শুক্রবার, ১১ অক্টোবর, ২০১৩ ০০:০০ টা

সোনালি পোকা

কিঙ্কর আহ্সান

সোনালি পোকা

ক.

বালকের মন ভালো নেই।

উঠোনে মাদুর পেতে বসে সকাল থেকে সে পড়েই যাচ্ছে, 'চতুর্ভুজের চার বাহু। চার বাহু...।' পড়ায় মন বসছে না।

বাড়ির রাজহাঁসগুলো ঘুরছে এদিক সেদিক। কখনো তারা বালকের একদম কাছাকাছি চলে আছে। গায়ে ঠোকর দেয়। একসময় তার মা এসে মাটির পাত্রে ভাঙা শামুক দিয়ে যায় রাজহাসগুলোর জন্যে। সকাল হয়েছে সেই কতক্ষণ। বালক বই বন্ধ করে। আজ আর পড়া হবে না। রোদের ছিটেফোঁটাও নেই কোথাও। আকাশ মেঘে ঢাকা। এই দিনের বেলায়ে ভর করেছে অন্ধকার।

ঝড় হবে। কঠিন ঝড়। এখন কালবৈশাখীর সময়। কদিন পর পরই ঝড় হয়। ঝড়ের পর শুরু হয় একটানা বৃষ্টি।

'লুডু খেলবি?' বালকের বড় বোন তার পাশে এসে দাঁড়িয়ে কথাটা বলে। তার হাতে চিতই পিঠা। সে আয়েশ করে খেতে খেতে বাইরের কালো আকাশ দেখতে থাকে।

'ধুর। এসব ফালতু খেলা। আমি লুডু টুডু খেলি না।' বলে বালক। একটু পরেই শুরু হয় ঝুম বৃষ্টি। এই ঝড়-বৃষ্টির ভেতর একটা সোনালি পোকা আটকা পড়ে ঘরে। সোনালি জরি যেন লেপে দেওয়া ওর শরীরজুড়ে। কি সুন্দর!

বালকের এসব দিকে খেয়াল নেই। সে দাঁড়িয়ে থাকে উঠোনের মাঝখানটায়। বৃষ্টির প্রবল ঝাপটা এসে লাগে গায়। ঝাপসা হয় চোখ। দারুণ গতিতে পড়ছে শিল। হাস মুরগিগুলো ঠাঁই নিয়েছে খোঁপে [হাঁস মুরগির থাকার ঘর]। ওদের খাবার ভাঙা শামুকের টুকরো আর বাসি গন্ধের নরম আশটেমাংস মাটির সঙ্গে মিশে ভিজে ভিজে কাদা হয়। বালক শিল কুড়োয়। মাঝে মাঝে লুকিয়ে মুখে পোরা হয় দু-এক টুকরো বরফ। কোৎ করে গিলে ফেলে সে। একেবারে আইসক্রিমের স্বাদ!

বড় বোনটার অবশ্য শিল নিয়ে কোনো আগ্রহ নেই। তার চোখ খুঁজছে আম। ঝড়ো হাওয়ায় গাছ থেকে পড়ে যাওয়া লিলিপুট আকারের টক আম। আম বাগানে গিয়ে ভেজা রঙিন ফ্রক পরে ছুটে ছুটে আম কুড়োয় বোনটা। আম কুড়োতে গেলে বড় বোনটার সঙ্গী হয় মুনি। পাশের বাড়ির মেয়ে। বড় ন্যাওটা তার। আজ মুনি নেই বলে আম কুড়ানোতে জুৎ পাওয়া যায় না।

বালক মুনির কথা জিজ্ঞেস করতেই খেপে গিয়ে বলে, 'মুখপুড়ীটার কথা বললে দেব বসিয়ে কিল পিঠে।'

বোনের কণ্ঠে অভিমান। তার কষ্টটা বোঝে বালক। আহারে!

বালকের সাথে আবার বনেনা মুনির। মুনিকে সে ডাকে 'ডাইনি বুড়ি'। বুড়িটা সারাদিন খেপায় ওকে।

ছোটবেলা থেকেই কোলে কোলে থাকার অভ্যেস বালকের। এর কোল ওর কোল হয়ে কত জায়গায় ঘুরেছে সে। কোলছাড়া হয়নি কখনও। ভূমি থেকে কিছুটা ওপরে থাকাই নিরাপদ মনে হয় তার। ডাইনির মত চোখ বড় বড় করে বলে, 'বুড়ো খোকা, কদ্দিন আর থাকবি কোলে কোলে। তুইতো দেখি

 

 

দুধের শিশুই রয়ে যাবি জীবনভর। '

শুনে বালকের কষ্ট হয়। দম বন্ধ হয়ে যেতে চায়। চোখের কোলে চিকচিক করে জল।

বুড়িটা খেপাবে বলে ওর সামনে কাঁদাও যায় না। বালকের খেলা নিয়েও বুড়িটার হাজারো অভিযোগ। কুতকুত [এক্কা দোক্কা], রান্নাবাটি, বউ ছি, ফুল টোক্কাটুক্কি এসব খেলতেই বেশি ভালো লাগে বালকের। কিন্তু বুড়ি মুনিটা বলে এসব নাকি মেয়েদের খেলা। ছেলেদের খেলা হলো চারা মারা, ছিপ দিয়ে পুঁটিমাছ তোলায় পাল্লা দেওয়া আর মার্বেল নিয়ে টইটই করে ঘুরে বেড়ানো।

