শুক্রবার, ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা
গল্প

বুড়ো ইঁদুরের স্বপ্ন

কানিজ ফাতেমা

বুড়ো ইঁদুরের স্বপ্ন
সোলই ইঁদুরটি ও ভংড়া ইঁদুর বেরিয়ে পড়ল গ্রামের পথে। কিংকর গ্রামের পথটি দেখে মুগ্ধ হয়ে গেল সোলই ইঁদুর। এত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন কোথাও কোনো আবর্জনা নেই। কিংকর গ্রামের ভিতর দিয়ে হাঁটতে গিয়ে সোলই ইঁদুর খেয়াল করল- গ্রামের প্রতিটি বাড়ির আঙিনাতে বিভিন্ন রকমের ফলের ও সুন্দর সুন্দর গুল্ম জাতীয় গাছের সমারোহ এবং গ্রামের ইঁদুররাও বেশ সুশৃঙ্খল পথ দিয়ে সারিবদ্ধভাবে হেঁটে চলেছে।

পদ্মা নদীর এক তীর ঘেঁষে গড়ে ওঠা গোলাপনগর গ্রামের উত্তর পাশের দরদিয়া খালের তীরে ইঁদুরদের সড়াই গ্রাম। এই গ্রামের ইঁদুরদের মোড়ল ছিল সবচেয়ে বয়স্ক ও বুদ্ধিমান সোলই ইঁদুর। সোলই ইঁদুর বুদ্ধিমান বটে কিন্তু তার গ্রামের ইঁদুররা ছিল নেহায়েতই মূর্খ। তারা খুবই অগোছালো এবং বিশৃঙ্খলভাবে চলাফেরা করত। সোলই ইঁদুরের আদেশ-উপদেশ সবাই শুনত কিন্তু একেবারেই মানত না। ফলে সোলই ইঁদুর কোনোভাবেই সড়াই গ্রামকে নিজের স্বপ্নের মতো সাজিয়ে উঠতে পারছিলেন না।

সোলই ইঁদুর কিছুতেই গ্রামের অন্য ইঁদুরদের শেখাতে পারছিল না তারা কীভাবে তাদের গ্রামটিকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে পারে। গ্রামের মূর্খ ইঁদুররা বিশৃঙ্খলভাবে খাবার খেত আর উচ্ছিষ্টগুলো যেখানে সেখানে ফেলে চলে যেত। এমন কি নিজেদের ঘরগুলোও পরিষ্কার করত না। ফলে দিন দিন সড়াই গ্রামটিকে আবর্জনার স্তূপ মনে হতে লাগল। তাছাড়া পরিকল্পনামাফিক না চলায় ইঁদুরদের খাদ্যের অভাবও দেখা দিত। ফলে বুড়ো সোলই ইঁদুর মনে মনে কষ্টে ছিল এবং একসময় নিজেকে দোষী ও অযোগ্য ভাবত।

সে সড়াই গ্রামের ইঁদুরদের মোড়ল। তবুও তার প্রিয় গ্রামকে সুন্দর করে গড়ে তোলার কোনো পরিকল্পনাই সফল করতে পারছে না। কথাগুলো ভেবে সোলই ইঁদুর দিন দিন বিষণ্নতায় ভুগতে লাগল। বিষণ্ন মনে একদিন সোলই ইঁদুর ভাবল সে একজন ব্যর্থ মোড়ল। তাই তার সড়াই গ্রাম থেকে চলে যাওয়া উচিত।

সেই ভাবনা মতোই সোলই ইঁদুর তার সব প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গুছিয়ে ছোট্ট পোটলা করে নিল। তারপর পোটলাটা একটি লাঠির সঙ্গে বেঁধে সড়াই গ্রামের পাশের দরদিয়া খালের ধার দিয়ে হাঁটতে শুরু করল। হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা পথ পেরিয়ে এসে সে খুব ক্লান্ত হয়ে পড়ল। এদিকে সকালও হয়ে যাওয়াতে সামনে এগিয়ে যাওয়ারও সাহস পেল না, যদি মানুষ দেখে ফেলে কিংবা বিড়ালের সামনে পড়ে! তাহলে প্রাণটাই যাবে।

ভীষণ ভাবনায় পড়ে গেল সোলই ইঁদুর। কিন্তু থেমে যাওয়াও যাবে না। তাই খুব সতর্কভাবে এগিয়ে যেতে লাগল সে। আরও কিছুদূর এগিয়ে যেতেই হঠাৎ তার নাকে খুব পরিচিত একটা গন্ধ এসে লাগল। সে উৎসাহী হয়ে চারপাশে তাকিয়ে দেখতে লাগল। ইঁদুরদের শরীরে গন্ধ। এর অর্থ আশেপাশে কোথাও ইঁদুরদের গ্রাম আছে এবং সে গন্ধ শুঁকে শুঁকে এগিয়ে এসে একটি ইঁদুরের বাড়ির সামনে উপস্থিত হলো। যদিও খুব ক্লান্ত সোলই ইঁদুর তরপরও একটু গলা ছেড়ে ডেকে উঠল সে-

‘কেউ কি বাড়িতে আছেন? আমার একটু রাত কাটাবার জন্য থাকবার জায়গার প্রয়োজন।’

তার গলার আওয়াজ পেয়ে বাড়ির দরজা খুলে বেশ সুঠাম দেহের একটি ইঁদুর বাইরে বেরিয়ে এলো। সোলই ইঁদুরকে দেখে সে জিজ্ঞাসা করল-

‘কে আপনি? আর আমার কাছে কী কারণে এসেছেন?’

‘আমি সড়াই গ্রামের ইঁদুরদের মোড়ল সোলই ইঁদুর। একটু ঘুরতে বেরিয়েছিলাম। কিন্তু এই গ্রামের কাছাকাছি আসতেই সকাল হয়ে গেল। তাছাড়া আমি প্রচণ্ড ক্লান্ত ও ক্ষুধার্ত, পথ চলতেও খুব কষ্ট হচ্ছে। তাই সারা দিনের জন্য আমার একটু আশ্রয়ের প্রয়োজন। সন্ধ্যে হলেই আমি চলে যাব।’

সোলই ইঁদুরকে দেখে এবং তার কথা শুনে সুঠাম দেহের ইঁদুরটি বলল-

‘আপনি অবশ্যই আশ্রয় পাবেন এবং আপনি এখন যেখানে দাঁড়িয়ে আছেন সেটি ইঁদুরদের কিংকর গ্রামের মোড়ল ভংড়া ঈঁদুরের বাসা। আপনি আর কোনো চিন্তা করবেন না এবং আমার আতিথেয়তা গ্রহণ করুন। দয়া করে আমার সাথে ভিতরে আসুন।’

ভংড়া ইঁদুর সোলই ইঁদুরকে সঙ্গে করে তার বাড়ির মধ্যে নিয়ে গেল এবং একটি ঘাস দিয়ে তৈরি সুন্দর বিছানায় বসতে দিল। সোলই ইঁদুর ভংড়া ইঁদুরের ব্যবহারে ভীষণ খুশি হলো। এবার ভংড়া ইঁদুর বলল-

‘আপনি একটু আরাম করুন, আমি আপনার জন্য খাবারের ব্যবস্থা করে ফিরে আসছি’- বলে ভংড়া ইঁদুর ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। যাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই একটি বড় পাতায় করে বিভিন্ন রকমের সুস্বাদু এবং রসালো রঙিন ফল ও কিছু শস্যদানা নিয়ে আবার ফিরে এলো ভংড়া ইঁদুর।

সোলই ইঁদুর এত সুন্দর ফল আগে কখনো দেখেনি। তাদের গ্রামের জঙ্গলে এগুলো পাওয়া যায় না। তাই সে খুব অবাক হলো। সে খুব উৎসাহ নিয়ে ভংড়া ইঁদুরকে জিজ্ঞাসা করল-

‘এত সুন্দর ও সুস্বাদু ফল কোথায় পেলেন আপনি? আমাদের গ্রামে এসব ফল কখনো দেখিনি।’

ভংড়া ইঁদুর হেসে উত্তর দিল-‘এগুলো সব আমাদের গ্রামের ইঁদুরদের বাড়িতে উৎপাদিত ফল ও সংগ্রহ করা শস্যদানা।’

সোলই ইঁদুর তার কথা শুনে বেশ অবাক হলো যে, ইঁদুররা এসব ফল উৎপাদন করেছে? কীভাবে সম্ভব? সোলই ইঁদুরের খুব আগ্রহ হলো ভংড়া ইঁদুরের গ্রামটি ঘুরে দেখার এবং সে তখনই ভংড়া ইঁদুরকে অনুরোধ করে বসল তার গ্রামটি ঘুরে দেখানোর জন্য। ভংড়া ইঁদুর খুশি মনে বলল-

‘আপনি আমার অতিথি। আমি আপনাকে আমাদের গ্রামটি ঘুরিয়ে দেখাব। আপনি ক্লান্ত। খাবার খেয়ে ঘাসের নরম বিছানায় বিশ্রাম করুন। সন্ধ্যায় এসে আমি আপনাকে নিয়ে আমাদের গ্রামটি ঘুরে দেখাব।’

কথাগুলো বলে ভংড়া ইঁদুর খাওয়া শেষ করে তার নিজের ঘরে বিশ্রাম করতে চলে গেলেন।

সোলই ইঁদুরেরও চোখজুড়ে ঘুম আসতে লাগল। তাই সেও ঘাসের নরম বিছানায় ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুম ভাঙতে ভাঙতে একেবারে সন্ধ্যা। ঘুম থেকে জেগেই ঘরের বাইরে এসে সে দেখতে পেল ভংড়া ইঁদুর তার জন্য বাইরে অপেক্ষা করছে। সোলই ইঁদুরকে দেখেই সে বলল- ‘মহামান্য অতিথি আপনি আমাদের গ্রামটি দেখতে চেয়েছিলেন, তাই এখন যদি আপনি যেতে চান তো আমি আপনাকে নিয়ে সারাটি গ্রাম ঘুরে দেখাতে পারি।’

সোলই ইঁদুর উচ্ছ্বাস নিয়ে বলে উঠল-

‘আমাকে একটু সময় দিন, আমি আমার পোটলাটা নিয়েই চলে আসছি।’

সোলই ইঁদুর দ্রুত ঘরে গিয়ে লাঠির সঙ্গে বাঁধা পোটলাটা নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। তারপর সোলই ইঁদুর ও ভংড়া ইঁদুর বেরিয়ে পড়ল গ্রামের পথে। কিংকর গ্রামের পথটি দেখে মুগ্ধ হয়ে গেল সোলই ইঁদুর। এত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন কোথাও কোনো আবর্জনা নেই। কিংকর গ্রামের ভিতর দিয়ে হাঁটতে গিয়ে সোলই ইঁদুর খেয়াল করল- গ্রামের প্রতিটি বাড়ির আঙিনাতে বিভিন্ন রকমের ফলের ও সুন্দর সুন্দর গুল্ম জাতীয় গাছের সমারোহ এবং গ্রামের ইঁদুররাও বেশ সুশৃঙ্খল পথ দিয়ে সারিবদ্ধভাবে হেঁটে চলেছে।

সোলই ইঁদুর বেশ উচ্ছ্বসিত হয়ে ভংড়া ইঁদুরকে জিজ্ঞাসা করল-

‘আপনি কীভাবে আপনার গ্রামটিকে এত সুন্দর করে সাজানো গোছানো করলেন?’

‘আমি একা করিনি আর আমার একার পক্ষে সম্ভবও নয়।’- ভংড়া ইঁদুর উত্তর দিল।

‘তবে আমাদের এই গ্রামের সকলের জন্য আমরা কয়েকটা সাধারণ নিয়ম চালু করে রেখেছি- যেটা সকলে মেনে চলে।’

‘কেমন নিয়ম?’- সোলই ঈঁদুর জিজ্ঞাসা করল।

‘যেমন আমাদের গ্রামের প্রতিটি ইঁদুর তাদের বাড়ির চারপাশটা পরিষ্কার রাখতে বাধ্য। এই গ্রামে নিয়ম করা আছে- প্রতি তিন মাস পর পর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন কমিটি সকল বাড়ির চারপাশ পরিদর্শন করতে যাবে। কারও বাড়ির আশেপাশে যদি কোনো আবর্জনা থাকে তবে তাকে সে জন্য জরিমানা দিতে হবে। তাছাড়া বছরের শেষে আমরা সবচেয়ে সুন্দর করে সাজানো গোছানো এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন বাড়ির মালিক ইঁদুরকে পুরস্কার দিয়ে সম্মান জানিয়ে থাকি। ফলে তাদের এ বিষয়ে আগ্রহ অনেক বেড়ে যায়।’

সোলই ইঁদুরের ভংড়া ইঁদুরের গ্রামের নিয়মটি খুব পছন্দ হলো। এবার সে আবারও উৎসাহী হয়ে ভংড়া ইঁদুরকে জিজ্ঞাসা করল-

‘কিন্তু গ্রামের আবর্জনা পরিষ্কার করার পর সেগুলো কোথায় ফেলা হয়?’

ভংড়া ইঁদুর বলল- আমাদের প্রত্যেক ইঁদুর তার বাড়ির চারপাশটা পরিষ্কার করার পর যে আবর্জনা জমা হয় সেগুলো এবং প্রতিদিনের কাজের ফলে সৃষ্ট আবর্জনাগুলোকে বাড়ির অঙিনার এক পাশে গর্ত করে মাটির নিচে পুঁতে রেখে দেয়। এতে আমাদের দুটি উপকার হয়। একদিকে গ্রাম পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকে অন্যদিকে আবর্জনাগুলো মাটির নিচে পচে জৈব সারে রূপান্তরিত হয়, যা আমরা চাষের কাজে ব্যবহার করে থাকি।’

‘এত খুবই ভালো ব্যবস্থা’।

সোলই ইঁদুর উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে উঠল- ‘ভাই ভংড়া আমাকে একটু বলুন, এত ভালো ভালো খাবারের ব্যবস্থা আপনারা কী করে করলেন?’

ভংড়া ইঁদুর বলল- ‘আমরা সকলে আমাদের বাড়ির আঙিনায় বিভিন্ন রকমের ফলের বাগান করে রেখেছি। সাধারণত এই গ্রামের ইঁদুররা কোনো নতুন এবং সুস্বাদু ফল খেলে সেই বীজটি সংগ্রহ করে নিয়ে আসে এবং বাড়ির অঙিনায় রোপণ করে। ফলে এখানে প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই নানা রকম ফলের গাছ আছে এবং আমরা সেই সকল ফলমূল সবাইকে দিয়ে খেতে পছন্দ করি। তাছাড়া যখন মানুষ ফসল কাটা শেষ করে চলে যায় তখন আমরা একসাথে সেখান থেকে শস্যদানা সংগ্রহ করি এবং সকলকে যার যার পরিশ্রমের ভিত্তিতে ভাগ করে দিই। ফলে সারা বছর আমাদের খাদ্যের অভাব হয় না।’

সোলই ইঁদুরের ভংড়া ইঁদুরের কিংকর গ্রামের সব ব্যবস্থা খুব পছন্দ হলো এবং সে বুঝতে পারল যে তাকেও তার গ্রামের সবাইকে একত্রিত করতে হবে। তবেই তার গ্রামটিও একটি সুন্দর সাজানো গোছানো এবং সমৃদ্ধ গ্রাম হবে। এরপর বুড়ো সোলই ইঁদুর ভংড়া ইঁদুরের থেকে বিদায় চাইল এবং আবার খালের তীর দিয়ে হেঁটে হেঁটে সড়াই গ্রামে ফিরে এলো। ফিরে এসেই সভা ডেকে সড়াই গ্রামের সব ইঁদুরকে নিয়ে একটি সাজানো গোছানো সুন্দর গ্রাম গঠনের জন্য কাজ শুরু করল।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর