২৭ এপ্রিল, ২০২৪ ২১:৪৭

তীব্র তাপদাহে শুকিয়ে গেছে খাবার পানির উৎস, নেই গোসল ও টয়লেটের পানিও

শেখ আহসানুল করিম, বাগেরহাট

তীব্র তাপদাহে শুকিয়ে গেছে খাবার পানির উৎস, নেই গোসল ও টয়লেটের পানিও

বাগেরহাটে মৌসুমী বৃষ্টি না হওয়ায় তীব্র তাপদাহে পুকুর-খাল, ডোবা-নালা শুকিয়ে যাওয়ায় খাবার পানির জন্য হাহাকার করছে উপকূলীয় শরণখোলা উপজেলার মানুষ। গোসল ও দৈনন্দিন কাজে ব্যবহারের পানিতো দূরের কথা, টয়লেটে ব্যবহারের পানি জোগাড় করতেও হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের।

উপজেলা সদর রায়েন্দা বাজার থেকে শুরু করে চারটি ইউনিয়নের পুকুরে বসানো পিএসএফগুলো (পন্ড স্যান্ড ফিল্টার) কোনো কাজে আসছে না। ফলে খাবার পানি সংগ্রহ করতে মাইলকে মাইল পথ পাড়ি দিতে হচ্ছে লোকজনকে। কোথাও খাবার পানির সন্ধান পেলে কলস, বালতি, হাঁড়ি-পাতিল, কন্টেইনার, বোতল নিয়ে সেখানে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে নারী-পুরুষ, শিশুরা। সচ্ছল পরিবারগুলো জারের পানি কিনে তাদের চাহিদা মেটাচ্ছে। কিন্তু গ্রামাঞ্চলের নিম্ন আয়ের পরিবারগুলো পড়েছে মহা বিপাকে। এই অবস্থায় পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রতিদিন শত শত রোগী আসছে সরকারি হাসপাতাল ও স্থানীয় ক্লিনিকগুলোতে।

সরেজমিন উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে এবং ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বলেশ্বর নদ তীরবর্তী এলাকার বাসিন্দাদের গোসল বা অন্যান্য কাজে ব্যহারের পানির সংকট কিছুটা কম হলেও খাবার পানির সংকট রয়েছে উপজেলার সর্বত্রই। এর মধ্যে খাবার ও নিত্যব্যবহার্য উভয় পানির সংকট ভয়াবহ অবস্থা ধারণ করেছে সুন্দরবন লাগোয়া সাউথখালী ইউনিয়নের বগী, তেড়বেকা, সোনাতলা, জলেরঘাট, শরণখোলা, খুড়িয়াখালী, চালিতাবুনিয়া, রায়েন্দা ইউনিয়নের দক্ষিণ রাজাপুর, উত্তর রাজাপুর, জীবদুয়ারি, মাছের খাল এবং ধানসাগর ইউনিয়নের পশ্চিম রাজাপুর, রতিয়া রাজাপুর গ্রাম ও ভোলার চরে।

উপজেলা জনস্বাস্থ্য অফিস বলছে, শরণখোলা লবণাক্ত বেষ্টিত এলাকা হওয়ায় সারাবছরই সুপেয় পানির সংকটে থাকে ২০ ভাগ মানুষ। আর শুষ্ক মৌসুমে খাবার এবং অন্যান্য কাজে ব্যবহারের পানি সংকটে থাকে ৭০ ভাগ মানুষ। এই উপজেলার অর্ধেকেরও বেশি মানুষকে পানির সমস্যা নিয়ে দুর্বিষহ জীবন কাটাতে হয় বছরের প্রায় ৬ মাস। উপজেলার চারটি ইউনিয়নে সরকারিভাবে ৫৫৮টি ও বিভিন্ন এনজিওর দেওয়া ৫০০টির পন্ড স্যান্ড ফিল্টার বা পিএসএফ রয়েছে। এর মধ্যে জনস্বাস্থ্য বিভাগের সোলার চালিত পিএসএফ রয়েছে ২২টি। এর মধ্যে ৭টির সোলার প্লেট, ব্যাটারি ও মোটর চুরি হওয়ায় তা কোনো কাজে আসছে না।

বিদ্যুতচালিত ন্যানো টেকনোলজি ফিল্টার রয়েছে ১৮টি। এর অর্ধেকেরই বিদ্যুৎ বিল বাকি থাকায় তাও বন্ধ রয়েছে। এ ছাড়া সরকারের দেওয়া বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের (রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং) জন্য তিন হাজার লিটার ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন ট্যাঙ্ক রয়েছে সাড়ে চার হাজার। বিভিন্ন এনজিওর রয়েছে আরও প্রায় দুই সহস্রাধিক ট্যাঙ্ক। কিন্তু বৃষ্টি না হওয়া ও তীব্র তাপদাহে পুকুর-খাল, ডোবা-নালা শুকিয়ে যাওয়ায় বর্তমানে তা কোনো কাজে আসছে না।

সুন্দরবন সংলগ্ন উত্তর রাজাপুর গ্রামের মজিবর শিকদার ও আলামীন ফরাজি জানান, তাদের বাড়ির পুকুরে এক ফোঁটাও পানি নেই। বৃষ্টি না হওয়া ও তীব্র তাপদাহে পুকুর শুকিয়ে মাটি ফেটে গেছে। গোসলের পানি দূরের কথা, পায়খানায় ব্যবহারের পানিও নেই। পুরুষরা দূরে কোথাও গিয়ে গোসল সারতে পারলেও বাড়ির মহিলারা পড়েছেন দুর্ভোগে। এমন পরিস্থিতি পুরো গ্রামজুড়েই বলে জানান এলাকার মানুষ।

রাজাপুর গ্রামের সাবেক ইউপি সদস্য মো. জাকির হোসেন খান জানান, তার গ্রামে কমপক্ষে দুই হাজার পরিবারের বসবাস। সাধারণ কোনো পুকুরে পানি নেই। খাল, ডোবানালাও শুকিয়ে গেছে। এসব পরিবারের মানুষ খাবার পানি দূরের কথা, পায়খানায় ব্যবহারের পানিও পাচ্ছে না। গ্রামের মানুষের গোসলের পানিও এখন কিনতে হচ্ছে। এই গ্রামের পাঁচ সহস্রাধিক পরিবারের সদস্যরা পানির জন্য হাহাকার করছে। ডায়রিয়াসহ পানিবাহিত নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে গ্রামের মানুষ।

শরণখোলা উপজেলা জনস্বাস্থ্য বিভাগের উপসহকারী প্রকৌশলী মেহেদী হাসান জানান, বর্তমানে পানির সংকটের স্থায়ী সমাধান করতে হলে উপজেলার চারটি ইউনিয়নে নতুন করে আরও ১০০ বড় পুকুর খনন করা প্রয়োজন। এসব পুকুরে বৃষ্টির পানি সংরক্ষিত থাকবে। এ ছাড়া ভরাট হয়ে যাওয়া সরকারি ও ব্যক্তি মালিকানাধীন পুকুরগুলো পুনঃখনন করে সেখানে পানির ফিল্টার স্থাপন এবং বন্ধ থাকার পিএসএফগুলো মেরামত করলে সংকট অনেকটা কমে আাসবে। এসব কাজের জন্য ব্যাপক অর্থেরও প্রয়োজন। এ ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন জানানো হবে।

শরণখোলা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক ডা. কেয়ামনিন জানান, বর্তমানে হাসপাতালে পানিবাহিত রোগীর সংখ্যাই বেশি। হাসপাতালের বহির্বিভাগ ও জরুরি বিভাগে ডায়রিয়া, টাইফয়েড ও চর্মরোগী মিলিয়ে প্রতিদিন দেড় থেকে দুইশ রোগী দেখতে হয়। যাদের অবস্থা খারাপ, তাদের ভর্তি করা হচ্ছে। আর স্বাভাবিক রোগীদের প্রাথমিক চিকিৎসা ও ব্যবস্থাপত্র দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্র এবং বেসরকারি ক্লিনিকগুলোতেও প্রতিদিন শত শত রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন বলে জানা গেছে।

বাগেরহাট-৪ (শরণখোলা-মোরেলগঞ্জ) আসনের সংসদ সদস্য এইচ এম বদিউজ্জামান সোহাগ জানান, তীব্র তাপদাহে শরণখোলা এলাকায় খাবার পানির সমস্যা সমাধানে জরুরি ভিত্তিতে মোবাইল ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট পাঠানোর জন্য জেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলীকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সুপেয় পানি সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য আমাদের রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং প্রকল্প চলমান রয়েছে। এ ছাড়া সারফেস ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট স্থাপন করে তা থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে পানি সরবরাহ করারও চেষ্টা চলছে। অন্যদিকে বৃষ্টির পানির আধার সৃষ্টির জন্য পর্যাপ্ত বড় পুকুর ও ভরাট খাল খননের পরিকল্পনাও গ্রহণ করা হয়েছে।

বিডি প্রতিদিন/এমআই

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর