমিটারের মতো দূরে সরে যায় এ প্রবাহ। এবার যখন পানি বাড়তে শুরু করেছে, তখন আবার তা ফিরে এসেছে পুরনো চ্যানেলে। আগে থেকে নেওয়া এখানকার যে প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ছিল, সেগুলো ভাসিয়ে নিয়ে তিস্তা এখন ছুটছে ভাটির দিকে। প্রতি বছর বন্যা এলেই অন্য রকম আতঙ্ক ভর করে তিস্তাপাড়ের লাখো বাসিন্দার মনে। দীর্ঘ সময় পরিচর্যা না করায় শুধু ভরাটই হয়নি, গতিপথও পরিবর্তন করেছে তিস্তা। ফলে তীরবর্তী পাঁচ জেলায় বছরে ক্ষতির পরিমাণ ৫০ হাজার কোটি টাকারও বেশি। মহিষখোঁচা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মোসাদ্দেক হোসেন চৌধুরী বলেন, নদীর গভীরতা কম থাকায় অল্প পানিতেই ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল ও লোকালয়ে পানি ঢুকে বন্যার পর নানা দুর্ভোগের সৃষ্টি করে। এ ছাড়া পানি কমলে তো ভাঙন চলেই। ফলে বসতভিটা ও ঘরবাড়ি হারিয়ে প্রতি বছর ভূমিহীনের সংখ্যা বাড়ছে। এসব ঠেকাতে স্থায়ী সমাধানের দাবি এই জনপ্রতিনিধির। ‘তিস্তা বাঁচাও নদী বাঁচাও’ সংগ্রাম পরিষদের লালমনিরহাট জেলা সভাপতি গেরিলা লিডার ও বীর মুক্তিযোদ্ধা শফিকুল ইসলাম কানু বলেন, তিস্তা দ্রুত খনন বা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে। অন্যথায় ক্ষতির পরিমাণ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাড়বে। প্রতি বছর ভূমিহীন ও গৃহহীনের সংখ্যা বাড়বে। প্রয়োজনে নিজস্ব অর্থায়নে মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে। লালমনিরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সুনীল কুমার বলেন, তিস্তার গভীরতা কমে এসেছে। ফলে অল্প পানিতে বন্যার সৃষ্টি হয়। পানি নেমে গেলে দেখা দেয় নদীভাঙন। সরকার স্থায়ীভাবে এ সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড ডালিয়া ডিভিশনের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আসফাউদদৌলা বলেন, ‘নদীর গভীরতা কমায় পানিপ্রবাহ দ্রুতই বিপৎসীমার কাছাকাছি চলে আসে। পলি অপসারণ করে রিজার্ভার নির্মাণের একটা প্রকল্প স্টাডি শেষের পর্যায়ে। এর প্রতিবেদন পেলে আমরা ডিপিপি সাবমিট করব। এটা অনুমোদন হলে আমরা কাজ করতে পারব।’ তিস্তাপাড়ের বাসিন্দা, সচেতন মহলের লোকজন ও তিস্তা নিয়ে আন্দোলনকারীরা বলছেন, নিজস্ব অর্থায়নে হলেও তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা না গেলে অর্থনৈতিক ক্ষতির পাশাপাশি পরিবেশ-প্রতিবেশসহ হুমকিতে পড়বে জীববৈচিত্র্য। তাই দ্রুতই নদী খনন বা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের দাবি তাদের।

 

বিডি প্রতিদিন/ ওয়াসিফ

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর