২১ অক্টোবর, ২০২৩ ১৬:০৬

হারিয়ে যাচ্ছে পালতোলা নৌকা

আবদুর রহমান টুলু, বগুড়া:

হারিয়ে যাচ্ছে পালতোলা নৌকা

নদী মাতৃক বাংলাদেশে একসময় নদীগুলোতে চলতো পালতোলা নৌকা। আগের যুগে মানুষের চলার পথের একমাত্র বাহন ছিল নৌকা। পালতোলা নৌকা দিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্যসহ নদী পথে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় চলাচল করতো প্রাচীন কালের মানুষরা। কোন ইঞ্জিন ছাড়াই বাতাসের সাহায্যে চলতো এসব নৌকা। কালক্রমে আধুনিকতার ছোঁয়ায় ও নদীর নাব্যতা না থাকায় কমতে থাকে নৌকার কদর। ধীরে ধীরে ইঞ্জিনচালিত যানবাহন চালু হওয়ায় নদীতে আর পালতোলা নৌকার দেখা মিলছে না। প্রায় বিলুপ্তির পথে পালতোলা নৌকা। 

জানা যায়, যমুনা, বাঙালি, করতোয়া এবং সুখদহ নদীবেষ্টিত বগুড়ার বিভিন্ন বন্দরে আগে ভিড়ত নানা ধরনের পালতোলা নৌকা। তখন এসব এলাকায় ব্যবসা বানিজ্যের অন্যতম বাহন ছিল পালতোলা নৌকা। নদীতে রঙ-বেরঙ এর নৌকা চলাচল করতো। নৌকাগুলো নোঙ্গর ফেলতে ঘাটে ঘাটে। পালতোলা নৌকাগুলোর মধ্যে ছিল ছিপ, বজরা, ময়ূরপঙ্খী, গয়না, পানসি, চরঙ্গা, কোষা, পাথাম, বাচারি, ঘাসি, সাম্পান, ফেটি, নায়রি, গস্তি, সওদাগরি, ইলশা, কেড়াই নৌকা, সাপুরিয়া বা বেদে নাও, বৌচোর, লক্ষী বিলাস, গন্ডী বিলাস, খেয়া, বাইচের নাও বা দৌড়ের নাও ও ডিঙিসহ নানা রকমারি নৌকা। 
এসব নৌকাগুলো যখন পাল তুলে চলাচল করতো তখন মনে হতো কোথা হতে একঝাঁক রঙিন বকের সারি নদীর মাঝপথ বরাবর উড়ে যাচ্ছে। সাধারণ পালতোলা নৌকাকে বগুড়া এলাকায় বাদাম তোলা নৌকাও বলা হতো। হাজারীপাল, বিড়ালীপাল, বাদুরপাল ইত্যাদি পালের ব্যবহার ছিল নৌকাগুলোতে। প্রমোদ ভ্রমণে ময়ূরপঙ্খী, পানসি ও মধ্যবিত্তদের বজরা, সওদাগরি নৌকা ব্যবহৃত হতো। কৃষকরা গস্তি ও ডিঙি আর নিম্নবিত্তরা ঘাটে গয়না ও কোষা নৌকা ব্যবহার করতেন। তখনকার দিনে মাঝি-মাল্লাদের ছিল বিশাল কদর। 

যন্ত্রের যুগে কালের আবর্তনে এসব গল্পগুলো এখন শুধুই স্মৃতি। এখন তেল কিনে মানুষ ইঞ্জিন চালাচ্ছে আর এর কালো ধোঁয়া দিয়ে নষ্ট করছে পরিবেশ। তাইতো এখন আর নাও ছাড়িয়া দে, পাল উড়াইয়া দে পালা গানগুলো আর ঘাটের পাড়ে শোনা যায় না। যা শুনে এর মর্ম বুঝে উঠতে পারে না বর্তমান প্রজন্ম।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, সিন্দু সভ্যতার বিভিন্ন এলাকা থেকে নানা রকমের নৌকার অস্থিত্বের কথা। এখন থেকে প্রায় সাড়ে ৫ হাজার বছর আগে ভূ-মধ্য সাগরে বহু দাঁড় বিশিষ্ট নৌকার দেখা মিলতো। নৌকায় দাঁড় (রশ্মি) টানার কাজে ব্যবহার করা হত কৃতদাসদের। দাঁড় টেনে নৌকা বাওয়া অত্যন্ত শ্রমসাধ্য ও ক্লান্তিকর। পালের উদ্ধাবন এ অবস্থা থেকে মানুষকে খানিকটা মুক্তি দিয়েছে। দাঁড় টানার সঙ্গে পাল টানানো হলে নৌকার গতি বেড়ে যেত। সেই সাথে হাওয়ার গতিতে নৌকা আরও বেশি বেগমান হতো। তখন থেকেই নানা ধরনের পালের ব্যবহার শুরু হয় বাতাসের শক্তি কাজে লাগানোর জন্য। বাতাসচালিত কার্গোজাহাজ উনিশ শতকে সমুদ্র দখল করে রেখেছিল। এরপরে বাস্পচালিত ইঞ্জিনের কারণে হারিয়ে যায় বায়ুচালিত নৌকা। পরে কয়লাচালিত ইঞ্জিন পুরো নদী সাগর-মহাসাগর দখল করে নেয়। 

তবে বগুড়ায় এখনও যমুনা নদীতে সকালে দেখা যায় পালতোলা নৌকার। যখন নদী পথে নৌকাগুলো যায় তখন অপরুপ সৌন্দের্য্যরে দৃশ্য ফুটে উঠে। মনে পড়ে যায় পুরনো দিনের কথা। 

যমুনা পাড়ের পালতোলা নৌকার মাঝি সারিয়াকান্দি এলাকার সিরাজুল ইসলাম জানান, তেলের দামের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে না পেরে তিনি পাল তোলা নৌকার ব্যবহার পুনরায় শুরু করেছেন। যমুনা চরে মরিচ, স্থানীয় জাতের গাইঞ্জা ধান এবং মাসকলাই এর আবাদ আছে নানা কৃষকের। নদী ভাঙনের শিকার হয়ে তারা যমুনার ডানতীরে বিভিন্ন চরে নতুন বসতি গড়ে তুলেছেন। ফসলের যত্ন করতেই তারা পালতোলা নৌকায় প্রতিদিন যমুনা নদী পাড়ি দেন। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে নৌকার এই মাঝি গরুর গাড়ির গাড়িয়াল ছিলেন। 

সারিয়াকান্দি গনকপাড়া গ্রামের বাসিন্দা মো. খোরশেদ আলম জানান, সাারিয়াকান্দি যমুনা নদীতে একসময় পালতোলা সারি সারি নৌকা আমরা দেখেছি। সেই পালতোলা নৌকা হারিয়ে যেতে বসেছে। মাঝে মধ্যে এখন সারিয়াকান্দি যমুনা ও বাঙালি নদীতে দেখা মিলছে পালতোলা নৌকার।

বিডি প্রতিদিন/এএম

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর