মায়ের একমাত্র সন্তান রাফি। পড়াশোনায় কাঁচা হলেও দুষ্টুমিতে ছিল পাকা। এক সময় ওর দুষ্টুমিটা মাত্রা ছেড়ে গিয়েছিল। বাবা-মা, স্যারদের কাউকে ভয় করত না সে। দস্যি ছেলেদের সঙ্গে বনে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানো আর পাখির বাসায় হানা দেওয়া যেন তার নেশায় পরিণত হয়েছিল। পাড়া-পড়শি সবাই তার দুষ্টুমিতে অতিষ্ঠ। স্কুলের সময় হলেই নানা তালবাহানা। মাথা ব্যথা, পেট ব্যথা ইত্যাদি ইত্যাদি। যেই নাকি স্কুলের সময়টা পেরিয়ে যেত তখনই রাফি উধাও। ওকে খুঁজে বের করতে হলে দশ পাড়া ঘুরতে হবে। একে-ওকে সওয়াল করতে হবে। অন্যথায় খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।
একদিনকার ঘটনা, রাফিকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। একে-ওকে জিজ্ঞেস করেও তার কোনো হদিস পাওয়া গেল না। ওকে খুঁজে না পেয়ে বাবা আজিজ সাহেব একরকম হতাশ হয়েই ফিরে এলেন বাড়ি। তখন সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত। আঁধারে ডুবে গেছে প্রকৃতি। ঘরের দরজা খোলা। বারান্দায় বসে কাঁদছেন রাফির আম্মু। রাফিকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, এ কথা শুনে স্কুলের স্যার-ম্যাডামরাও ছুটে এসেছেন রাফিদের বাড়ি। অনেকেই সান্ত্বনা দিচ্ছেন রাফির আম্মুকে।
কেউ কেউ সংশয় প্রকাশ করছে এ কথা বলে যে, ছেলে-ধরাদের কবলে পড়ল কী না? নানা মানুষ নানা কথা বলছে। এমন সময় কেউ একজন আসতেছে বলে অনুভব হলো। সবাই তাকিয়ে রইল আগন্তুকের পথ চেয়ে। উপস্থিত সবাইকে অবাক করে দিয়ে সবার সামনে এসে হাজির হলো রাফি। সবার চোখে-মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠল। কিন্তু বিপত্তি বাঁধা ওর বাবা জনাব আজিজ সাহেব। চোখ রাঙিয়ে বললেন এই চোকরা বয়স কত হয়েছে? এত রাত করে বাসায় ফিরলি যে? পড়াশোনা তো বাদই দিলে আর কতদিন এভাবে ঘুরে-ফিরে খাবে?আর কত আমাদের জ্বালাতন করে যাবি? তোর জন্য আজ সমাজে মুখ দেখানো কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে...
বাবার কথাগুলো শুনে কিছুক্ষণ চুপ থেকে এবার মুখ খুলল রাফি। কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল : বাবা আমার ভুল হয়ে গেছে। আমাকে ক্ষমা করে দাও। আজ বন্ধুদের সঙ্গে মিলে চৌধুরী বাড়ি গিয়েছিলাম ডাব চুরি করতে। ঘটনাক্রমে আমরা দারোয়ান বাবুর হাতে ধরা পড়ে যাই। কিন্তু আমি বোকা বলে আমাকে ফাঁসিয়ে পালিয়েছে বন্ধুরা। এজন্য দারোয়ান বাবু আমাকে সারা দিন আটকে রেখেছিল। বলেই হু হু করে কেঁদে উঠল রাফি। হেড স্যার এসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। ভালোবাসার পরশ মেখে দিলো। পরম মমতায় জড়িয়ে ধরে বলল : দেখলে তো রাফি বিপদ দেখে কীভাবে কেটে পড়ে বন্ধুরা। আসলেই বাস্তবতাটা এমনই। তাই তুমি আর ওদের সঙ্গে চলবে না। ওদের সঙ্গে খেলবে না। ওদের কথা শুনবে না।
প্রতিদিন স্কুলে যাবে। ভালো করে পড়াশোনা করবে। ভালো ছেলেদের সঙ্গে উঠাবসা করবে। বইকে বন্ধু বানিয়ে বইয়ের সঙ্গেই খেলবে। একদিন দেখবে তুমি অনেক বড় হয়ে গেছ। ভালো ফলাফল করে বাবা-মায়ের মুখ উজ্জ্বল করে দেবে। এলাকাবাসীও তোমায় নিয়ে গর্ব করবে।
এরপর...
এরপর আর কী? রাফি পড়াশোনায় মনোযোগ দিলো। ভালো ফলাফল করল। প্রাইমারিতে বৃত্তি পেল। পুরো উপজেলায় এক নম্বর হলো। সত্যি সত্যিই একদিন সে তার বাবা-মায়ের মুখ উজ্জ্বল করল। এলাকাবাসীও তাকে নিয়ে গর্ব করতে লাগল।