শুক্রবার, ২৭ মার্চ, ২০১৫ ০০:০০ টা
বই পরিচিতি

সাড়ে তিন হাত ভূমি: উপন্যাসে একাত্তরের মানবিক বিপর্যয়

আহমাদ মাযহার

সাড়ে তিন হাত ভূমি: উপন্যাসে একাত্তরের মানবিক বিপর্যয়

'সাড়ে তিন হাত ভূমি' পাঠশেষে মনে হয়েছে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদারদের হাতে আমাদের জনজীবনের মানবিক বিপর্যয় এই উপন্যাসের বিষয়বস্তু। মানবিক অনুভূতির সহজ-সরল উপস্থাপন এর সবচেয়ে বড় গুণ। আঙ্গিককৌশলেও রয়েছে নতুনত্ব। কাহিনী এগিয়ে চলেছে একজন মুক্তিযোদ্ধার জবানিতে যে ক্যাম্প থেকে ছুটি নিয়ে এসেছিল বাবা-মায়ের সঙ্গে দেখা করতে। এসে দেখে বাড়ির বিভিন্ন স্থানে পড়ে আছে তার বাবা, মা ও বোনের মৃতদেহ। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী হামলা করে বাড়ির সকলকে হত্যা করে ফেলে রেখে গেছে। মুক্তিযোদ্ধাটি একেকজনের জন্য কবর খুঁড়তে থাকে আর তার মনে পড়তে থাকে সেই মানুষটিকে কেন্দ্র করে তার যত স্মৃতি।

প্রথম পর্বটির নাম 'ঘুমিয়ে থাকা গ্রাম'। এ পর্বে বাবার কবর খোঁড়ে সে। খুঁড়তে খুঁড়তে মনে পড়ে বাবার সঙ্গে তার যাপিত জীবনের স্মৃতি। মায়ের স্মৃতি বিজড়িত দ্বিতীয় পর্বের নাম 'আমার মায়ের অাঁচলখানি'। মায়ের স্মৃতির অনুষঙ্গে মনে পড়ে মাতা-পুত্র বারেক আর বুয়ার মর্মস্পর্শী ঘটনাবলি- যেখানে একদিন বারেক হঠাৎ মায়ের পিটুনি খেয়ে নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিল। ছেলেকে হারিয়ে মা কেবল গুমরে গুমরে কাঁদত। নিজেকে দোষারোপ করতো ছেলের সঙ্গে নিষ্ঠুর আচরণ করবার জন্য। বহু বছর পার হওয়ার পর যখন বারেক আর বেঁচে নেই বলে সবাই ভেবে নিয়েছে তেমনি একদিনে ফিরে এসেছিল সে এক পরহেজগার মুসল্লির বেশে। এসেছিল মায়ের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে। কিন্তু বারেককে এত বছর পরে ফিরতে দেখেও মায়ের মধ্যে কোনো ভাবান্তর ঘটেনি। কারণ মায়ের মনে ছেলের ওপর গভীর অভিমান জমে গিয়েছিল ততদিনে। মায়ের ক্ষমা না পেয়ে হতাশ বারেক যখন ফিরে যাবার সিদ্ধান্ত নিল তখন অভিমান ভেঙে কেঁদে উঠেছিল মা। গল্পের ভেতরে এমন আর এক মানবিক গল্প পুরে দেন তিনি যা মুক্তিযুদ্ধের সময়কার মানবিক বিপর্যয়কে আরও তীব্র ও তীক্ষ্ন করে তোলে। তৃতীয় পর্বের নাম 'বকুল ফুলের ভোরবেলাটি' - যে পর্বে বলা হয়েছে ছোট বোনটির কথা। এই তিন পর্ব মিলিয়ে সমাপ্ত হয়েছে এই উপন্যাসের প্রথম খণ্ড। তিনপর্ব মিলিয়ে মুক্তিযুদ্ধের আগের সময়ের বর্ণনা করা হয়েছে। বর্ণনা করা হয়েছে সাধারণ জীবনযাত্রার সঙ্গে মিলিয়ে ধীরে ধীরে কীভাবে রাজনীতির ধারা যুদ্ধের দিকে এগিয়ে গেছে। পরে পাক বাহিনীর অত্যাচারে যুদ্ধ কীরকম বিভীষিকাময় হয়ে উঠেছে তারও নিপুণ বর্ণনা আছে এখানে। কিন্তু এই বর্ণনা নিছক বর্ণনাই নয়, পড়তে পড়তে পাঠক যুক্ত হয়ে পড়বেন মুক্তিযোদ্ধাটির জীবনের নানা স্মৃতি-অনুষঙ্গের সঙ্গে নিবিড়ভাবে। বর্ণনা গভীর মানবিক অনুভূতিময়তায় আচ্ছন্ন করে তুলতে থাকবে পাঠককে। সামগ্রিক অর্থে 'সাড়ে তিন হাত ভূমি'কে একই সঙ্গে সুপাঠ্য ও সমৃদ্ধ উপন্যাসের লক্ষণে প্রদীপ্ত বলতে হবে।

সূত্র : অনন্যা প্রকাশনী, বাংলাবাজার, ঢাকা।

 

সর্বশেষ খবর