শুক্রবার, ১১ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা
গল্প -আশিক মুস্তাফা

কুড়িয়ে পাওয়া মা

যুদ্ধ তখনো শুরু হয়নি। তার আগেই আরেক যুদ্ধ শুরু করে দিল বাকী। তখনো সে হাইস্কুলের গণ্ডি পেরোয়নি। এইটুকুন পিচ্চি এক সকালে ক্লাসে দাঁড়িয়ে টিচারকে বলে, ‘পাকিস্তান দেশ ও কৃষ্টি নামের বই পড়ব না। এ বই থাকতে পারবে না আমাদের পাঠ্য তালিকায়।’ ক্লাসের সবার চক্ষু চড়কগাছ। ওমা বলে কি, সবাই তো পড়ছে। তাছাড়া পড়ার ইচ্ছা না করলেই যে তা নিয়ে হইহুল্লোড় বাঁধিয়ে দিতে হবে এমন তো কোনো কথা নেই। বাকীর কিন্তু ওসবে মন নেই। স্যারও অবাক হলেন ছেলেটার সাহস দেখে। বাকীকে বুঝালেন। কিন্তু না, সে এ বই পড়বে না তো পড়বেই না। রাগ আর প্রতিবাদ করে ক্লাস থেকে বেরিয়ে পড়ল। ওদিকে দেশে শুরু হয়ে গেছে যুদ্ধ। ঘোষণা এলো ৭ মার্চের। বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম... যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে।’

বাকীও শত্রু মোকাবিলার জন্য তৈরি। দেখা করল নাজমুল হাসান পাখী নামের এক বড় ভাইয়ের সঙ্গে। বড় ভাই সাহসী বাকীকে কাছে পেয়ে খুশিই হলেন। তবে একটু ভয়েও ছিলেন; পারবে তো ছোট মানুষটা? কিন্তু বাকীর সাহস দেখে সেই ভয় কেটে গেল তার। নাজমুল হাসান পাখী নামের এ বড় ভাইয়ের কাছে ধাপে ধাপে যুদ্ধের ট্রেনিং নিতে থাকে বাকী। বড়দের মতো অস্ত্র ধরতে শিখে গেছে। জানা হয়ে গেছে অনেক যুদ্ধ কৌশল। কলা-কৌশল জানা ছোট্টমোট্ট যোদ্ধা একদিন ঠিকই বড়দের সঙ্গে যুদ্ধে নেমে পড়লেন। বড়রা তার যুদ্ধ কৌশল দেখে অবাক হয়ে যায়। যুদ্ধে বিভিন্ন দলকে আলাদা আলাদা দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়া হতো। সেই নিয়ম অনুযায়ী বাকীদের দেওয়া হলো কুমিল্লার-কসবা, বুড়িচং, ব্রাহ্মণপাড়া, মুরাদনগরের কিছু অংশের দায়িত্ব। নিয়ম অনুযায়ী তারা যুদ্ধ শুরু করলেন এসব জায়গায়। যুদ্ধে যুদ্ধে কাটছে দিন। বড়দের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে যুদ্ধ করছে স্কুল ছেড়ে আসা বাকী। সেপ্টেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহের দিকে বাকীদের দল জানতে পারে যে তাদের যেতে হবে মুরাদনগর এলাকায়। কমান্ডার ছিলেন বাকীর সেই বড় ভাই খ্যাত নাজমুল হাসান পাখী। মুরাদনগর হয়ে তারা চলে যায় ভারতে। সেখানে চলে প্রশিক্ষণ। ছোট বাকী শিখে নেয় আর কিছু যুদ্ধ কৌশল। সেখান থেকে সেপ্টেম্বরের ১১ তারিখ তার দলের বাংলাদেশে রওনা হওয়ার কথা। তবে কেন যেন তা আর হয়ে ওঠে না। পরে রওনা হয় ঠিক তার এক দিন পর মানে সেপ্টেম্বরের ১২ তারিখে। দেশে আসার পর আবার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দক্ষিণে উজানিসার ব্রিজ পর্যন্ত আসতে দেরি হয়ে যায় তাদের। একপর্যায়ে গভীর রাতে নৌকায় রওনা হয় জামসেদপুরের দিকে। চারদিকে পাহারায় বসা রাজাকার। তাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে ব্রিজের নিচ দিয়ে বেরিয়ে আসতে তেমন কোনো অসুবিধা হয় না তাদের। খালের পাড়ঘেঁষে নৌকা চলতে থাকে পশ্চিমে চারগাছের দিকে। নিশ্চিন্ত তখন নৌকার অন্যরাও। কারণ একটু আগেই চলে গেছে ঢাকার মোস্তফা মহসীন মন্টুদের একটি নৌকা। কোনো গুলির শব্দ হয়নি। তার মানে তারাও নিশ্চিন্তেই পাড়ি দিতে পারব পথটুকু। নৌকায় ছিলেন নাজমুল হাসান পাখী, মমিনুল হক ভুঁইয়া দানা মিয়া, মোজাম্মেল হক আবু, নৃপেন পোদ্দার, আবদুল্লাহ-হিল-বাকী, আবু জাহিদ আবু, সাইফুল ইসলাম সাফু, নাবালক মিয়া, নুরুল ইসলাম, মেহরাব হোসেন ও রকিব হোসেন। ১১ জনকে নিয়ে যেন একটি পরিবার। বয়সে ছোট হওয়ার কারণে আবু ও বাকীর আদর-যতœও বেশি। কমান্ডার নাজমুল হাসান পাখী থেকে শুরু করে সবাই তাদের দিকে বিশেষ খেয়াল রাখেন, কোনোভাবে যেন ছোট এ দুজনের কোনো অসুবিধা না হয়। তাদের দিকে থাকে বড়দের তীক্ষ নজর।

নৌকা চলছে। চলতে চলতে চারগাছ বাজারের কাছাকাছি পৌঁছালে হঠাৎ আবদুল্লা-হিল-বাকীর নজরে আসে বাজারে কে যেন সিগারেট টানছে। সহযোদ্ধাদের বললেন, ব্যাপারটা অস্বাভাবিক লাগছে। ওখানে রাজাকাররা পাহারা বসিয়েছে নাকি? দেখতে পেলেন অনুসন্ধানী বাতি জ্বলে উঠেছে। বাতি জ্বলার সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টির মতো গুলি আসতে শুরু করে বাজারের দিক থেকে। গুলি শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নৌকার ভেতরে থাকা সাইফুল ইসলাম সাফু ও মোজাম্মেল হক আবু গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান।

কমান্ডার নাজমুল হাসান পাখী সবাইকে নৌকা থেকে পাল্টা গুলি চালানো এবং আত্নরক্ষার জন্য পেছনে সরে আসার নির্দেশ দেন। কমান্ডারের নির্দেশে আবু জাহিদ হাঁটুপানিতে নেমে পাল্টা গুলি করছিলেন। শত্রুপক্ষের একটি গুলি এসে আবুকে ঘায়েল করে দেয়। তিনি সেখানেই শহীদ হন। আবদুল্লাহ-হিল-বাকী ও মমিনুল হক ভুঁইয়া দানা মিয়া গুরুতর আহত হন।

বাকী আহত হওয়ার পরও দমে না। সে ঘটনাস্থল থেকে বেশ খানিকটা সরে গিয়ে অন্ধকারে ঘাপটি মেরে অপেক্ষা করতে থাকে। ফজরের আজানের পরপরই একটি নৌকায় করে চলে যায় চারগাছ থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরের এক গ্রামে। অচেনা গ্রাম। তবে ছোট বাকীর ধারণা, ওই গ্রামটির নাম ছিল শিকারপুর। এ শিকারপুরে গিয়ে বাকী আশ্রয় খোঁজে। ছোট্টমোট্ট মুক্তিযোদ্ধাকে দেখে এক মা তাকে ঘরে তুলে নেন। নিজের সন্তানের মতো বাকীর দেখাশোনা করতে থাকেন। এদিকে বাকীকে ডাকছে দেশ, ডাকছে যুদ্ধ। আদর-আপ্যায়ন পেয়ে কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠতে না উঠতেই তিন দিনের মাথায় আশ্রয় মায়ের বাড়ি ছাড়েন। এই মা-ই বাকীকে আগরতলায় পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। যে তিন দিন বাকী তার আশ্রয়ে ছিলেন প্রতিদিন খবর পেতেন পাকিস্তানি সৈন্যরা চারগাছের আশপাশের গ্রামগুলো তছনছ করে মুক্তিযোদ্ধাদের খুঁজছে। কিন্তু বাকীকে আঁচলে আগলে রেখেছিলেন অচেনা এক মা। বাকী এখনো বেঁচে আছেন। এখনো তার মনে পড়ে সেই অপারেশন চারগাছের কথা। যেই অপারেশনে ছোট্ট মুক্তিযোদ্ধা আবদুল্লাহ-হিল-বাকী হারিয়েছিলেন দুই কিশোর সহযোদ্ধা আবু জাহিদ আবু ও সাইফুল ইসলাম সাফুকে। হারিয়েছিলেন অগ্রজপ্রতিম মোজাম্মেল হক আবুকে। আর আহত হয়ে আঁচলে ঠাঁই পেয়েছেন এক অচেনা মায়ের। কুড়িয়ে পেয়েছিলেন মায়ের আশ্রয়। সেই যুদ্ধস্মৃতি কিছুতেই ভুলতে পারেন না এবং পারছেন না বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল্লাহ-হিল-বাকী।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর