৩ এপ্রিল, ২০২৪ ২০:২৬

অন্যকে বাঁচাতে গিয়ে নিজের জীবন বিসর্জন দেওয়া জোবায়ের বাস্তবতার প্রতীক!

সাইফুল মিলন, গাইবান্ধা

অন্যকে বাঁচাতে গিয়ে নিজের জীবন বিসর্জন দেওয়া জোবায়ের বাস্তবতার প্রতীক!

জোবায়ের রহমান জামিল (ফাইল ছবি)

স্বার্থপর এই পৃথিবীতে নিজেকে নিয়ে যখন সবাই ব্যস্ত। সেখানে জোবায়ের রহমান জামিল (১৮) একেবারেই ব্যতিক্রম। দ্বাদশ শ্রেনিতে পড়ুয়া জোবায়েরের নাম এখন সবার মুখে মুখে। জীবনের ঝুঁকি আছে জেনেও সন্তানসহ এক গৃহবধূকে বাঁচাতে গিয়ে ট্রেনের ধাক্কায় নিহত হন জোবায়েরসহ ওই নারী। তবে আহত হলেও প্রাণে বেচে গেছে দেড় বছরের শিশু সন্তানটি। এমন মর্মান্তিক মৃত্যু হলেও মানুষের প্রতি মানুষের সহমর্মিতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখে গেলেন এই তরুণ।

জোবায়েরের এমন সাহসিকতায় অসংখ মানুষ প্রশংসা করছেন। তার জীবনের বিনিময়ে শিশুকে বাঁচানোর বিষয়টি নিয়ে অনেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁকে মৃত্যুঞ্জয়ী আখ্যা দিয়েছেন। এরপর থেকে মানুষের মুখে মুখে এখন জোবায়েরই নাম।

কেউ লিখছেন, জোবায়েরের জন্য আমরা গর্বিত। আমরা আশান্বিত হতেই পারি, সমাজে এখনো জোবায়েরের মতো কিশোররা আছে, যারা নিজের সমূহ সর্বনাশ হতে পারে জেনেও মানুষের বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

কেউ বলছেন, অন্যকে বাঁচাতে গিয়ে নিজের জীবন বিসর্জন দেওয়া জোবায়ের বাস্তবতার প্রতীক।

জোবায়েরের এমন মৃত্যুতে স্বাভাবিকভাবেই তাঁর আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবসহ এলাকাবাসী শোকে কাতর। জেবায়েরের বাড়ি গাইবান্ধার সাঘাটা উপজেলার ভরতখালী গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশীসহ উপস্থিত সবার চোখে পানি। সবাই তাঁর বাবা-মাকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন।

জোবায়েরের মায়ের আহাজারিতে ভারী হয়ে উঠেছে চারপাশ। তিনি কাঁদতে কাঁদতে বলছেন, আমার কলিজার ধনকে এনে দাও। বাবারে, ক্যামনে করে একাই থাকবি তুই। আমাকে একা করে এভাবে চলে গেলি। এখন আমি কাক নিয়ে বেঁচে থাকব।

কাঁদতে কাঁদতে বাবা জাহিদুল ইসলাম বলেন, আগের দিন রাতে ছেলের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা হয়েছে। সেদিন আমাকে বলেছিল, ঈদে এবার আমাকে পাঞ্জাবি দেবে। আমি বলেছিলাম তুমি ছোট মানুষ টাকা কোথায় পাবে? বলেছিল, ওর মামা যে টাকা দেয়, সেই টাকা থেকে আমাকে একটা পাঞ্জাবি কিনে গিফট করবে। ছেলের আর বাড়ি ফেরা হলো না।

জানা গেছে, জাহিদুল ইসলামের দুই ছেলে-মেয়ে। বড় মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। জোবায়ের গাইবান্ধা শহরের এস কে এস স্কুল অ্যান্ড কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন।

ঘটনাটি ঘটছে গত সোমবার (১ এপ্রিল)। গাইবান্ধা শহরের মাস্টারপাড়া থেকে প্রাইভেট টিচারের কাছে পড়া শেষ করে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে মাঝিপাড়া মেসের দিকে যাচ্ছিলেন জোবায়ের। পথেই আদর্শ কলেজসংলগ্ন রেল লাইনে দেখতে পান এক নারী তার সন্তানকে নিয়ে ট্রেনের লাইনের উপর দাড়িয়ে আছেন। এ ঘটনা দেখে জোবায়ের ওই নারী ও শিশুকে বাঁচাতে যান। ট্রেনটি খুব কাছে চলে আসায় শিশুকে বাঁচাতে পারলেও জোবায়ের ও ওই নারী ট্রেনের ধাক্কায় ছিটকে পড়েন। তাদের উদ্ধার করে গাইবান্ধা জেনারেল হাসপাতালে নেওয়া হয় ও পরে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পথে জুবায়ের ও ওই নারী মারা যান।

নিহত ওই নারীর নাম রাজিয়া বেগম (২৩)। তিনি মাঝিপাড়া এলাকার আনোয়ার হোসেনের স্ত্রী।

আগামী জুনে এইচএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করার কথা ছিলো জোবায়েরের। সে গাইবান্ধা শহরের এসকেএস স্কুল এন্ড কলেজের দ্বাদশ শ্রেণীর শিক্ষার্থী। শহরের থানাপাড়া এলাকার আদিল ছাত্রাবাসে থেকে পড়াশুনা করতেন।

জোবায়েরের ভগ্নিপতি শাহজান আলী বলেন, ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন জোবায়ের। পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণীতে বৃত্তি পেয়েছিলেন, এসএসসিতে জিপিএ-৫। এসকেএস স্কুল অ্যান্ড কলেজের বিজ্ঞান বিভাগের ৭১ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে তার রোল ছিল ১৩। নবম শ্রেণী থেকেই বিনা বেতনে পড়ার সুযোগ পান তিনি।

জোবায়েরের শিক্ষক এবং প্রতিবেশীরা বলেন, ছোটবেলা থেকে নম্র-ভদ্র জোবায়ের খুবই মানবিক ছিলেন। মানুষের উপকারে এগিয়ে আসতেন।

প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয়রা জানান, গাইবান্ধা জেলা সদরের মাঝিপাড়ার আনোয়ার হোসনের সাথে গেল তিন বছর আগে মোবাইলে প্রেমের সম্পর্কে সুনামগঞ্জ থেকে গাইবান্ধায় এসে বিয়ে করেন রাজিয়া খাতুন। প্রেমের সম্পর্কে বিয়ে হওয়ায় রাজিয়ার বাড়ি থেকে কেউ গাইবান্ধায় আসতো না। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে তাকে নিয়মিত শারীরিক নির্যাতন করতো তার স্বামী আনোয়ার। এরই ধারাবাহিকতায় গত রবিবার তাকে শারীরিক নির্যাতন করে রাতভর দেড় বছরের শিশু সন্তানসহ ঘরে উঠতে দেয়নি স্বামী আনোয়ার।

ওই নারী সেদিন সকাল থেকে একাধিকবার ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। স্থানীয়রা তাকে কয়েকবার সেখান থেকে সরিয়ে দেয়। তারপরেও তিনি চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। পরে সকাল সাড়ে ১১টার দিকে লাইনে শিশুসহ ওই নারীকে রেল লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে পেয়ে তাদেরকে বাঁচানোর চেষ্টা করেন কলেজ ছাত্র জোবায়ের। লাইনে দাঁড়ানো অবস্থায় রাজিয়ার সঙ্গে তার ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে শিশুটিকে লাইনের পাশে ছুঁড়ে ফেলতে পারলেও এর মধ্যেই দোলচাঁপা ট্রেনের ধাক্কায় রেললাইন থেকে ছিটকে পড়েন দু'জনই।

স্থানীয়রা গুরুত্বর আহত অবস্থায় তাদের দুইজনসহ শিশুটিকে গাইবান্ধা জেলা সদর হাসপাতালে নিলে তাদের দু'জনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়ার পথে দু’জনার মৃত্যু হয়।

ঠিক কী কারণে রাজিয়া আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলেন তা জানতে আজ দুপুরে গাইবান্ধার মাঝিপাড়া গিয়ে দেখা যায়, বেঁচে যাওয়া শিশু আবিরকে নিয়ে বসে আছেন বাবা আনোয়ার হোসেন।

জানতে চাইলে আনোয়ারের বড় ভাইয়ের স্ত্রী মনি আক্তার বলেন, সোমবার রাতে স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া হয়েছিল রাজিয়ার। সেই রাগ থেকে রাত ১টার দিকে শিশুটিকে নিয়ে বাইরে যায় রাজিয়া। পরে আবার বাড়িতে ফিরে আসে। কিন্তু সকালে বের হয়ে ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দেওয়ার চেষ্টা করে।

গাইবান্ধার বোনারপাড়া রেলওয়ের ওসি মো. খাইরুল ইসলাম বলেন, সন্তানসহ গৃহবধূকে বাঁচাতে গিয়ে গতকাল সকালে কলেজশিক্ষার্থী জোবায়েরসহ দু'জনের মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনায় একটি অপমৃত্যু মামলা হয়েছে।

ময়নাতদন্তের পর জোবায়ের ও রাজিয়ার দাফন করা হয়েছে বলে জানায় পুলিশ ও পরিবারের সদস্যরা।

বিডি প্রতিদিন/ ওয়াসিফ

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর