শুক্রবার, ১৩ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা
গল্প ♦ আহমেদ রিয়াজ

টিক টিক টিক

টিক টিক টিক

ঘণ্টার কাঁটা তখন সাত লেখা দাগের খানিকটা আগে। মিনিটের কাঁটা নয় লেখা দাগ কেবল পেরিয়েছে। সেকেন্ডের কাঁটা ঠিক বারো লেখা দাগের উপর। আর তখনই হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল ঘড়িটা।

বড্ড বিরক্ত হল ঘণ্টার কাঁটা। কী সুন্দর হালকা দোলায় ও চলছিল। গুটি গুটি করে। বিরক্ত হলো মিনিটের কাঁটাও। অবশ্য ঘণ্টার কাঁটার চেয়ে একটু জোরেই ও ঘুরছিল। তবে সবচেয়ে বেশি জোরে ঘুরছিল সেকেন্ডের কাঁটা। কিন্তু ঘড়িটা কেন বন্ধ হয়ে গেছে? ঘড়ি বন্ধ হওয়ার দুই ঘণ্টা পর জানা গেল ব্যাটারি শেষ। নতুন ব্যাটারি না লাগানো পর্যন্ত ঘড়ি চলবে না। শুনে বড্ড মন খারাপ হলো ঘড়িটার সবচেয়ে ছোট ঘণ্টার কাঁটার। একই জায়গায় স্থির হয়ে থাকতে হবে। স্থিরতা তার ভালো লাগে না। তিনটে কাঁটার মধ্যে সবচেয়ে বুড়ো ও। চলে সবার চেয়ে ধীরে। তাই বলে স্থির হয়ে থাকা? অসম্ভব! বিরক্তি নিয়ে তাকাল সেকেন্ডের কাঁটার দিকে।

ঘণ্টার কাঁটার চেয়ে মিনিটের কাঁটা লম্বায় খানিকটা বড়। তবে পেটমোটা ঘণ্টার কাঁটার মতো অত মোটা নয় ও। মিনিটের কাঁটার মনে হয়, ইয়া বড় পেটের জন্যই বুঝি অত আস্তে আস্তে ঘোরে ঘণ্টার কাঁটা। ওর কাছে মনে হয় ওর ঘোরাটাই সবচেয়ে উত্তম। সেকেন্ডের কাঁটার মতো খুব জোরেও নয়, আবার ঘণ্টার কাঁটার মতো অত ধীরেও নয়। ওর গতিটাই স্বাভাবিক। খুব বিরক্তি নিয়ে তাকাল ও সেকেন্ডের কাঁটার দিকে।

ঘড়ির তিনটে কাঁটার মধ্যে সবচেয়ে লম্বা আর ঢ্যাঙঢ্যাঙে হচ্ছে সেকেন্ডের কাঁটা। ছোটে সবার আগে আগে। মিনিটের কাঁটা ঘড়ির ষাটটা ছোট ছোট দাগের একটা পেরুনোর আগেই, পুরো ঘড়ি একবার চক্কর দিয়ে আসে ও। আর ঘণ্টার কাঁটাটাকে ওর মনে হয় দুনিয়ার সেরা আলসে। যদিও আলসে না হওয়ার কোনো কারণ ও খুঁজে পায় না। এত্ত মোটা পেট নিয়ে কেউ চলতে পারে? যেমন পেটমোটা তেমনি বাঁটু ঘণ্টার কাঁটা। ঘড়ির একটা দাগ থেকে আরেকটা দাগে যেন নড়তেই চায় না। ঘণ্টার কাঁটাকে কখনো নড়তে দেখেনি সেকেন্ডের কাঁটা। তবে অবাক হয়ে দেখেছে, ঠিকই একটার পর একটা দাগ পেরিয়ে যাচ্ছে ঘণ্টার কাঁটা। ও খুব অবাক হয়ে ভাবে, কেমন করে এটা সম্ভব!

একদিন পুরনো ব্যাটারি খুলে নতুন ব্যাটারি লাগানো হলো। ব্যাটারি লাগানো মাত্রই ছুটতে শুরু করল সেকেন্ডের কাঁটা। আবার সচল হলো মিনিটের কাঁটা। মনে হচ্ছে প্রাণ ফিরে পেয়েছে ঘণ্টার কাঁটা। কিন্তু সেকেন্ডের কাঁটা অত জোরে ছুটছে দেখে বড্ড বিরক্ত লাগল তার। বিরক্ত লাগল মিনিটের কাঁটারও। অত জোরে ছোটার কী আছে?

ঘণ্টার কাঁটা বলেই ফেলল, চিকনা কাঁটা শোন, অত জোরে জোরে ছুটিস কেন বল তো? মিনিটের কাঁটাও সায় দিল ওর কথায়, অত জোরে ছুটিস বলেই তো এত তাড়াতাড়ি ব্যাটারি শেষ হয়ে যায়। বুঝিস এটা? খুব মন খারাপ হলো সেকেন্ডের কাঁটার। খুব। ও ভাবেনি ব্যাটারি শেষ হওয়ার দায় ওর ওপরই চাপাবে ওই কাঁটা দুটো। হঠাৎ থেমে গেল সেকেন্ডের কাঁটা।

মিনিটের কাঁটা প্রথমে বুঝতে পারেনি। বুঝল খানিক পর। বলল, থেমে আছিস কেন? সেকেন্ডের কাঁটা বলল, আমি চলব না। ঘণ্টার কাঁটা এতক্ষণে বুঝতে পারল। ওর কেন যেন মনে হচ্ছিল কিছু একটা ঘটেছে। কারণ যে দোলায় ও দুলে দুলে এগুচ্ছিল, হঠাৎ সে দুলুনি বন্ধ হয়ে  গেছে। খেয়াল করে দেখল মিনিটের কাঁটা চলছে না। জানতে চাইল ঘণ্টার কাঁটা, আবার কী হয়েছে? চলছিস না কেন? নতুন ব্যাটারি লাগানো হলো, অথচ এরই মধ্যে চার্জ শেষ! নকল ব্যাটারি লাগানো হয়েছে নাকি ঘড়িতে?

মিনিটের কাঁটা বলল, ওসব কিছুই না। সেকেন্ডের কাঁটা থেমে আছে।

ঘণ্টার কাঁটা বলল, কেন থেমে আছে?

মিনিটের কাঁটা বলল, রাগ করে।

ঘণ্টার কাঁটা বলল, ও ওর রাগ নিয়ে থেমে থাকুক। তুই থেমে আছিস কেন? জানিস না তুই না চললে আমিও চলতে পারি না?

মিনিটের কাঁটা বলল, বোকার মতো কথা বলো না। আমি কেমন করে চলব?

ঘণ্টার কাঁটা বলল, এতদিন কেমন করে চলতিস?

মিনিটের কাঁটা বলল, এতদিন সেকেন্ডের কাঁটা চলত, ওর সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমি চলতাম। সেকেন্ডের কাঁটা চলা থামিয়ে দিলে আমি কেমন করে চলব?

ঘণ্টার কাঁটার ভাবল, তাই তো? এই বিষয়টা তো ওর মাথায় আসেনি। সেকেন্ডের কাঁটা না চললে মিনিটের কাঁটা চলবে না। আবার মিনিটের কাঁটা থেমে থাকলে ঘণ্টার কাঁটাও চলতে পারবে না।

ঘণ্টার কাঁটা বলল, কিন্তু ওকে অত জোরে জোরে না ছুটে ধীরে ধীরে চলতে বল।

মিনিটের কাঁটা বলল সেকেন্ডের কাঁটাকে, ধীরে ধীরে চল। আমার মতো। দেখিস না আমি কত ধীরে ধীরে চলি।

সেকেন্ডের কাঁটা বলল, সবারই চলার একটা নিয়ম থাকে। তোমার নিয়মে তুমি চলবে, ওই মোটকুর নিয়মে মোটকু চলবে। আমি আর কারো মতো চলতে পারব না। চলতে হলে আমি আমার নিয়ম মতোই চলব।

মিনিটের কাঁটা বলল, তা যা বলেছিস।

ঘণ্টার কাঁটা বলল, ঠিক আছে। তুই তোর নিয়ম মতোই চল। এবার বুঝতে পেরেছি। তোকে অমন কথা বলার জন্য আমি দুঃখিত।

মিনিটের কাঁটা বলল, আমিও দুঃখিত।

আর কোনো রাগ রইল না সেকেন্ডের কাঁটার। আবার চলতে শুরু করল ও আগের মতো- টিক টিক টিক।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর