বিকেল বেলা। রবিন ঘুড়ি উড়াচ্ছে। এমন সময় কোথা থেকে যেন দৌড়ে এলো দিপু। একদম রবিনের কাছে এসে দাঁড়িয়ে হাঁপাতে লাগল। জোরে জোরে শ্বাস-প্রশ্বাসের কারণে বুকের পাজর উঠানামা করতে লাগল দ্রুত।
রবিন বলল, তুই অমন করছিস কেন দিপু? কি হয়েছে তোর?
দিপু ফিস ফিস শব্দে বলল, খুব খারাপ একটা সংবাদ আছে। খুব খারাপ সংবাদ। শুনে আমার মনটাও খারাপ হয়ে গেছে।রবিন চমকে উঠল। বলবি তো আগে সংবাদটা। আসল কথা না বলে অযথা ভ্যাঁ ভ্যাঁ করা তোর একটা বাজে অভ্যাস।
কাঁপা কাঁপা গলায় দিপু বলল, জালু রাজাকার এবং তিনজন পাকি আর্মি এসেছিল। ময়না বুবুকে ধরে নিয়ে গেছে।
‘বলিস কী তুই? কোনদিকে নিয়ে গেছে?’
দিপুর কাঁপাকাঁপি আরও বেড়ে গেল। ম..ম.. মনে হয় জালু রাজাকারের বাড়ির দিকে। শুনলাম, গজারি বনের ভিতর দিয়ে টেনেহিঁচড়ে পূর্ব দিকে নিয়ে গেছে ময়না বুবুকে।
রবিন একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে, সুতো টেনে ঘুড়িটা দ্রুত নামিয়ে আনল আকাশ থেকে। তারপর দিপুর কাঁধ চাপড়ে বলল, এখন আমাদের ভয় পেলে চলবে না। বুকে সাহস রাখতে হবে। মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে হবে। জানিস তো, শেখ মুজিব স্বাধীনতার ডাক দিয়েছেন। বাংলাকে হায়েনাদের কবল থেকে মুক্ত করার যুদ্ধ চলছে। হাজার হাজার মা-বোনেরা জীবন দিচ্ছে প্রতিদিন। মুক্তিযোদ্ধারা জীবনের মায়া তুচ্ছ করে লড়ে যাচ্ছে দেশের জন্য। জয় করছে গ্রামের পর গ্রাম। এভাবেই একদিন স্বাধীনতার সূর্য উঠবে। চুপ করে বসে থাকার সময় এখন নয়। চল, ময়না বুবুকে বাঁচাতেই হবে। রবিনের কথায় সমস্ত ভয় মুহূর্তেই ঝেড়ে ফেলল দিপু। সাহসী গলায় বলল, ‘ঠিক আছে। চল। কিন্তু রবিন, ওই নপরশুরা বুবুকে ধরে নিয়ে গেল কেন?’
‘প্রধান কারণ হচ্ছে, ময়না বুবু দুঃসাহসী মুক্তিযোদ্ধা বাবলু ভাইয়ের ছোট বোন। আরও কারণ আছে। এখন অতসব বলার সময় নেই।
দিপু বলল, ময়না বুবুর জন্য খুব মায়া লাগছে আমার। বুবুটার যেমন মায়াবী মুখ, তেমনই সুন্দর সুন্দর কথা বলে। একদিন আমাকে বললেন, দেশকে ভালোবাসবে। দেশ হচ্ছে মায়ের মতো। ভালোবাসতে হবে দেশের মানুষকেও।
রবিন বলল, ‘সে আমি জানি। আমাকেও কত রাজা-রানীর গল্প শুনিয়েছেন। পরি আর বীর-পালোয়ানের গল্পও শুনেছি বুবুর মুখে। সেই প্রিয় ময়না বুবুকে উদ্ধার করাই এখন সবচেয়ে জরুরি কাজ। যেমন করেই হোক, সংবাদটা আগে বাবলু ভাইকে জানাতে হবে। তুই করবি এই কাজটা। আর আমি ঘুড়ি উড়ানোর ছুতোয় জালু রাজাকারের বাড়ির সামনে যাব। ময়না বুবুকে ওই বাড়িতে রেখেছে কিনা, নিশ্চিত হওয়া দরকার। ওখানে ক’জন রাজাকার, ক’জন পাকি আছে, তাও জানতে হবে।’
‘তাতো জানতেই হবে। কিন্তু বাবলু ভাই কোথায় আছে, আমার তো জানা নেই।’ দিপু বলল।
‘আমি জানি। খুব দূরে নয়। কিন্তু খুব সাবধানে যেতে হবে। তিনি এক জায়গায় নতুন মুক্তিযোদ্ধাদের বন্দুক চালানোর ট্রেনিং দিচ্ছেন।’
তারপর দিপুর কানে কানে জায়গাটির নাম জানিয়ে দিল রবিন। দিপু সেইদিকে ছুটল উল্কার মতো। রবিন আবার ঘুড়ি উড়িয়ে দিল। উড়াতে উড়াতে যেতে লাগল জালু রাজাকারের বাড়ির দিকে।
আধাঘণ্টা পর। দিপুদের বাড়ির পেছনে গজারি বনে চলে এলেন বাবলু ভাই। তার সঙ্গে চারজন মুক্তিযোদ্ধা এবং দিপু। প্রত্যেক যোদ্ধার হাতে বন্দুক। দিপুর হাতে গ্রেনেডভরা ব্যাগ।
একটু পরেই রবিন ফিরল সংবাদ নিয়ে। জালুর বাড়িতেই ময়না বুবু। চার-পাঁচজন পাকিস্তানি আর্মি এবং জালু রাজাকার বুবুকে আটকে রেখেছে। কান্নার শব্দ পেয়েছি। একদম বুবুর কণ্ঠ।
রবিনের কথা শোনার পর বাবলু ভাই এমনভাবে তাকাল যেন তার দুচোখে জ্বলছে প্রতিবাদের দাবানল। কয়েক ফোঁটা অশ্রুও ঝরতে দেখা গেল। সেগুলো অশ্রু নয়, আগুনের ফুলকি। কীভাবে আক্রমণ করা যায়, ভাবছেন তিনি। অনেক অপারেশন সফলভাবে সম্পন্ন করেছেন বাবলু ভাই। বাবলু মানেই শত্রু শিবিরে ত্রাস। কিন্তু আজ তার নিজের বোনকে বাঁচানোর অপারেশনে মাথাটা কেমন ঘুরপাক খাচ্ছে।
এমন সময় রবিন বলল, আমি একটা কথা বলি বাবলু ভাই?
‘কী কথা?’
‘একটা বুদ্ধি পেয়েছি।’
‘কী রকম?’
‘গ্রেনেডগুলো আমার কাছে দেন। আর দিপু আমার সঙ্গে থাকুক। আমরা জালু রাজাকারের বাড়ির দক্ষিণে বাঁশঝাড়ের কাছে কয়েকটি গ্রেনেড ছুড়ব। তার আগে আপনারা ওই বাড়ি থেকে বেরুনোর রাস্তা টার্গেট করে দুই দিকে অবস্থান নেবেন। গ্রেনেডের শব্দ শুনে নিশ্চয় ওরা বের হয়ে আসবে। তখনই গুলি চালাবেন।
‘ঠিক বলেছিস। তোর ছোট মাথায় এত বুদ্ধি!’ রবিনের পিঠ চাপড়ে বললেন বাবলু ভাই।
যেই কথা সেই কাজ। পজিশন নিলেন মুক্তিসেনারা। রবিন আর দিপু বাঁশঝাড়ের কাছে গিয়ে দুটি গ্রেনেডের বিস্ফোরণ ঘটাল। তারপর ওরা লুকিয়ে পড়ল খড়ের গাদায়। জালু রাজাকার আর পাকি পশুরা বের হয়ে গুলি ছুড়তে ছুড়তে এগুতে লাগল বাঁশঝাড়ের দিকে। সঙ্গে সঙ্গে পাল্টা গুলি ছুড়ল বাবলু ভাই এবং তার সহযোদ্ধারা। গুলি খেয়ে লেজ গুটিয়ে লুটিয়ে পড়ল জালু এবং পাকি হায়েনার দল।
জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে একত্রিত হলো সবাই। হায়েনাদের বিষাক্ত নখের আঁচড়ে আহত ময়না বুবুকে উদ্ধার করা হলো।
বাবলু ভাই রবিন ও দিপুকে বললেন, তোদের সাহস এবং বুদ্ধি দেখে আমি অবাক হয়েছি। রবিন, তুই আমাদের কিশোর কমান্ডার। সহকারী কমান্ডার হচ্ছে দিপু। স্যালুট রবিন! স্যালুট দিপু!