শুক্রবার, ৬ অক্টোবর, ২০২৩ ০০:০০ টা

উল্টো দেশের রাজা

সারমিন ইসলাম রত্না

উল্টো দেশের রাজা

রাজ্যের নাম শান্তপুর। রাজার নাম এহসান। রাজা এহসান সর্বদাই অভিনব ভাবনা ভাবেন। রাজার ভাবনার বহিঃপ্রকাশ ঢাকঢোল বাজিয়ে প্রজাদের জানান দেওয়া হলো। হে প্রিয় প্রজারা, আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। আমাদের রাজা এহসান এক অভিনব সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন। তার সিদ্ধান্ত হলো- সূর্যের প্রখরতায় জনজীবন বিপন্ন হচ্ছে। অতএব কেউ দিনের বেলা কর্ম করতে পারবে না। দিনের কর্ম রাতে সম্পাদন করতে হবে। অর্থাৎ সবাই দিনে ঘুমাবে এবং রাতে জাগ্রত থাকবে। এতে স্বাস্থ্য যেমন ঠিক থাকবে তেমনই সব কর্ম সুন্দর সমাধান হবে। স্বয়ং রাজা ও তার রাজকর্ম এভাবেই পরিচালিত করবেন। রাজার হুকুম অমান্য করতে কেউই ধৃষ্টতা দেখালো না।

সূর্য ডুবল। আকাশ ছাপিয়ে রাত নামল। প্রাসাদের সব আলো জ্বালিয়ে দেওয়া হলো।  রাজা এহসান তার সিংহাসনে বসলেন। উপস্থিত সম্মানীয় ব্যক্তিবর্গ রাজাকে সম্ভাষণ জানালো এবং রাজার সিদ্ধান্তের প্রশংসা করল। শুরু হলো রাজা এহসানের অভিনব ভাবনার বাস্তবায়ন। হাতিশাল থেকে হাতি,  ঘোড়াশাল থেকে ঘোড়া বের করা হলো। সৈন্য দল ওদের পিঠে আঘাত করল। ওরা দৌড়াতে শুরু করল। ওদের খুরের আঘাতে ধূলি ওড়ে। রাতের অন্ধকার আকাশ আরও অন্ধকার হয়ে যায়।

কৃষকেরা জমিতে কাজ করছিল। হাতি ঘোড়া ছুটতে ছুটতে জমির ওপর দিয়ে গেল। কৃষকেরা হায় হায় করতে লাগল। আমাদের সব ফসল নষ্ট হইয়া গেল। কৃষাণি নদীতে কাপড় কাচ্ছিল। অন্ধকারে কাপড় ভেসে গেল। কৃষাণিরা হায় হায় করতে লাগল। আমাগো দুইটা মাত্র কাপড়, একটা ভাইসা গেল। দিনের কাজ রাত্রে হয় নাকি? রাজ্যের রাজার বিরুদ্ধে কে কথা বলবে? তিনি তো এমন নিয়ম করেছেন! দিনে কেউ কর্ম করতে পারবে না। সব কর্ম রাতেই সারতে হবে।

শিশুরা ছড়া বলতে লাগল-

সহজ দেশের উল্টো রাজা,

পেতেই হবে কঠিন সাজা।

উড়কি,মুড়কি, চরকি বাজা,

মন্ডা,মিঠাই, তিলের খাজা।

পেতেই হবে কঠিন সাজা,

সহজ দেশের উল্টো রাজা।

এভাবেই চলতে থাকল অনিয়ম।

একদল জেলে নদীতে জাল ফেলল। অন্ধকারে ভালো করে দেখতে পাচ্ছে না। তবু মাছ ধরার প্রচেষ্টা। জীবিকা তো নির্বাহ করতে হবে। ক্রেতাদের পদচারণায় মাছের বাজার গমগম করছে। দোকানি বলল, বিশাল বড় মাছ। অল্প দামে দিচ্ছি। নিয়ে যান। ক্রেতা মাছ কিনে বাড়ি ফিরল। কুপির টিম টিম আলোয় মাছ দেখে বাড়ির কর্তৃ চিৎকার দিলেন। এটা তো মাছ নয়! বিশাল বড় সাপ। আমাদের রাজ্যের রাজার পাগলামি বন্ধ করতে হবে। হে বাড়ির কর্তা, আপনিও কী দেখলেন না? মাছ ভেবে সাপ নিয়ে এলেন।

দুজনার ঝগড়া শুরু হলো। ঝগড়ার শব্দ সমগ্র রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ল। রাজা তার রাজকর্ম শেষ করে আরাম করছেন। একটু পরে সূর্য উঠবে। তখন ঘুমাতে যাবেন। হঠাৎ প্রাসাদের বাইরে হই হই রই রই শুরু হলো। প্রহরীরা ছুটে এলো। হে জাহাপনা, ক্ষমা করুন, সর্বনাশ হয়ে গেছে। প্রজারা আমাদের প্রাসাদ ঘিরে ফেলেছে। প্রজাদের দাবি দিনের কাজ দিনে আর রাতের কাজ রাতে সম্পাদন করতে হবে। রাজা ধমকে উঠে বললেন, খামোশ! দিবালোকের প্রখর তাপে কর্ম করা যায় না। তাই এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সৈন্য দল অস্ত্র সাজে সজ্জিত হলো। অস্ত্রের ঝঞ্ঝনা নিতে ঝনঝন করে উঠল রাজ্য। প্রজারা ফিরে যেতে বাধ্য হলো।

রাজা এহসান ঘুমাতে গেলেন। ঘুমাতে না ঘুমাতেই জেগে ওঠার ঘণ্টা বাজলো। রাজা ঘুমঘুম চোখে দরবারে উপস্থিত হলেন। দরবারের সম্মানীয় ব্যক্তিবর্গ বলল, হে জাহাপনা, আজ মনে হচ্ছে সূর্য টুক করে উঠল। আর টুক করেই ডুবে গেল। রাজা চিন্তিত মুখে বললেন, হে সভাসদ, আমারও তাই মনে হচ্ছে। উজির, নাজির, মন্ত্রী ঘুম ঘুম চোখে বলল, হে জাহাপনা, ঘুম ঘুম চোখে রাজকর্ম করব কী করে? রাজা ক্ষিপ্ত হয়ে বললেন, এভাবেই করতে হবে। সবাই  ঘুম ঘুম চোখে কর্ম শুরু করল।

 রাজকর্ম না ফুরোতেই রাজা ঘুমিয়ে পড়লেন। দরবারে উপস্থিত সবাই ঘুমিয়ে পড়ল। যে যেখানে যে অবস্থায় ছিল সেভাবেই ঘুমিয়ে পড়ল। কিন্তু কী আশ্চর্য! কিছুক্ষণ পরেই জেগে ওঠার ঘণ্টা বাজল।

রাজা হুরমুর করে জেগে উঠলেন। আমি তো সিংহাসনেই ঘুমিয়ে পড়েছি। সবাই জেগে ওঠলো। রাজার মতোই অবাক হলো! সবার একটাই প্রশ্ন, কী করে ঘুমালাম? রাজ্যে কী কোনো অমঙ্গল হতে যাচ্ছে? অনেক ভেবে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। যতই ঘুম পাক আজ কেউই ঘুমাবে না। রাজার হুকুমে নাচ গানের আয়োজন করা হলো। নাচতে লাগলো সমগ্র রাজ্য। নাচতে নাচতে সবাই ক্লান্ত হয়ে গেল। কখন যে ঘুমিয়ে পড়ল কেউই টের পেল না।

ঘুমাতে থাকল আর ঘুমাতেই থাকল। প্রচ- শব্দে ঘণ্টা বাজলো। বাজতেই থাকল আর বাজতেই থাকল।

রাজা বিরক্ত হয়ে ঘুম থেকে জাগলেন। জেগে উঠল সমগ্র রাজ্য। রাজা আগুন কণ্ঠে বললেন, হে ঘণ্টা বাদক, কেন রাত না ফুরোতেই ঘণ্টা বাজাও? ঘণ্টা বাদক হাত জোড় করে বলল, হে জাহাপানা, ক্ষমা করুন। রাত ফুরোয় না। সূর্য ওঠে না। তাই আমি একটি নির্দিষ্ট সময় ঠিক করে ঘণ্টা বাজাই। যেন সবার কর্ম সম্পাদন হয়। কথা শোনা মাত্রই রাজা স্তব্ধ হয়ে গেলেন। অন্ধকারে ডুবে গেল রাজ্য। মানুষের হাহাকারে ভরে উঠল আকাশ বাতাস। তবু সূর্য উঠল না। কত রাত ভোর হলো না তার হিসেব রইল না।

সূর্যের আলো না পেয়ে গাছ গাছালি নেতিয়ে গেল। পাক পাখালি থেমে গেল। প্রজাদের আর্তনাদে কেঁপে উঠল প্রাসাদ।

কেঁপে উঠল রাজা এহসানের মন। তিনি কথা বলতে পারেন না। আপন মনে একা একাই বললেন, আমি স্রষ্টার নিয়মকে ভঙ্গ করেছি। স্রষ্টা দিন দিয়েছেন কর্ম করার জন্য। রাত দিয়েছেন শান্তির জন্য। স্রষ্টার হুকুম অমান্য করে আমি নিজ সিদ্ধান্ত সবার ওপর চাপিয়ে দিয়েছি। তাই এমন শাস্তি পেয়েছি। হে স্রষ্টা, আমায় ক্ষমা করে দাও। হঠাৎ পাখিদের কিচিরমিচির শুরু হলো। আনন্দ উল্লাসে ভরে উঠল চারপাশ। হাতি ছুটলো। ঘোড়া ছুটলো। সবাই খুশিতে আত্মহারা। আনন্দে গেয়ে উঠল গান-

মন ভাসিয়ে দিলাম বাতাসে,

সূর্য উঠেছে পুব আকাশে।

 দিনের কাজ হবে দিনে,

 স্রষ্টার তৈরি নিয়ম মেনে।

রাতে হবে শুধুই ঘুম,

 আহা ঘুম শুধুই ঘুম।

সর্বশেষ খবর