মাঝে মাঝে খুব রাগ হয় বালকের। ভাবে দেবে আড়ি। চিরদিনের জন্য। হবে না কথা কখনো আর। কিন্তু মুনির সঙ্গে যে ওর ভাব জমানোর শখ। একদিন বুড়িটার রাগি মুখ না দেখলে কেমন কেমন জানি লাগে। তাছাড়া মুনি পছন্দ করে না বলে সে মেয়েদের খেলা, ফালতু খেলা বাদ দিয়েছে। কষ্ট হলেও অপছন্দের খেলা খেলে চেষ্টা করছে বড় হওয়ার।

মাঝে মাঝে বালক ম্যাচের খোসা জমায়। লাল, নীল হরেক রকমের ম্যাচ। কখনো বাজার থেকে নিয়ে আসা হয় ভুনভুনি [সুইট বল]। টিপু সুলতান আর ম্যাকগাইভারের ছবি সাঁটা এসবের প্যাকেটে। সব জমা মুনির জন্য। দিতে সাহস হয় না বালকের। যদি বকে এই ভয়ে।

আকাশে মেঘেরও অনেক ওপর দিয়ে ধোঁয়ার লেজ নিয়ে যখন রকেট যায় তখন বুড়িটাকে দেখাতে ইচ্ছে করে। দেখাতে ইচ্ছে করে এক ঠ্যাং এর গো বক কিংবা পুকুরে পোতা বাঁশের ওপর ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা কোন মাছরাঙাকে। হয়না কিছুই দেখানো। মুনির এত সময় কই! অল্প বয়সেই পুরো পৃথিবীর ভার যেন তুলে নিয়েছে সে মাথায়। সংসারে কতই না কাজ তার! যত্তসব। মেজাজটাই খারাপ হয়।

এত এত কাজ করার কি দরকার আছে বোঝেনা বালক। মুনিকে খুশি করার কতই না চেষ্টা তার। কিন্তু মুনি যেন পণ করেছে বালকের কোনো কিছুকেই ভালো বলবে না সে।

এইতো সেদিন একটা বুড়ো শালিক আটকা পড়েছিল বাড়িতে। ফুফুজান শালিকটার পা দড়ি দিয়ে বেঁধে ছেড়ে দিয়েছিল বালকের ঘরে। সারাদিন সেই শালিকটার সঙ্গে কথা হলো অনেক। শালিককে বালক বলল বুড়ির কথা। ভাবল এসবে খুশি হবে মুনি। কিন্তু হলো উল্টোটা।

শালিকটা দড়ি দিয়ে বাঁধা দেখে বুড়ির সেকি রাগ। রাগে ফুসতে ফুঁসতে বলল,'গাধা তুলে দেব একটা আছাড় তোকে। পাখি এইভাবে বেঁধে রাখতে হয়। নিষ্ঠুর কোথাকার।'

বকা শুনে চুপটি মেরে গিয়েছিল বালক। অভিমানে কিছুই খাওয়া হয়নি সারাদিন। বালকের এসবের পরেও মুনি বুড়িটাকে বড্ড ভালো লাগে। নুন দিয়ে যখন বুড়িটা জলপাই খায়, নরম তুলতুলে মুরগির ছানাকে আদর করে, প্রচণ্ড রোদে সূর্যের আলোর ছটার তলে দাঁড়িয়ে গুনগুন করে ছড়া আউড়ায় তখন মুগ্ধ হয় বালক। বালকের বুকের ভেতরটা ভালো লাগার ফড়িং হয়। লাফায় তিড়িং বিড়িং করে। একটু লজ্জা আর একটু ভালো লাগা ঘিরে ধরে তাকে। চোখ বুজে আসে বালকের। বুজে আসে অকালপক্ব চোখ...।

খ.

বৃষ্টির বেগ কমেছে অনেকখানি। শিলও পড়ছে না আর। সোনালি পোকাটির ডানা দুটো ভিজে একাকার। বাইরে বৃষ্টিতে ভিজে আবার মনে হয় আশ্রয় নিয়েছে এই পোকা ঘরেতে।

বালক ঘরে এসে পোকাটিকে হাতে তুলে নেয়। জোরে জোরে ফুঁ দিয়ে শুকোয় ডানা। তারপর বলে, 'উড়াল দিয়ে খবর নিয়ে আয়তো ডাইনি বুড়িটার। শুনেছি জ্বর অনেক। আমার হয়ে দেখে আয় না ওকে।'

পোকা কথা শোনে না। মুখ থুবড়ে পড়ে থাকে। বালকের ছোট্ট হাতের নরম মুঠোয়...।

 

 

সর্বশেষ খবর