বগুড়ার সারিয়াকান্দি যমুনা নদীর ধুধু বালু চরে বিশাল এলাকায় গড়ে উঠেছে মহিষের বাথান। চরের তৃণভূমিতে রাখালেরা খোলা আকাশের নিচে মহিষগুলোকে সবুজ ঘাস খাওয়াচ্ছেন। জেগে ওঠা চরে মহিষ পালন করে ফিরেছে তাদের সচ্ছলতা। নতুন করে তারা স্বপ্ন দেখছেন।
জানা যায়, যমুনার বুকে জেগে ওঠা চরগুলোয় মহিষ রাখার জন্য গড়ে উঠেছে অসংখ্য ছোট বড় বাথান। এসব বাথানে ৫০ থেকে ১০০টি করে মহিষ রয়েছে। আর এসব মহিষ ও দুধ বিক্রি করেই ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াচ্ছেন তারা। চরে রাখালদের থাকার তেমন ভালো ব্যবস্থা নেই। মহিষের বাথানের পাশেই নদীঘেঁষা বালু চরে চাষি ও রাখালেরা কয়েকটি ঝুপড়ি ঘর তুলেছেন। মহিষ পালনকে ঘিরেই চলছে তাদের জীবন-জীবিকা। বাথানগুলোর এক প্রান্তে নদী রয়েছে, যা থেকে খামারিরা জন্য মহিষগুলোর পানি পান করা ছাড়াও গোসল করানোর সুবিধা পাচ্ছে। কাক ডাকা ভোর থেকে শুরু হয় মহিষ ও রাখালদের কর্মযজ্ঞ। মহিষের দুধ দোহন করা, নৌকায় করে গ্রাহকদের কাছে দুধ পাঠানো, দুপুর পর্যন্ত মহিষগুলোকে মাঠে চড়ানো। রোদ-বৃষ্টি উপেক্ষা করেই চলছে এসব। এ যেন প্রাকৃতিক শিল্প প্রতিষ্ঠান। জেলার সারিয়াকান্দি, সোনাতলা ও ধুনটের বিভিন্ন চরাঞ্চলে মহিষের বাথান নিয়ে অবস্থান করছে রাখাল ও মালিকেরা। তাদের বাথানে বিভিন্ন প্রজাতির মহিষ ছাড়াও গরুর বিভিন্ন জাত রয়েছে।
কাজলা ইউনিয়নের চরঘাগুয়া এলাকার খামারি ফজলার রহমান জানান, চরে বেশ কয়েকজন বানভাসি মহিষের বাথান গড়ে তুলেছেন। সব বাথানই মূলত দুগ্ধখামার। তার বাথানের ৩০টি দুধেল মহিষ ও ২৫টি বাছুর রয়েছে। প্রতিদিন তিনি ১৪০ লিটারের মতো দুধ সংগ্রহ করেন। বগুড়া-জামালপুর থেকে পাইকাররা বাথানে এসে দুধ কিনে নিয়ে যায়। তিনি আরও জানান, বন্যা ও নদী ভাঙনের সঙ্গে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকা চরবাসীর অর্থনৈতিক চিত্র পাল্টে দিয়েছে এ মহিষের খামার। এর মাধ্যমেই দৈন্য ঘুঁচে তাদের জীবনে ফিরেছে সচ্ছলতা। এছাড়াও এই এলাকা থেকে প্রতিদিন গড়ে ৬০০ থেকে ৭০০ লিটার দুধ সংগ্রহ হয়। চরে গজিয়ে ওঠা সবুজ ঘাস দিয়ে মহিষ ও গরুর খাদ্যের জোগান দিচ্ছেন রাখাল, দুগ্ধ ব্যবসায়ী ও ঘোষালরা।বগুড়ার গাবতলীর কালাইহাটা গ্রাম থেকে আসা মহিষের মালিক আয়নুল হক জানান, ৮ থেকে ৯ জন খামারির মহিষ একত্রিত করে বাথান করা হয়েছে। আমাদের এলাকায় ঘাস কম থাকায় এখানে এসেছি। এই বাথানে আমার আড়াইশ’ মহিষ রয়েছে। বছরের আট মাসই মহিষের সাথে যমুনার চরে কাটাই। এখানে নদী কাছে হওয়ায় এবং সবুজ ঘাস বেশি হওয়ার কারণে খামার পরিচালনা করতে খুব সহজলভ্য হচ্ছে।
তিনি আরও জানান, এখানকার লোকজন অনেক ভালো। আমাদের খুবই সাহায্য সহযোগিতা করছে। প্রতি বছর এই সময়ে আমরা এখানে গরু ও মহিষ নিয়ে আসি। ভবিষ্যতেও আসব।
বাথানের রাখাল আব্দুস সাত্তার জানান, একটি মহিষ সকাল ও দুপুরে ৭ থেকে ১০ কেজি পর্যন্ত দুধ দেয়। প্রতি কেজি দুধ ৫০ থেকে ৫৫ টাকায় বিক্রি করা হয়। বিভিন্ন স্থানের ঘোষ ও মিল্কভিটার লোকজন নৌকায় এসে এসব দুধ নিয়ে যায়।
কাজলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এস এম রফিকুল ইসলাম জানান, প্রতি বছরই যমুনার বুকে জেগে ওঠা চরাঞ্চলে সবুজ ঘাস খাওয়ানোর জন্য পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন জেলা থেকে শত শত মহিষ নিয়ে আসেন খামারিরা। চরের তৃণভূমিতে অস্থায়ী ঝাপুড়িঘর তুলে খোলা আকাশের নিচে চলে এই মহিষের লালন পালন। চারপাশে যমুনা নদীর অসংখ্য ক্যানেল আর সবুজ ঘাস থাকার কারণে খামার পরিচালনা সহজলভ্য হচ্ছে। তিনি আরও জানান, ভাঙন কবলিত এ ইউনিয়নে ২০ হাজার মানুষের বসবাস। এদের বেশির ভাগই চরবাসী ও দরিদ্র। মহিষ পালনের মাধ্যমে তাদের অনেকেরই দিন ফিরেছে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে চরের অর্থনীতিই পাল্টে দিতে পারে এ খামারগুলো।
জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তারা জানান, প্রতি বছরই বগুড়ার যমুনার চরে গজিয়ে ওঠা সবুজ ঘাস খাওয়ানোর জন্য পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন জেলা থেকে বাথানিরা গবাদিপশু নিয়ে আসেন। বর্ষা মৌসুমে চরগুলোতে পানি ওঠার আগেই তারা আবার নিজ নিজ এলাকায় ফিরে যায়। চরাঞ্চলে শত শত মহিষ লালন-পালন হচ্ছে। এতে করে অনেকেই আর্থিকভাবে লাভবান হয়েছেন। জেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয় থেকে তাদের বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করা হচ্ছে।
বিডি প্রতিদিন/নাজমুল