শুক্রবার, ১১ আগস্ট, ২০২৩ ০০:০০ টা
গল্প

মেঘ প্রাসাদ

সারমিন ইসলাম রত্না

মেঘ প্রাসাদ

ঘন কালো মেঘে ছেয়ে গেল আকাশ। ঝুমঝুম বৃষ্টি নামলো। রাজকন্যা মেঘা নাচতে শুরু করল। বৃষ্টির তালে তালে গাইতে শুরু করল। আকাশ ভরা মেঘের ভেলা, ঝুম ঝুমা ঝুম দারুণ খেলা। আজকে আমি বাঁধন হারা, বৃষ্টি সুখে পাগল পারা। যাবো উড়ে হাওয়ায় ভেসে, আকাশ পাড়ে মেঘের দেশে। মেঘের পায়ে সোনার নূপুর টাপুর টুপুর টাপুর টুপুর।

গান শুনে রানি চমকে উঠলেন! রাজা ঈশান কর্মে ব্যস্ত ছিলেন। এমন সময় বার্তাবাহক এসে বলল, হে জাঁহাপনা, ক্ষমা করুন অসময়ে আসার জন্য। রানি মা বার্তা পাঠিয়েছেন। রাজা ঈশান হঠাৎ কেমন হয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ নির্বাক থেকে প্রশ্ন করলেন, হে বার্তাবাহক, বল কী বার্তা এনেছ? বার্তাবাহক বলল, রাজকন্যা মেঘা বৃষ্টিতে ভিজছেন। বৃষ্টির তালে তালে নাচ করছেন। গান করছেন। অদ্ভুত সেই গানের কথা। তিনি মেঘের দেশে যেতে চান। রাজা বিদ্যুতের মতো গর্জে উঠলেন। কে কোথায় আছ? রাজকন্যা মেঘাকে প্রাসাদে নিয়ে যাও।

রাজকন্যা মেঘা প্রাসাদবন্দি হলো। মেঘা ছটফট করতে লাগল। মেঘা বুঝতে পারছে না তার কী অপরাধ? কেন তাকে বন্দি করা হলো? রানি রাজকন্যাকে জড়িয়ে ধরলেন। আকুল কণ্ঠে বললেন, সোনা মেয়ে আমার, তুমি এই বুকেই থাকবে। রাজকন্যা মেঘা বলল, মা, দয়া করে বুঝতে চেষ্টা কর। আমি কিছুতেই নিজেকে ধরে রাখতে পারছি না। কেন এমন হচ্ছে জানি না। আগামীকাল রাজকন্যা মেঘার ১৮ বছর পূর্ণ হবে। সেই উপলক্ষে আয়োজন চলছে।

রাজা সিংহাসনে বসে আছেন। আপন মনে ভাবছেন, আরও কীভাবে প্রিয় রাজকন্যাকে আনন্দ দেওয়া যায়। এমন সময় বার্তাবাহক এসে বলল, হে জাঁহাপনা, ক্ষমা করুন। রানিমা বার্তা পাঠিয়েছেন। রাজা উৎসুক হয়ে বললেন, হে বার্তাবাহক, দ্রুত ব্যক্ত কর। বার্তাবাহক বলল, হে জাঁহাপনা, রাজকন্যা মেঘা বলেছেন, তিনি কিছুতেই নিজেকে ধরে রাখতে পারছেন না। রাজা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে গেলেন। যখন যা ঘটার ঘটবে। কিন্তু মন মানতে পারছে না। রাজা ঘোষণা করলেন, রাজকন্যা মেঘা কিছুতেই যেন বাইরে যেতে না পারে। প্রাসাদের চারপাশে পাহারা বসানো হলো।

পাহারা দেখে রাজকন্যা হাসতে লাগল। অদ্ভুত সেই হাসি। রাজা-রানি চমকে উঠলেন! সময় ঘণ্টা বাজল। রাজা-রানি উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন, হে প্রিয় রাজকন্যা মেঘা, রাত ১২ বাজল। তোমার ১৮ বছর পূর্ণ হলো। শুভ জন্মদিন তোমাকে। হঠাৎ আকাশ কাঁপিয়ে বিদ্যুৎ চমকালো। সেই বিদ্যুতের ঝলকে প্রাসাদের সব আলো নিভে গেল। রাজা রানির চোখে অশ্রু জমে উঠল। রাজকন্যা মেঘা বলল, তোমরা কেঁদো না। আমি যাচ্ছি মেঘের দেশে। পথ আমার জানা নেই। রানি কাঁদতে কাঁদতে বললেন, তুমি যাও সোনা মেয়ে আমার। অনুমতি রইল। রাজার কণ্ঠ ভারী হয়ে এলো। নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, সোনা মেয়ে আমার, বহু আদরে তোমায় বড় করেছি। নিয়তির লিখন খন্ডানো যায় না। তুমি যাও।

রাজকন্যা আর্তনাদ করে উঠল। প্রিয় বাবা মা, কী বলছ তোমরা? দয়া করে সত্য জানাও। ওমনি বৃষ্টি শুরু হলো। রাজকন্যা মেঘা নিজের অজান্তেই হাত দুটো শূন্যে মেলে দিল। মেঘপরীরা অপেক্ষা করছে। রাজকন্যা মেঘাকে দেখেই মেঘপরীরা হাসিমুখে বলল, হে রাজকন্যা, স্বাগতম সুস্বাগতম। রাজকন্যা অবাক হয়ে বলল, আমি কোথায় এসেছি? তোমরা আমাকে কেন আহ্বান জানিয়েছ? পরীরা বলল, হে রাজকন্যা, ক্ষমা করুন। আপনি এখন মেঘের দেশে। মেঘ প্রাসাদে আছেন। রাজকন্যা চমকে উঠে বলল, কিন্তু কেন?

মেঘরানি উপস্থিত হলেন। রাজকন্যা মেঘা রানিকে সম্মান জানিয়ে বলল, হে শ্রদ্ধেয় রানি, আমাকে কেন আহ্বান জানানো হয়েছে? দয়া করে বলুন। আমার বাবা-মা খুব কষ্ট পাচ্ছেন। মেঘ রানি ব্যথিত হয়ে বললেন, শান্ত হও- রাজকন্যা। শক্ত হও। যারা তোমাকে বড় করেছেন তারা তোমার বাবা-মা নন। তারা দুঃখী মানুষ। স্রষ্টার কাছে সন্তানের জন্য প্রার্থনা করতেন। আমার খুব মায়া হলো। আমার সখীকে বললাম, হে প্রিয় সখী, তোমার সাতজন মেঘ কন্যা রয়েছে। তাদের মধ্য থেকে একজনকে পৃথিবীতে পাঠাও। নিঃসন্তান রাজা-রানির কাছে। তারা কষ্টে দিনযাপন করছেন। সখী রাজি হলো এবং তোমাকে পৃথিবীতে নিয়ে গেল। দুঃখী রাজা-রানি তোমাকে পেয়ে খুশি হলেন। তাদের একটি শর্ত দেওয়া হলো। তুমি কালো মেঘপরী। সময় হলেই পৃথিবীর কল্যাণের জন্য ঝরে পড়বে। তোমাকে অনুমতি দিতে হবে। রাজা-রানি আপ্লুত হয়ে বললেন, ভালো কাজ। কষ্ট হবে। তবু অনুমতি দেব।

রাজকন্যা মেঘা ঝরঝর করে কাঁদতে লাগল। কাঁদতে কাঁদতে বলল, তার মানে আমি মানুষ নই। মেঘ পরী। মেঘরানি বললেন, হ্যাঁ তুমি মেঘপরী। মেঘপরীরা বাতাস থেকে জলকণা শুষে বড় হয়। পরিণত বয়স হলেই ঝরে পড়ে। তুমিও ঝরে পড়বে। রাজকন্যা মেঘা আর্তনাদ করে উঠল। আমি জীবন বিলিয়ে দিতে চাই না। আমি বাঁচতে চাই। মেঘ রানি বললেন, তোমার জন্মই হয়েছে পৃথিবীর কল্যাণের জন্য। এত স্রষ্টার সন্তুষ্টিই।

ভোরের লাল আভা ছড়িয়ে পড়ল। পাখিরা কিচিরমিচির গান ধরলো। রাজা-রানি ঘুম থেকে জাগলেন। প্রতিদিনের মতো বাগানে হাঁটতে বের হলেন। হঠাৎ মেঘের গর্জন। রাজা-রানি আকাশের দিকে তাকালেন। কালো মেঘে ছেয়ে গেছে আকাশ। মেঘের ভিতর রাজকন্যা মেঘা। নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার আনন্দে সে আত্মহারা। মেঘা বৃষ্টি হয়ে ঝরতে শুরু করল। সেই বৃষ্টিতে সিক্ত হলো পৃথিবী। সিক্ত হলো রাজা-রানির দুঃখী মন। পৃথিবী আলো করে একটি শিশুর জন্ম হলো। শিশুটি দুঃখী রাজা-রানির। শিশুটি চোখের ভাষায় বলল, প্রিয় বাবা-মা, পৃথিবীর কল্যাণে তোমরা যা কিছু করেছ, তা অতুল্য। তাই স্রষ্টা আমাকে উপহার পাঠিয়েছেন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর