শুক্রবার, ৪ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা
হাশেম খান

সব বক সাদা নয়

সব বক সাদা নয়

স্কেচ খাতার পাতায় আমার আঁকা পাখির ছবিগুলো দেখতে গিয়ে বকের ছবিতে চোখ আটকে গেল। কয়েকটি বকের ছবি, কালি-তুলি ও কলমের স্কেচ। দুটি স্কেচ করেছিলাম শেরপুর-ডাকবাংলাতে বসে ১৯৯৮ সালে। শেরপুর থেকে রাজাপাহাড়ের দিকে যাওয়ার পথে একটা জলা জায়গায় একসঙ্গে ১০/১২টি বক দেখে চমকে গিয়েছিলাম। আমার সঙ্গে ছিলেন কবি রবিউল হুসাইন, ড. মুনতাসীর মামুন ও মিসেস ফাতেমা মামুন, তাদের ছেলে নাবিল। তিন-চার দিন ধরে আমরা ময়মনসিংহ, হালুয়াঘাট, শেরপুর, গজনী এসব এলাকা ঘুরছি। গ্রামে বিলে, ধানক্ষেতে আগে অনেক পাখি চোখে পড়ত। বিশেষ করে ‘বক’তো অনেক দেখতাম। এ কয়েকদিন মাইলের পর মাইল পেরিয়ে গেলেও বক চোখেই পড়েনি। অন্য পাখি দুচারটে চোখে পড়েছে। তাই সেদিন রাজাপাহাড়ের পথে এতগুলো বক দেখে অবাকই হলাম।

ছেলেবেলায় একটা কানিবকের সঙ্গে আমার নীরব বন্ধুত্ব হয়েছিল। কানিবকটা পুকুরপাড়ে প্রায় পানির কাছে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকত। বকের দৃষ্টি পানির দিকে— ছোট মাছ, ব্যাঙাচি দেখতে পেলেই দ্রুত টুপ করে লম্বা ঠোঁটে তুলে নিত। আমি প্রায়ই নিঃশব্দে পুকুরঘাটে বসে কানিবকের মাছ শিকার দেখতাম। বকটাকে তাড়াতাম না, কোনোরকম বিরক্ত করতাম না। অন্য কেউ ঘাটে এলে বকটাকে বিরক্ত করতে নিষেধ করতাম। অনেক দিন ধরে কানিবকের মাছধরা দেখে ওর চালচলন আমার মুখস্থ হয়েছিল। বিশেষ করে লম্বা ঘাড়টা গুজিয়ে কাদা পানি থেকে এক পা তুলে আরেক পায়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকত, কিন্তু তীক্ষ্ন দৃষ্টি পানির নিচে মাছের চলাফেরার দিকে। মনে হতো যেন ঘুমোচ্ছে। মাছের দেখা পাওয়ামাত্র গোজানো গলাটা বাঁকিয়ে লম্বা শক্ত ঠোঁট একটু উপর দিকে তুলে দু’তিনটা ঝাঁকি দিয়ে মাছটা গলার মধ্যে সেধিয়ে দেওয়ার দৃশ্য দেখতে বেশ মজাই লাগত। বকের এমন কয়েকটা দৃশ্য ছোটবেলায় কাঁচা হাতে এঁকেছিলাম। ইত্তেফাকের কচি-কাঁচার আসরে ছাপাও হয়েছিল। দাদাভাই রোকনুজ্জামান খান দু’লাইনের মজার ছড়াও লিখে দিয়েছিলেন।

পাখির ছবি আঁকতে হলে অবশ্যই ভালো করে পাখি পর্যবেক্ষণ করা প্রয়োজন। বিশেষ করে পাখির চলাফেরা, আচরণ, শিকার ধরার ভঙ্গি, খাওয়ার ভঙ্গি, ওড়ার সময় শরীরের অবস্থান, পা ও নখ দিয়ে ডাল আঁড়ে দাঁড়ানোর কৌশল ইত্যাদি। দ্রুত ড্রইং ও স্কেচ করে উপরের বিষয়গুলো দিনের পর দিন এঁকে অনুশীলন করে রপ্ত করতে হয়। ‘কাক’ আঁকা রপ্ত করার জন্য আমি কতদিন যে বাড়িতে কাকের মেলা বসিয়েছি। রুটি ছিঁড়ে ছিঁড়ে উপর দিকে ছুড়ে দিলে কাক দ্রুত ঠোঁটে খপ করে তুলে নিত। কাকের খাওয়া ওড়াওড়ি, সুচতুর ভঙ্গি সদা ব্যস্তভাব বেশ আকর্ষণীয় ও বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন কাকের এ সুচতুর ভঙ্গি ও ব্যস্ত-সমস্ত ভাব-স্বার্থকভাবে অন্বয় করে বেশ কিছু কাকের ছবি এঁকেছেন। পাখির প্রতি ভালোবাসার কারণেই আমি পাখি নিয়ে অনেক ছবি এঁকেছি। ১৯৯২ সালে শিল্পকলা একাডেমিতে আমার চিত্রপ্রদর্শনীর শিরোনাম ছিল ‘চিত্র প্রদর্শনী— পাখি ও অন্যান্য’ ১০৪টি ছবির মধ্যে ৭০টি পাখিবিষয়ক ছবির বেশ কিছু ছবি ছিল বকের। ছেলেবেলায় গ্রামে অনেক বক দেখেছি এবং পরে চারুকলার শিক্ষার্থী থাকাকালীন বিলে, নদীতে ঘুরে এবং চিড়িয়াখানায় গিয়ে বক ও অন্যান্য পাখি পর্যবেক্ষণ করেছি— অনুশীলন করেছি।

বাংলাদেশ শিশু একাডেমি প্রকাশ করেছে দুই খণ্ডে ‘বাংলাদেশের পাখি’ নামে দুটি তথ্যবহুল বই। লেখক শরিফ খান ৪২টি প্রজাতির পাখি পর্যবেক্ষণ করে এবং বিভিন্নসূত্র থেকে তথ্য সংগ্রহ করেছেন। এ ৪২টি পাখির ছবি আমি এঁকেছি। শরিফ খান বকপাখি বিষয়েও অনেক চমত্কার বিবরণ দিয়েছেন। সাধারণভাবে বক দেখতে সাদা রং মনে হলেও সব বক একেবারে সাদা নয়। কানিবকের মাথা ও পিঠে খয়েরি হলুদ রঙের পালক। বুকে ও ডানার নিচে সাদা নরম পালক— উড়তে গেলেই সাদা রং দেখা যায়। কিন্তু বসে থাকার সময় সাদা রং দেখা যায় না। নিশিবকের পালক বেশির ভাগই হালকা কালচে। ধুসর বক তার নামেই পরিচয়। এছাড়াও হালকা বেগুনি ও বাদামি রঙের বক রয়েছে। বাংলাদেশে ১৩ প্রজাতির বক রয়েছে। এগুলোর নাম ধূসর বক, বড় সাদা বক, খুন্তে বক, বেগুনি বক, নিশিবক, মাঝারি সাদা বক, ছোট সাদা বক, গো-বক, ছোট বক, কানি বক, সবুজ বক, নল ডোঙা ও হলদে বক। এগুলোর ভিন্ন ভিন্ন ইংরেজি ও বৈজ্ঞানিক নাম রয়েছে। সবচেয়ে বড় বক হলো ধূসর বক— ১০২ সে.মি. এবং ছোট বক ২৮ সে.মি. লম্বা। উত্তর আমেরিকা ও প্রশান্ত মহাসগরীয় কিছু অঞ্চল ছাড়া সারা পৃথিবীতেই বক আছে এবং স্ত্রী-পুরুষ ভেদে দেখতে প্রায়ই একই রকম। দুজনে মিলে বাসা বাঁধে, বাচ্চাদের লালন পালন করে। স্বভাব-চরিত্র প্রায় একই রকম। গড়নের দিক থেকেও যথেষ্ট মিল। সবারই লেজ শরীরের তুলনায় খাটে। পা ও পায়ের পাতা লম্বা। ঘাড় লম্বা, ঠোঁট শক্ত ও লম্বাটে। পাখা ও ওড়ার ভঙ্গি সবারই প্রায় একই রকম। মাটিতে দাঁড়ালে সব বকই দেখতে ইংরেজি ‘এস’ অক্ষরের মতো মনে হয়।

বক বিপদে পড়লে বা মানুষের হাতে ধরা পড়লে খুব ঘাবড়ে যায়। ঠোঁট দিয়ে পাল্টা আক্রমণ করে রক্তারক্তি কাণ্ড ঘটায়। মানুষ বা অন্য প্রাণী, যেই শত্রু হোক বক তার চোখের মণিতে ঠোকর দেবে। এটা বকের অদ্ভুত ও হিংস্র প্রবণতা। তাই যারা বক শিকার করে অনেকেই অকালে একটা চোখ হারায়।

আমাদের প্রকৃতি থেকে বক দিনে দিনে কমে যাচ্ছে। গ্রামে, নদীতে, বিলে ঝিলে আগের মতো বক দেখা যায় না। কোনো কোনো অঞ্চল থেকে হারিয়েই গেছে। কারণ, কিছু লোভী ও অবিবেচক মানুষ বক শিকার করে, ফাঁদ পেতে ধরে, ডিম-বাচ্চা সাবাড় করে খায়। শহরে এনে বিক্রি করে। দেশে আইন রয়েছে— পাখি শিকার না করা ও পাখি ধরা নিষেধ। কিন্তু আইনের প্রয়োগ নেই। গ্রামের লোক অনেকেই আইন বিষয়ে জানে না। কিন্তু তারা যখন শহরে পাখি নিয়ে আসে— লেখাপড়া জানা ও আইন জানা লোকেরাই সেগুলো কেনে। আইন তাদের প্রতিও প্রয়োগ করা প্রয়োজন। কারণ, নিষিদ্ধ পাখি ক্রয় করে তারাও আইন অমান্য করছে, অপরাধ করছে, এবং পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করতে সহায়তা করছে। ফসলের ক্ষেতে অতিরিক্ত ও বেহিসাবি রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ওষুধ প্রয়োগের ফলে বিল ও ঝিলের পানিতে সেসব পদার্থ মিশে ছোট মাছ, ব্যাঙাচি ও অন্য পোকা-মাকড় মরে যাচ্ছে। বংশ বৃদ্ধি কমে যাচ্ছে। ফলে বক ও অন্যান্য পাখির খাবার কমে যাওয়ায় দিনে দিনে তাদের সংখ্যা কমে যাচ্ছে।

বক মানুষের বন্ধু। তাই প্রকৃতিরও বন্ধু। অনেক অপ্রয়োজনীয় পোকামাকড় খেয়ে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে। ফসলের উপকার করে। ওদের মল মাটির উর্বরতা বাড়ায়। লোকালয়ে— বক-গরু ও মোষের পরম বন্ধু। প্রায়শই দেখা যায়, গরু ও মোষের পিঠে চড়ে সাদা বক চরে বেড়াচ্ছে। গরু ও মোষের পিঠের ঘা থেকে পশম থেকে পোকা-মাকড় ধরে খেয়ে ফেলে। তাই বক পিঠে বসলে গরু ও মোষ খুব আরাম বোধ করে। বনে-জঙ্গলেও একইভাবে বক হরিণের ও বুনো শূকরের অনেক উপকার করে। বিশেষ করে সুন্দরবনে হরিণের পিঠে চড়ে বেড়ানোর সময় বাঘ ধারে কাছে আসার আভাস পেলেই বক ডানা ঝাপটে নিরাপদ দিকে উড়ে যায়। হরিণও সঙ্গে সঙ্গে সতর্ক হয়ে ছুটে পালায়।

প্রদর্শনীতে আমার আঁকা বকের ছবির সামনে দাঁড়িয়ে একজন দর্শকের মন্তব্য ও অনুরোধ স্মর্তব্য। আপনার আঁকা এতগুলো পাখি একসঙ্গে দেখে ভালো লাগল। যে হারে পাখি মারা পড়ছে এবং হারিয়ে যাচ্ছে তাতে আমাদের ছেলেমেয়েরা ও ভবিষ্যত্ প্রজন্মকে এই আঁকা পাখির ছবি দেখেই চিনতে হবে এটা শালিক, এটা বুলবুলি, দোয়েল, একে বলে বক, এটা পানকৌড়ি ইত্যাদি। তাই আপনাকে অনুরোধ, পাখি আঁকা ছাড়বেন না, যতদিন পারেন এঁকে যান।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর