শুক্রবার, ২২ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

শরতের সাদা পরী

বৃষ্টি রানী

শরতের সাদা পরী

বৃষ্টি রানী গ্রামের নাম আরিশা। গ্রামের পাশেই ছোট একটি নদী ইছামতি। বর্ষা শেষে জেগে ওঠে চর। নদীর এপাশ ওপাশ শুধু কাশবন। কাশবনের ফুলগুলো এখনো পুরোপুরি ফোটেনি। আংশিক ফুটেছে। ইছামতি নদীর একটা গুণ আছে, সেটা হলো জেগেওঠা চর। চরের পাশেই আছে গাছের বাগানবাড়ি। এই বাগানবাড়িতে দর্শনার্থীদের উপচেপড়া ভিড় লেগেই থাকে। কচিকাঁচা থেকে শুরু করে আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা এই বাগানবাড়িতে আসে, কিছুটা অলস সময় কাটানোর জন্য। বাগানবাড়ির উপচে পড়া ভিড় লেগে থাকার কারণ ইছামতি নদীর সঙ্গে সংযুক্ত নদী। অনেকের মুখে শোনা যায়, কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এক সময় এখানে এসেছিলেন। তিনি একটি কবিতাও লিখেছিলেন। ইছামতির এই অবারিত সৌন্দর্য প্রশংসা করে যে কবিতাটি লিখেছিলেন—‘চিক চিক করে বালি, কোথাও নাই কাদা/ দুই ধারে কাশবন ফুলে ফুলে সাদা।’ হয়তো সে দিনে কবি গুরুর ভূয়সী প্রশংসা আজো কবিদের মনে নাড়া দেয়। তাই বিকাল হলে অনেকের পদচারণা এই বাগানবাড়িতে। কারও হাতে এক টুকরা কাগজ কবিতায় ছন্দ খুঁজে বেড়ায়। কারও আবার আলপনায় আঁকা আর্ট পেপার নদীর এপার ওপার জেগে ওঠা চর, কাশবন মনের মাধুরীতে রং মিশিয়ে ছবি আঁকে। অলস বেলা যখন পশ্চিমা লাল লাল আভায় এক ফালি সাদা মেঘের আড়ালে লুকায় তখন নীড়ে ফেরা পাখিগুলো উড়ে আপন নীড়ের দিকে গন্তব্য করে। সাদা সাদা বকগুলো ডানা দুলিয়ে কাশবনের গা ঘেঁষে উড়ে যায়।

মনে হয় আমার বাংলার রূপ আর মাধুর্য কোনো দিন শেষ হবে না। তাই তো কবিদের মনে নানা প্রশ্নের জন্ম দেয়। সাদা সাদা কাশবন শুধু ফুলে ফুলে নয়, আমার বাংলার মাধুর্য কোথাও যেন শেষ না হয়। যেখানে শেষ হয় সেখানেই জন্ম হয় ছয় ঋতু। ঘুরে আসে বসন্ত। জীবন জীবন্ত। ইছামতির দুই ধারে এখন শুধুই কাশবন। শরতের ছোঁয়া এই রূপসী বাংলাকে করেছে মোহিত। এই ইছামতিতে শরতের শেষে হয় নৌকাবাইচ প্রতিযোগিতা, ভুরবাইচ প্রতিযোগিতা। দর্শনার্থীদের এত উপস্থিতি কল্পনাও করা যায় না। একজন কবি বলেছেন, ভালো যদি থাকতে চান আসুন গাঁয়ের পথে। আজ কাশফুলের যৌবনের বাহার। ভুরবাইচ প্রতিযোগিতা একটা অনাবিল আনন্দের প্রতীক। সাত দিন যাবৎ এই ভুরবাইচ প্রতিযোগিতা চলে। দর্শকদের হাতের করতালি যেন কাশবনে বাতাসে দোল খায়। পবন বাতাসে হেলে-দুলে পড়া কাশবন মাঝিমাল্লাকে ফুরফুরে মনে বাউল গান, জারি গান গাইতে বলে। কাশবনের ফাঁকে ফাঁকে গায়ের নববধূরা, কুমারী মেয়েরা মাটির কলসি কাঁখে, নদীর জল ভরিতে যায়। পড়ন্ত বেলায় সূর্য ডুবু ডুবু, নদীতে ফেলে সোনালি ঢেউ। টেউয়ের দোলায় দুলতে থাকে মন মাঝিরা। কর্কশ গলায় বাওয়াইয়া গান গায়। সাত দিন চলে নৌকাবাইচ প্রতিযোগিতা। বাইজেরা যখন বৈঠা একতালে টানতে থাকে, কে কার আগে যাবে এ নিয়ে চলে উভয়পক্ষের জোড়তোড়। এপারে ওপারে দর্শকদের হাততালি মাতোয়ারা হয়ে যায় কাশবন। শরতের সাদা মেঘ আকাশে ভাসে। শুকনো শুকনো বাতাস যখন কাশবনের গায়ে দোলা দেয় তখন মনে হয় ছুঁয়ে দেখি কাশবন। দেখতে যদি চাও এসো আমার গায়ে। দেখতে পাবে শরতের রানী কাশফুল, সাদা সাদা ফুলে।

গ্রাম গাঁয়ের খোকা-খুকিরা এই কাশফুল তুলতে ভালোবাসে। নদীর সঙ্গে কাশফুলের যে সম্পর্ক তা আত্মায় আত্মায় বাধিত। এই সম্পর্ক শেষ হবে না কবু শেষ। জনম জনমের জন্ম। আসবে শরত, ফুটবে ফুল, হবে না এক ফোঁটা ভুল। নদী তার শেষ জলটুকু দিয়ে যেমন কাশবনকে আবার জাগিয়ে তোলে, কাশবন তেমনি তার অবারিত সৌন্দর্য দিয়ে নদীকে করে রূপ-লাবণ্য। মেঘ থাকে জলরাশিতে, পূর্ণ করে দেয় নদী, মোহনা, সাগর। কাশবন ছেয়ে যায় ফুলে। নদীর দুকূলে চাঁদভরা আকাশ, মিটি মিটি আলো মেলে দেয় দিগন্তের কোলে। এসো দেখি কাশবন, হয়ে যায় তার আপনজন।

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর