শুক্রবার, ৩০ অক্টোবর, ২০১৫ ০০:০০ টা
গল্প

কর্মফল

আবেদীন জনী

কর্মফল

এক দেশে বাস করতেন খুব নামকরা দুজন ধনী লোক। দুজনই প্রচুর ধন-সম্পদের মালিক। এত বেশি অর্থকড়ি, সোনাদানা আর কারও ছিল না। দেশের সব মানুষই  তাদের চিনত। ধনী হলেও দুজনের মধ্যে ছিল বিরাট পার্থক্য।

একজন ছিলেন খুব বিলাসী এবং স্বার্থপর। শুধু নিজের সুখের জন্য তিনি সবকিছু করতেন। এতে যত অর্থই খরচ হোক পিছু ফিরতেন না। নিজ স্বার্থ ছাড়া একটি পয়সা ব্যয় হলে তার বুকের মধ্যে কাঁটা দিয়ে উঠত। তার ছিল দামি দামি গাড়ি। বিলাসবহুল অট্টালিকা। হাওয়াখানা। তিনি সোনার পালঙ্কে ঘুমুতেন। দামি খাবার খেতেন সোনার চামচ দিয়ে। ঘর ভর্তি থাকত মজার মজার ফলমূল। অসংখ্য চাকর-বাকর ছিল তার। তিনি একদিনে যে পরিমাণ অর্থ খরচ করতেন, একজন সাধারণ লোক এক বছরে তার অর্ধেকও খরচ করতে পারত না। মস্তবড় ধনী হয়েও তিনি কাউকে একটি কানাকড়িও দান করতেন না।

একদিন এক গরিব কৃষক এসে তাকে বলল, আপনি তো মস্তবড় ধনী। কিন্তু আমি খুব নিঃস্ব। আমার এক টুকরো জমি। কিন্তু ধানবীজের অভাবে চাষ করতে পারছি না। আমারে যদি কিছু টাকা ধার দিতেন, তাহলে ধানবীজ কিনতাম। কথা দিচ্ছি, আমি ঠিকমতোই টাকাগুলো ফেরত দিয়ে যাব। স্বার্থপর ধনী লোকটি বললেন, আমার কি টাকার গাছ আছে যে ছিঁড়ে এনে দেব? ধানবীজ না থাকে তো ক্ষেতে নুড়ি পাথর ছিটিয়ে দাও। পয়সা লাগবে না।

ভিক্ষুক এসে ভিক্ষা চাইলে বলতেন, এটা তো মামার বাড়ির খামার না যে, চাইলেই পাওয়া যাবে। ক্ষুধা লাগলে এঁটেল মাটি চিবিয়ে খাও। ভীষণ মজা পাবে।

ভিক্ষুক যদি তারপরও দাঁড়িয়ে থাকত তাহলে তাকে লাঠিপেটা করে তাড়িয়ে দিতেন।

তিনি কাউকে কখনো একচিলতেও সাহায্য সহযোগিতা করতেন না। সবাই বলত, লোকটির ধন আছে কিন্তু মন নেই।

একদিন হলো কী ওই বিলাসী ধনী লোকটি যে এলাকায় বাস করতেন, সেখানে প্রচণ্ড ভূমিকম্প হলো। তার সব ধন সম্পদ টাকা-পয়সা, সোনাদানা, অট্টালিকা সবকিছু তছনছ হয়ে গেল। এ খবর ছড়িয়ে পড়ল সারাদেশে। সব মানুষের কাছে। কিন্তু সবাই বলল, তার তো পাহাড়সম ধন-সম্পদ। ভূমিকম্পে কতটুকু আর ক্ষতি হবে? এই কথা ভেবে কেউ তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে গেল না। এত নামকরা ধনী লোকটি মুহূর্তেই ভিক্ষুকে পরিণত হলো।

আর একজন ধনী লোক ছিলেন খুবই মহৎ এবং দানবীর। তার মনটাও ছিল বড়। আকাশের মতো। কেউ যদি অভাবে পড়ে তার কাছে আসত, খালি হাতে ফিরিয়ে দিতেন না। সাধ্যমতো দান করতেন। কৃষক, কামার, কুমার, তাঁতি, মজুর, ভিক্ষুক এমন সব নিঃস্ব মানুষকে সাহায্য সহযোগিতা করতেন। দরিদ্র ছাত্রছাত্রীদের লেখাপড়ার খরচ দিতেন। অসুস্থ মানুষের চিকিৎসার খরচ জোগাতেন। নিজ অর্থে প্রতিষ্ঠা করতেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল। দানবীর হিসেবে সারা দেশেই তার সুনাম ছিল। সেদেশের রাজাও তাকে খুব ভালোবাসতেন।

প্রতিদিন সারাদেশ থেকে অভাবী লোকেরা এসে জড়ো হতো। কার কিসের অভাব, মন দিয়ে শুনতেন। তারপর নিজ হাতে দান করতেন। এভাবে দান করতে করতে এক সময় তার ধনসম্পদ প্রায় শেষ হয়ে এলো। শুধু অবশিষ্ট থাকল এক টুকরো জমির ওপর ছোট্ট একটি কুঁড়েঘর।

মহৎ এবং দানবীর লোকটি যে এলাকায় বাস করতেন, সেখানেও হঠাৎ একদিন ভূমিকম্প হলো। তছনছ হয়ে গেল তার শেষ সম্বল ভিটে বাড়িটুকও। কিছুই রইল না আর। এই খবরও ছড়িয়ে পড়ল সারাদেশে। সব মানুষের কাছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আকাশ বাতাসে ভেসে এলো অসংখ্য মানুষের কান্নার রোল। হাহাকার। হায়, এ কী হলো! একী করল প্রভু! এই মহৎ মানুষটাকে তুমি কষ্ট দিলে কেন?

লোকটির পাশে দাঁড়াতে যার যা আছে তাই নিয়ে ছুটে এলো হাজারও মানুষ। ক্ষেতের হাল থামিয়ে ছুটে এলো কৃষক। বুনন কাজ বন্ধ রেখে ছুটে এলো তাঁতি। লোহা পেটানো বন্ধ রেখে দৌড়ে এলো কামার। এলো কুমার, ছাত্র-শিক্ষক, ব্যবসায়ী, দিনমজুর। সর্বস্তরের জনতা। সেদেশের রাজাও মহৎ লোকটির বিপদে এগিয়ে এলেন। রাজ কোষাগারের অর্থ দিয়ে ক্ষতিপূরণের ঘোষণা দিলেন।

সব মানুষের ভালোবাসা এবং সাহায্য-সহযোগিতা পেয়ে মহৎ এবং দানবীর লোকটির মনে হলো, ভূমিকম্পে তার একবিন্দু ধনসম্পদও যেন নষ্ট হয়নি। ক্ষতি হয়নি। বরং আগে যা ছিল, তার চেয়ে দ্বিগুণ হয়েছে।

সেই যে বিলাসী এবং স্বার্থপর লোকটা। যিনি এখন ভিক্ষুক। একদিন তিনি ভিক্ষা করতে করতে দানবীর লোকটির বাড়ি এলেন। খুবই অবাক হলেন তার ধন-সম্পদ দেখে। কেঁদে কেঁদে বললেন, ভূমিকম্পে আমার সবকিছু শেষ হয়ে গেছে। আজ আমি নিঃস্ব। রিক্ত। পথের ভিক্ষুক, পথে পথে ঘুরি। শুনেছি, আপনার এখানেও প্রচণ্ড ভূমিকম্প হয়েছে। কিন্তু আপনার কিছুই তো ধ্বংস হয়নি। শেষ হয়ে যায়নি। দেখতে পাচ্ছি, আরও দ্বিগুণ হয়েছে ধন-সম্পদ। কারণ কী বলুন তো?

মহৎ এবং দানবীর লোকটি বললেন, এটা হচ্ছে কর্মফল। সবার একটি কথা মনে রাখা দরকার। দান করলে কখনো ধন-সম্পদ শেষ হয় না।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর