শুক্রবার, ৩০ আগস্ট, ২০১৩ ০০:০০ টা

রক্তের টানে

মেজু আহমেদ খান

রক্তের টানে

লাঠিসোঁটা নিয়ে তুমুল বাড়াবাড়ি চলছে সামনে। তাই দেখে নীলের শরীরটা ছমছম করে উঠল। দৃশ্যটি দেখামাত্র সঙ্গে থাকা বউ-বাচ্চাসহ সে দাঁড়িয়ে গেল। নীলিমা তার স্ত্রী। সে বলছে চল নীল। আমাদের এই মারামারি দেখে লাভ নেই। চল এখান থেকে কেটে পড়ি। নীলিমা একটু দাঁড়াওনা, খানিকটা দেখে যাই। আমার রক্তের মাঝে কেমন যেন তরঙ্গায়িত ভাব চলে এসেছে। তুমি ছেলে-মেয়েকে নিয়ে ওখানে দাঁড়াও, আমি একটু সামনে যাই। মানুষের ভিড় ঠেলে নীল কিছুটা সামনে বাড়াল। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার; হাজার হাজার মানুষ বৃত্তাকারে দাঁড়িয়ে রক্তের হুলিখেলা দেখছে অথচ কেউ এগিয়ে যাচ্ছে না ওদের থামাতে। নীলিমা নীলের হাত ধরে পেছনে টানছে। কিন্তু নীলের শরীরে যেন এ মুহূর্তে বাঘের শক্তি। তাকে এক ইঞ্চিও হঠাতে পারছে না নীলিমা। সামনের ময়দানে দুদল লোক দেশীয় লাটিসোঁটা দিয়ে একদল অন্যদলের প্রতি চরম আক্রমণে। একদলের মাঝে সাত-আটজন লোক, ওরা সংখ্যালঘু। অন্য দলে ২০ থেকে ৩০ জন। সংখ্যালঘু দলের লোকজন ক্রমান্বয়ে মাটিতে গড়াগড়ি খেতে লাগল দেশীয় অস্ত্রের আঘাতে। দুজন যুবক কোনোমতে বিপক্ষের আক্রমণকে প্রতিহত করার চেষ্টা করছে। কিন্তু না, পেরে উঠছে না। নিজেকে প্রশ্ন করতে লাগল নীল। আমি তো বউ-বাচ্চাসহ আমার-প্রিয়জনদের খুঁজতে এসেছি। না জানি আর কদিন যাবে খুঁজতে। আবার খুঁজে পাব কী-না তারও গ্যারান্টি নেই। কিন্তু আমার রক্তে কেন আন্দোলনের ঝনঝনানি? নীলিমা বার বার এখান থেকে সরে আসতে নীলকে অনুরোধ করছে। নীল দয়া করে তুমি এখান থেকে চলে আস। প্লিজ নীল প্লিজ বলে সে কান্না জুড়ে দিল। নীলের বয়স ৩৫-৪০ হবে। এ মুহূর্তে তার শরীরের রক্ত তাকে জানান দিচ্ছে নীল তুমি একজন টগবগে যুবক। তোমার শরীরে বাঘের শক্তি এখন। হাজার হাজার লোক কেবল দাঁড়িয়ে থাকতে পারে কিন্তু তুমি তা পার না। ওই সংখ্যালঘুরা যদি তোমার কেউ হতো, তুমি কি এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে পারতে? নীল তার মনের সঙ্গে তর্কযুদ্ধে পেরে উঠছে না। সামনের ময়দানে যে দুজন যুবক প্রতিপক্ষের আক্রমণে নিজেদের বাঁচানোর চেষ্টা করছিল তারাও এখন আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ার জন্য অস্ত্র ছেড়ে ঘুরপাক খাচ্ছে, সেকেন্ড-মিনিটের ব্যবধানে ওরাও লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। নীল বিজিত দলের দিকে শাহাদাত আঙুল উঁচিয়ে হুঙ্কার ছেড়ে বলে উঠল, দাঁড়াও। এখনো একজন বাকি রয়েছে, বলেই দৌড়ে গিয়ে ময়দানের মাঝে লুটিয়ে পড়া একজনের পাশ থেকে একটা মজবুত লাঠি হাতে নিয়ে সে শুরু করল এলোপাতাড়ি আক্রমণ, পাগলা হাতির মতো ভয়ঙ্কর রূপে ওই বিজিত দলের ওপর। বিজয়ীরা কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই তাদের চার-পাঁচজনকে ধরাশায়ী করে দিল নীল। বাকিদের সঙ্গে বাঁধল তুমুল লড়াই। নীল যেন বাঘের শক্তিতে এখন বলীয়ান। আধাঘণ্টার বিরতিহীন লড়াইয়ে বাকি ২০-২৫ জন লোককে পিটিয়ে সে দুর্বল করে দিল। বাহাদুর নীল। ৮-১০ জন লোক যা পারেনি সে একা কিভাবে তা সম্ভব করতে সক্ষম হলো। পাকড়াও কর তাকে। নিমিষেই হাজার হাজার লোক তাকে নজরবন্দী করে ফেলল।

জিজ্ঞাসা করল, হে অচেনা বীর এই অঞ্চলের কোথাও তো আগে তোমাকে দেখিনি। কে তুমি? কী তোমার পরিচয়? আর এই সাজের মারে কেন তুমি লিপ্ত হলে? নীল বলল, আমার বাড়ি এই এলাকা থেকে পায়ে হেঁটে ১৫ দিনের রাস্তা। প্রায় হাজার মাইল দূরে। ওই এলাকার নাম নিশাপুর। আপনাদের এলাকায় আমার বাপ-দাদার ভিটেবাড়ি খুঁজতে এসেছিলাম আমার বউ-বাচ্চাসহ। কিন্তু ময়দানের ওই দৃশ্যটি দেখে কেন জানি নিজেকে শান্ত রাখতে পারিনি। তাই জড়িয়ে যাই এই সম্মুখযুদ্ধে। সমবেত জনতা বলল, তোমার বাপ-দাদার ভিটেমাটি কোথায়? নীল বলল দেখুন, সেটা আমার মনে নেই। কিন্তু বাবার নামটি রহিমউল্লাহ শুধু মনে আছে।

গ্রামের নামও মনে নেই। জেলার নামও মনে নেই। আবছা আবছা মনে পড়ে শুধু থানার নামটি বালাগঞ্জ। সেই ছোটবেলা আমার বয়স যখন সাত-আট বছর, তখন আমি কেন জানি রাগ করে বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়েছিলাম। শেষ পর্যন্ত ওই নিশাপুরে গিয়ে শ্রমিকের কাজ করে সেখানেই অবহেলিতভাবে বেড়ে উঠি। সেখানেই বিয়ে করি। বউ-বাচ্চাদের দেখিয়ে বলল এই আমার পরিবার-পরিজন। আজ ৪০ বছর পর হঠাৎ করে মা-বাবার কথা মনে পড়ল। আর তখনই বেরিয়ে পড়ি তাদের খোঁজ করতে। রাস্তায় রাস্তায় লোকজনকে জিজ্ঞাসা করে এ পর্যন্ত এসেছি। আমাকে দয়া করে আপনারা ক্ষমা করুন ঘটে যাওয়া ঘটনার জন্য। এ কথাগুলো সেখানে জখম অবস্থায় গড়াগড়ি খাওয়া রহিমউল্লাহ সাহেব শুনে বিস্মিত হন। সেই সঙ্গে নীলের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে নীলকে বললেন, আচ্ছা বাবা, তোমার নামটা কী? বলবে? আমার নাম নীল। অমনি রহিম সাহেব বন্যা বলে চিৎকার দিয়ে নীলকে বুকে জড়িয়ে ধরেন। এই দেখ তো আমাকে জিনিস কিনা? বলেই কান্নার মাতমে ভারি হয়ে ওঠে আকাশ-বাতাস। প্রিয়জন ফেরার আনন্দে সে মাতম। হতবাক হয়ে শুধু চেয়ে চেয়ে দেখছে হাজার হাজার জনতা।

 

 

সর্বশেষ খবর