ফেনীর ছাগলনাইয়ায় বালুর সাম্রাজ্য গুঁড়িয়ে দিয়েছে পুলিশ। শুভপুর, জগন্নাথ, সোনাপুরে অভিযানে ৫০ কোটি টাকা মূল্যের বালু জব্দ করেছে প্রশাসন। আটক করা হয়েছে দুজনকে। পুলিশ জানিয়েছে, ফেনী-১ আসনের সংসদ সদস্য আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিমের নির্দেশে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় বালু সাম্রাজ্য। বালু নিয়ে নৈরাজ্য নির্মূল না হওয়া পর্যন্ত অভিযান অব্যাহত থাকবে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বালু সাম্রাজ্য ঘিরেই ফেনীর সর্বনাশ হয়েছে। ছাগলনাইয়ায় এ সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণের নেপথ্যে ঘটেছে যতসব ভয়ংকর ঘটনা।
জানা গেছে, ছাগলনাইয়া উপজেলাসহ জেলার বিভিন্ন স্থানে ক্ষমতাসীন দলের কিছু নেতা দীর্ঘদিন ধরে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করে আসছেন। এতে ফসলি জমি, সাধারণ মানুষের বাড়িঘর নদীগর্ভে বিলীন হওয়া ছাড়াও কৃষিজমির সেচ প্রকল্প ধ্বংস হওয়ার শত শত অভিযোগ পাওয়া গেছে। অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলনের ফলে এসব নদীর দিক পরিবর্তন ছাড়াও নদী হয়ে গেছে অনেক প্রশস্ত।
নদীপারের অসহায় মানুষদের প্রতিবাদের মুখে এবং আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিম এমপির প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে ১৩ ফেব্রুয়ারি ছাগলনাইয়ায় বালু উত্তোলন বন্ধ করে দেয় স্থানীয় প্রশাসন। তার পরই বালুমহালগুলো নিয়ে শুরু হয় চোর-পুলিশ খেলা। প্রভাবশালীরা পুলিশ ও প্রশাসন ম্যানেজ করতে কোটি টাকা বাজেট নিয়ে নেমেও ব্যর্থ হন বলে একাধিক সূত্রে জানা যায়। এদিকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের বিরুদ্ধে পানি উন্নয়ন বোর্ডÑপাউবোর করা মামলায় গ্রেফতার চলছে। অব্যাহত আছে অভিযান। ১৭ মার্চ পুলিশ গ্রেফতার করে ইজারাদার রৌশনারা এন্টারপ্রাইজের ম্যানেজার ও ঘোপাল ইউনিয়ন পরিষদের ১ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মোশাররফ হোসেনকে। মোশাররফ একসময় ইউনিয়ন বিএনপির সহসভাপতি ছিলেন। এখন তিনি ঘোপাল ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের অন্যতম নেতা। তার গ্রেফতারের পর নদীপারের মানুষের মধ্যে স্বস্তি নেমে আসে। এর আগে ঘোপাল ইউনিয়নে একরাম নামে আরেকজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ।শুধু দুর্বৃত্ত দমন অভিযানে ব্যস্ত থাকেনি প্রশাসন; অবৈধ বালু জব্দ করতেও শুরু করে। ২০ মার্চ বুধবার অবৈধভাবে উত্তোলনকারী মেজবা ও সাদ্দাম হোসেনের দুটি বালুর স্তুপ জব্দ করে প্রশাসন। ছাগলনাইয়া থানার অফিসার ইনচার্জ হাসান ইমাম বলেন, ‘পাউবোর মামলায় জড়িতদের গ্রেফতারে পুলিশ মাঠে রয়েছে। ইতোমধ্যে কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। দুটি বালুর স্ত‚প জব্দ করা হয়েছে। অভিযান অব্যাহত থাকবে।’
জানা যায়, এমপি আলাউদ্দিন চৌধুরী নাসিম নির্বাচনের আগে বিভিন্ন সভায় বারবার বলেছিলেন, ফেনী নদী থেকে তিনি এক টাকাও নেবেন না। কাউকে অবৈধভাবে এক টাকা নিতে দেবেনও না। তাঁর কথায় নদীপারের মানুষ ভরসা পায়। তিনি এমপি হওয়ার পর একদা ভয় পাওয়া নদীপারের অসহায় মানুষ দিনে দিনে প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। তারা শুরু করে প্রতিবাদ, মানববন্ধন।
ক্ষয়ক্ষতি :
কোনো স্থাপনার পাশ থেকে বালু উত্তোলন নিষিদ্ধ হলেও ছাগলনাইয়া উপজেলার শুভপুরে সেতুর পাশ থেকে অবাধে তোলা হচ্ছিল বালু। মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত শুভপুর ব্রিজসংলগ্ন এলাকা থেকে বালু উত্তোলনের ফলে ব্রিজের নিচ থেকে বালু সরে অনেক আগেই ব্রিজটি হুমকির মুখে পড়েছে। একই উপজেলার লাঙ্গলমোড়ায় ছোট ফেনী নদীতে ইজারা না থাকলেও বাংলা ড্রেজার মেশিনের মাধ্যমে দিনে রাতে একাধিক সিন্ডিকেট তুলছে বালু। এভাবে জেলার মুহুরী, কহুয়া, সিলোনিয়া, ছোট ফেনীসহ পাঁচটি নদীর একাধিক স্থানে অবাধে চলছে বালু উত্তোলন। এতে স্থানীয়রা হারাচ্ছে ভিটেমাটি, ফসলি জমিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। আর নতুন পদ্ধতিতে নদীর মধ্যেই ট্রলারে ড্রেজার মেশিন বসিয়ে বালু উত্তোলন চললেও চক্রটি রয়েছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। স্থানীয়দের অভিযোগ, প্রশাসনে একাধিকবার অভিযোগ দিলেও উল্টো মামলা-হামলার ভয় দেখিয়ে তাদের নানাভাবে হয়রানি করছে বালুদস্যুরা।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ফেনী জেলার অর্ধশতাধিক জায়গায় অবৈধভাবে বালু উত্তোলন চলছে। ছাগলনাইয়া, ফুলগাজী, সোনাগাজী, সদর উপজেলার ছোট ছোট নদী থেকেও দেদার বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। দৈনিক শত শত পিকআপ দিয়ে বিভিন্ন নদী থেকে অবৈধভাবে বালু তোলা হচ্ছে।
ছাগলনাইয়া :
ছাগলনাইয়ার দুটি বালুমহালের ইজারাদার রৌশনারা এন্টারপ্রাইজ ও আম্মান এন্টারপ্রাইজ। প্রতিষ্ঠান দুটির স্বত্বাধিকারী স্থানীয় পাঠাননগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রফিকুল হায়দার চৌধুরী। ফেনী নদীর ছাগলনাইয়া অংশের শুভপুর-জগন্নাথ-সোনাপুর, শুভপুর ব্রিজ ও ঘোপালের ধুমঘাট এলাকায় গড়ে উঠেছে এ বালুমহাল। জানা যায়, সরকারি বিধিনিষেধ তোয়াক্কা না করে নদীর আশপাশের ফসলি জমি, বসতঘর, মসজিদ-মাদরাসা কিছু রাখেনি অবৈধ বালু কারবারিরা। সোনাপুর নদীর প্রশস্ততা বেড়ে গেছে অনেক। ভাঙতে শুরু করেছে নদীর পারের ফসলি জমি। জগন্নাথ-সোনাপুরে সরকারি আশ্রয় প্রকল্প ভেঙে পড়ার অবস্থা হয়েছে। ঘোপাল ও শুভপুরে তিন ফসলি উর্বর জমি বর্তমানে নদীগর্ভে। কমে গেছে ছাগলনাইয়ার আয়তন। জেলার মুহুরী সেচ প্রকল্পের আওতায় থাকা ছাগলনাইয়ার শুভপুর ইউনিয়নের তুলাতলির চর এলাকায় বালু উত্তোলনের ফলে সেচ স্কিমের ক্ষতি হয়। ঘোপাল ইউনিয়নের লাঙ্গলমোড়ায় স্কিম ম্যানেজার গিয়াসউদ্দিনের এরিয়ার ৭০০ মিটার পাইপলাইন দিয়ে বালু উত্তোলনের ফলে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এ ছাড়া ঘোপাল ইউনিয়নের নিজকুঞ্জরায় বালু উত্তোলনের ফলে কৃষি, সেচ প্রকল্পের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। সংলগ্ন আবাদি জমিতে বালুখেকোরা পানি দিতেও দিচ্ছে না বলে জানা যায়। স্থানীয়রা তাদের বিরুদ্ধে কয়েকবার মানববন্ধন করেছেন। কিন্তু বালু উত্তোলনকারীদের হুমকিধমকিতে তারা টিকতে পারেননি। ফেনী নদীতে অবৈধ বালু উত্তোলনের ফলে সাম্প্রতিক সময়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে শুভপুর ইউনিয়নের জয়পুর তুলাতলি চর ও ঘোপাল ইউনিয়নের নিজকুঞ্জরা। এতে কৃষিজমির ক্ষতি ও নদীর গতিপথও পরিবর্তন হয়ে গেছে। নিজকুঞ্জরায় বালু উত্তোলনের ফলে সেচ প্রকল্পের পাইপসহ প্রকল্পের ব্যাপক ক্ষতি হয়। প্রকল্পকর্তাদের হুমকিধমকি দেওয়া হয়। পরে বাধ্য হয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপসহকারী প্রকৌশলী মো. আবু মুসা রকি ছাগলনাইয়া থানায় মামলা করেন বালু উত্তোলনকারীদের বিরুদ্ধে। তিনি জানান, ফেনীর মুহুরী সেচ প্রকল্পে সেচ ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়ন প্রকল্পের আওতায় ছাগলনাইয়ার বিভিন্ন ইউনিয়নে সেচ ব্যবস্থাপনা আধুনিকায়নের কাজ চলমান রয়েছে। এতে সেচ প্রকল্পের লাখ লাখ টাকা ক্ষতি হয়েছে।
ছাগলনাইয়ার শুভপুর ইউনিয়নের নতুন বাজার এলাকায় ২০২২ সালের ১৪ অক্টোবর বালুর গাড়িতে মাল লোড-আনলোডের আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে জামশেদ আলম নামে একজনকে কুপিয়ে হত্যা করেছে প্রতিপক্ষ।
অন্যান্য নদী থেকেও বালু উত্তোলন :
সোনাগাজী উপজেলায় দুটি বালুমহালের ইজারাদার ফেনী সদর উপজেলার ফাজিলপুর ইউপি চেয়ারম্যান মজিবুল হক রিপন। তার মধ্যে একটি মুহুরী রেগুলেটর সংলগ্ন থাকখোয়াজ লামছি এলাকায়। অন্যটি ছোট ফেনী নদীর চরদরবেশের নতুন ব্রিজসংলগ্ন এলাকায়। পরশুরামের ইজারাদার শাপলা ট্রেডার্স। প্রতিষ্ঠানের মালিক মিরু চৌধুরী। বাকি তিনটি বালুমহাল পরিকল্পিতভাবে ইজারা নেওয়া হয় না বলে জানা যায়। ইজারা না নিয়েই ফেনীর সবচেয়ে বড় একটি মহালসহ বাকি মহালগুলোর বালু অবৈধভাবে উত্তোলন করা হয়। সরেজমিনে জানা যায়, জেলার পাঁচ বালুমহাল ইজারা দেওয়া হলেও প্রভাবশালীরা সম্পূর্ণ অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করছেন পুরো নদী থেকে। ইজারাদার ছাড়াও রাজনৈতিক প্রভাবশালীরাও জেলার অন্তত ৫০টি স্থান থেকে বালু উত্তোলন করছেন।
এ বালু উত্তোলন কেন্দ্র করে মুহুরী নদীর আমিরাবাদ অংশের কলমিচরে মজিবুল হক রিপনের লোকজনের সঙ্গে বারইয়ারহাট পৌর মেয়রের গোলাগুলি ঘটেছিল। পৌর মেয়রসহ তিনজন গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন। গোলাগুলির ঘটনায় সোনাগাজী মডেল থানায় দুই পক্ষে পাল্টাপাল্টি মামলাও হয়। পরে আপস-মীমাংসার মাধ্যমে মামলা প্রত্যাহার হয়।
ছোট ফেনী নদীর সোনাগাজীর চরদরবেশের মুহুরী প্রজেক্ট সংলগ্ন নতুন ব্রিজ ও চরমজলিশপুর ইউনিয়নের চান্দলা মন্দিরের পাশের এলাকায় অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করছে অসাধুরা। ব্রিজের কাছাকাছি স্থান থেকে বালু উত্তোলনের ফলে ব্রিজগুলো হুমকির মুখে রয়েছে। স্থানীয়রা বলছেন, বালু উত্তোলন বন্ধ না হলে যে কোনো সময় এসব ব্রিজ নদীগর্ভে বিলীন হওয়ার আশঙ্কা।
ছাগলনাইয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম কমল বলেন, বালুমহাল জব্দ করার তথ্য তাঁর জানা নেই।
পরশুরাম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আফরোজা হাবিব শাপলা জানান, পরশুরামের বাউরখুমা এলাকায় মুহুরী নদীতে সরকার ঘোষিত একটি বালুমহাল রয়েছে। এ ছাড়া অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের খোঁজে গেলে মুহুরী নদীর কাউতলা ও খোন্দকার এলাকায় গিয়ে কিছুদিন আগে ড্রেজার মেশিন জব্দ করা হয়েছে।
ফেনী সদর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) লিখন ভৌমিক জানান, ফেনী সদরে জেলা প্রশাসন একটি এলাকাকে বালুমহাল ঘোষণা করেছে। তবে এটি ইজারা দেওয়া হয়নি।
সোনাগাজী উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) অনিক চৌধুরী জানান, সোনাগাজীতে দুটি বালুমহাল রয়েছে। এ ছাড়া চরমজলিশপুর ইউনিয়নের চান্দলায় অবৈধ বালু উত্তোলনের খোঁজ পাওয়া গেছে। দোষীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ফেনীর জেলা প্রশাসক শাহীনা আক্তার বলেন, প্রশাসন জিরো টলারেন্স নীতি অবলম্বন করছে। ফেনীতে যেসব বালুমহাল ইজারা দেওয়া হয়েছে তার বাইরে যেসব স্থানে বালু উত্তোলন করা হয় সবই অবৈধ। অবৈধ বালু উত্তোলনকারীদের বিরুদ্ধে নেওয়া হবে কঠোর আইনি ব্যবস্থা। ইতোমধ্যে ছাগলনাইয়ায় বালু উত্তোলন বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে। সোনাগাজীসহ অন্যান্য স্থানেও যারা ইজারার সীমানার বাইরে বালু উত্তোলন করবেন তাদের ইজারা বাতিলসহ আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এ ব্যাপারে আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিম এমপি বলেন, অবৈধ বালু উত্তোলন পুরোপুরি বন্ধ করতে হবে। যারা অসহায় মানুষের ক্ষতি করেছে, যতটুকু ক্ষতি হয়েছে তা পূরণ করে দেবে। নদীর নাব্যের জন্য যতটুকু বালু উত্তোলন করা দরকার তার বাইরে করা যাবে না।
বিডি প্রতিদিন/হিমেল