শুক্রবার, ২২ জুলাই, ২০২২ ০০:০০ টা
গল্প

পানকৌড়ির ভালোবাসা

মানজুর মুহাম্মদ

পানকৌড়ির ভালোবাসা

বাইরে টিপ টিপ বৃষ্টি পড়ছে। এমন বৃষ্টির দিনে সাগর মুখ গোমড়া করে ঘরে বসে আছে। সকাল থেকে তার মন খারাপ। সাগর জমিদার বাড়িতে কাজ করে। আজ সে জমিদার বাড়ি যায়নি। বৃষ্টি দিনে গ্রামের কিশোররা দল বেঁধে মাছ ধরছে। সাগরেরও মন চায় তাদের সঙ্গে মাছ ধরতে। কিন্তু ওরা সাগরের সঙ্গে মিশে না। কারণ সাগর জমিদার বাড়ির চাকর। গ্রামের কিশোর দলের লিডার হলো জমিদার বাড়ির ছেলে অপু। সাগর অপুর বয়েসী। সাগর অনেকবার অপুর সঙ্গে এবং অপুর দলের সঙ্গে মিশতে চেয়েছে, খেলতে চেয়েছে। অপুর বাবা অপুকে সাগরের সঙ্গে মিশতে ও খেলতে বারণ করে দিয়েছে। অপু তাই সাগরের সঙ্গে মিশে না।

সাগর হঠৎ করে বসা থেকে লাফিয়ে উঠল। এক দৌড়ে জমিদার বাড়ির পাশের বাঁশঝাড়ে গিয়ে একটি জুতসই কঞ্চি কেটে নিল। একটা সুতোর এক প্রান্তে বড়শি বাঁধল অন্য প্রান্তে কঞ্চির সঙ্গে বেঁধে নিল। মাঝখানে একটি শোলার ফাতনাও বেঁধে নিল। তারপর বাড়ির পেছনের আম বাগানে গেল। লাল পিঁপড়ার ডিমের জন্য। পিঁপড়ার বাসা থেকে সাগর দ্রুত লাল পিঁপড়ার ডিমগুলো কুড়িয়ে একটি পাতার চোঙ্গায় রাখল। লাল পিঁপড়ার ডিম পেয়ে সাগর খুব খুশি। কই মাছ ধরার জন্য এটি মোক্ষম টোপ।

সন্ধ্যা নাগাদ সাগরের মাছের ঝুড়ি কৈ মাছে ভরে উঠল। সাগরের মা কৈ মাছগুলো খুব যত্ন করে রান্না করল। সাগর মায়ের সঙ্গে পেট ভরে কৈ মাছ দিয়ে ভাত খেল।

ঘুমোতে যাওয়ার আগে সাগর মাকে বলল, ‘জমিদার বাড়িতে আমার কাজ করতে ইচ্ছে হচ্ছে না।’

মা বলল, ‘তোর বাবা মৃত্যুর আগে বলে গেছে জমিদার বাড়ি যেন তুই না ছাড়িস। ওই জমিদার বাড়ি তোর পূর্বপুরুষের।’

-‘আমার পূর্বপুরুষ কি জমিদার ছিল?’

-‘হ্যাঁ তোর বাবা তেমনই বলেছে।

-‘বাবা যখন সারা জীবন চাকর হিসেবে কাজ করে মরে গেছে। আমাকেও তেমন মরে যেতে হবে। জমিদার বাড়ি আর উদ্ধার করা হবে না। তাছাড়া জমিদার বাড়ি আমি একা কীভাবে উদ্ধার করব। আমাদের তো অর্থ বিত্ত লোকবল কিছুই নেই।’

মা সাগরের কানে কানে বলল, ‘তোর বাবা বলেছে, জমিদার বাড়ির উত্তরে যে বিশাল হাওর আছে সেখানে জমিদারদের সব ধনরত্ন ডুবে আছে। দস্যুরা জমিদার বাড়ি লুট করে ধনরত্নের সিন্দুক নিয়ে নৌকোয় করে রাতের আঁধারে পালানোর সময় প্রচণ্ড ঝড়ের কবলে পড়ে। সেই ঝড়ে নৌকাডুবি হয়।

সাগরের মা একটু থেমে আবার বলতে লাগল, ‘তোর বাবার বিশ্বাস ছিল জমিদারদের বংশধর হাওরের জলে সেই সিন্দুক খুঁজে পাবে এবং জমিদার বাড়ি উদ্ধার করবে।’

মায়ের কথা শুনে সাগর কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল, তারপর ঘুমুতে গেল।

সাগর হাওরের কাছে যখন যায়, তখন তার মায়ের কথা মনে পড়ে। এত বিশাল হাওরের কোথাও ডুবে আছে তার পূর্বপুরুষের ধনরত্ন ভরা সিন্দুক। সে ভাবে, সেই সিন্দুক যদি সে কখনো পায়, তখন সে জমিদার বাড়ি উদ্ধার করবে।

সাগর ভাবে পানকৌড়ির মতো যদি সে ডুব দিয়ে পানির নিচে গিয়ে অনেকক্ষণ থাকতে পারত, তবে কোনো না কোনোদিন সে ওই সিন্দুক খুঁজে পেত। সাগর তাই সব সময় পানকৌড়িদের ডুবসাঁতার দেখে। সাগরের খুব ইচ্ছে হয়, পানকৌড়ির মতো ডুবুরি হতে। সাগর তার এই ভাবনার কথা মাকে বলে। মা ফিক করে হেসে বলল, ‘মানুষ তো কখনো পানকৌড়ির মতো ডুবুরি হতে পারবে না। তুই চেষ্টা করে দেখতে পারিস।’

সাগর একদিন বাঁশ বাগান থেকে পানকৌড়ির একটি ছানা নিয়ে আসে ঘরে। ছানাটিকে সে আদর যত্ন দিয়ে ধীরে ধীরে বড় করে তুলে। ছানাটি তাদের বাড়ির পুকুরে সাঁতার কেটে মাছ ধরে খায়। সাগর পানকৌড়ির ছানার সঙ্গে প্রতিদিন অনেক কথা বলে। ধীরে ধীরে সাগর আর ছানাটির মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে উঠল। পানকৌড়ির ছানাটি ধীরে ধীরে বড় হলো।

সাগর বন্ধু পানকৌড়িকে আদর করে পানু বলে ডাকে। পানু পানু করে ডাক দিলে যেখানেই থাকুক সাগরের কাছে সে দৌড়ে চলে আসে। সাগর পানুর সঙ্গে বাড়ির পুকুরে ডুবসাঁতার প্রাকটিস করে। মাঝে মাঝে পানুর সঙ্গে ডুবসাঁতার প্রতিযোগিতা করে। পানু অনেকক্ষণ পানিতে ডুবে থাকতে পারে। সাগরও তেমন ডুবে থাকার চেষ্টা করে।

জমিদারের ছেলে অপু ডুবসাঁতার খেলার সময় একটি বিশেষ চশমা পরে। সাগর ভাবল, পানির নিচে ওই চশমা দিয়ে দেখা যায়। অপুর এমন কয়েকটি চশমা আছে। একদিন সাগর অপুর কাছে একটি চশমা চাইল। অপু বলল, ডুবসাঁতারে আমার সঙ্গে জিতলে তবে পাবে। অপু খুব ভালো ডুবসাঁতার জানে। অপু নিশ্চিত ছিল সে সাগরকে হারিয়ে দেবে। কারণ গ্রামের কোনো কিশোর আজ পর্যন্ত অপুকে হারাতে পারেনি। কিন্তু সাগর ডুব-সাঁতারে অপুকে হারিয়ে দিল। অপু কথামতো সাগরকে সাঁতারের চশমা দিল।

সাগর এখন পানুকে নিয়ে হাওরে ডুবসাঁতার দেয়। একেক দিন হাওরের একেক জায়গায় নামে সে। পানির নিচে সে সাগরের আগে আগে থাকে।

গত কায়েকদিন ধরে সাগরের খুব মন খারাপ। জমিদার ঘোষণা দিয়েছে জমিদার বাড়ির দক্ষিণের বাঁশ ঝাড়ের বিশাল বনটি কেটে ফেলা হবে।

এই কথা শোনার পর থেকে সাগরের মন খুব অস্থির হয়ে ওঠে। বাঁশঝাড়ে শত শত পাখির বাসা। ঘাসবনেও শত শত মাঠের পাখির বাসা। টিলাগুলোর গাছে গাছে বন বাগানের পাখিরা বসবাস করে। দীর্ঘদিন ওই পাখিগুলো সেখানে বসবাস করছে। পাখিগুলো ডিম, ছানা নিয়ে কোথায় যাবে? নিজের মনের এই প্রশ্নে সাগর বারবার বিচলিত হয়ে উঠছে।

বাঁশঝাড়, ঘাসবন ও টিলা উজাড় হওয়ার কথা শোনার পর থেকে সাগর জমিদার বাড়িতে আর কাজে যায়নি।

পরের দিন সকালে সাগর পানুকে নিয়ে হাওরের দক্ষিণে নেমে পড়ল। চোখে সাঁতারের বিশেষ সেই চশমা লাগিয়ে ডুব দিল। পানির ভিতর দিয়ে সকালের সূর্যের আলো এসে পড়েছে শ্যাওলার বনে। শ্যাওলাগুলো পানির ভিতরে দুলে উঠছে। সাগর শ্যাওলার ঘনবনে প্রবেশ করে আঁতিপাতি করে তার পূর্বপুরুষের ধনরত্নের সিন্দুক খুঁজতে লাগল।

সকাল গড়িয়ে দুপুর হলো। দুপুর গড়িয়ে বিকাল। সাগর এখনো হাওরের দক্ষিণে পানির নিচে শ্যাওলার ঘন বনে সিন্দুক খুঁজছে। পানির নিচে তার সামনে পানু এগিয়ে যাচ্ছে। সে পানুর পিছু পিছু শ্যাওলার ঘন বনে সাঁতার কাটছে। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে প্রায়। হাওরের জলের নিচে আলোও কমে এসছে। সাগর হঠাৎ দেখল পানু একটি শক্ত কিছুতে ঠোকর দিচ্ছে। সাগর একটু দূরে ছিল। সে সাঁতরে গিয়ে দেখল শ্যাওলা জড়ানো একটি চৌকো কিছু। সাগর মনে করল কোনো বড় চার কোনা পাথর হবে হয়তো। সে কাছে গিয়ে দেখল, পানু যেখানে ঠোকর দিচ্ছে তা শ্যাওলা মোড়ানো একটি ধাতব কিছু। সাগর সেই ধাতব খণ্ডের শ্যাওলা পরিষ্কার করে দেখল- একটি পুরনো তালা। সাগর বুঝল, চৌকো খণ্ডটি পাথর নয়, এটা সেই সিন্দুক। সাগর তালার ওপরের শ্যাওলা ভালো করে পরিষ্কার করল। তারপর তালাটি শক্ত করে ধরে হ্যাঁচকা টান দিল। একটানেই তালা ভেঙে তার হাতে চলে এলো। দীর্ঘদিন পানির নিচে থাকায় তালাটি জংয়ে ক্ষয়ে গেছে। সাগর সিন্দুকের ঢাকনি খুলে দেখল, সিন্দুকের ভিতরটা ধনরত্নে ভরপুর।

সাগর যখন হুস করে পানির ওপরে উঠল তখন পশ্চিমাকাশের সূর্যের আলো নিবু নিবু প্রায়। পানির ওপরে উঠেই সে চিৎকার দিয়ে বলল, ‘বাপজান তোমার কথা সত্য। আমি সিন্দুক পেয়েছি।’ সাগরের কথাগুলো জনমানব শূন্য হাওরের চারদিকে ছড়িয়ে গেল।

সাগরের হাওর থেকে ঘরে ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে গেছে। ঘরে পৌঁছেই মাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘মা সিন্দুক পেয়ে গেছি।’

মা নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারল না।

মা বলল, ‘কী বললি?’

সাগর ধীরে ধীরে সব খুলে বলল।

মা অধৈর্য হয়ে বলল, ‘সিন্দুকের ভিতর কী দেখলি?’

-‘অনেকগুলো স্বর্ণের টুকরা, একটি স্বর্ণের মুকুট, কিছু রুপার মুদ্রা, একটি তরবারি, কয়েকটি উজ্জ্বল পাথর। আমি হাতের মুঠোয় দুটি স্বর্ণের টুকরা নিয়ে এসেছি।’

এই বলে সে মুঠি খুলে স্বর্ণের টুকরা দুটি মায়ের হাতে তুলে দিল। মা স্বর্ণের টুকরা দেখে অবাক হয়ে বলল, ‘এগুলো সত্যি স্বর্ণের টুকরা?’

‘হ্যাঁ মা, এগুলো সত্যি সত্যি জমিদারদের ধনরত্ন।’

পরদিন সাগরকে নিয়ে তার মা ঢাকা গেল। ঢাকায় এক স্বর্ণের দোকানির কাছে গিয়ে স্বর্ণের টুকরা দুটো দেখিয়ে সাগরের মা দাম জানতে চাইল। দোকানি প্রথমে স্বর্ণ খাঁটি কিনা তা পরীক্ষা করে দেখল। তারপর টুকরা দুটি মেপে বলল, ‘তোমরা এগুলো কোথায় পেয়েছ।’

সাগর বলল, ‘টুকরা দুটোর দাম কত?’

-‘প্রতি টুকরা ১০ লাখ টাকা।’

 -‘আপনি কিনবেন?’

 -‘হ্যাঁ কিনব।’

সাগর মায়ের সঙ্গে পরামর্শ করে স্বর্ণের টুকরা দুটো দোকানির কাছে বিক্রি করল।

সাগর একদিন একজন দলিল রেজিস্ট্রার নিয়ে জমিদার বাড়ি গিয়ে দক্ষিণের বাঁশবাগান, তার পরের ঘাসবনের মাঠ এবং পশ্চিমের টিলার জায়গাগুলো কিনে ফেলল।

সাগর পানকৌড়িদের জন্য হাওরের পাড়ে বিশাল জায়গা জুড়ে নতুন করে বাঁশবাগান তৈরি করল এবং নাম দিল ‘পানকৌড়ি-ভুবন’।

পানকৌড়ি পানুর ভালোবাসায় সাগরের জীবন সুন্দর হয়েছে। সাগর পানুকে নিয়ে প্রতিদিন হাওরে ডুবসাঁতার খেলে। হাওরের জলের পাখিরা সাগরকে ভয় পায় না। তাই তারা সাগরকে দেখে উড়ে পালায় না। তারা জানে, সাগর পাখিপ্রেমিক মানুষ। জলের পাখিরাও সাগরকে ভালোবাসে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর