অনামিকা মিষ্টি সুরে বলল, দাদু একটি গল্প বলো।
অনামিকার মন খারাপ হলেই দাদুর ঘরে আসে। গল্প শোনার বায়না ধরে। বিকেলে মায়ের কাছে বকুনি খেয়েছে। তাতেই মন খারাপ ওর। দাদুর কাছে এসে লেপের তলায় শরীর ঢুকিয়ে দিল। তারপর দাদুর গলা জড়িয়ে ধরে বলল, দাদু ভূতের গল্প বলো।
দাদু বললেন, আমি তখন নবম শ্রেণির ছাত্র। হোষ্টেলে থেকে লেখাপড়া করি। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অত্যাচার যখন চারিদিকে শুরু হয়ে গেলো তখন স্কুল কলেজ বন্ধ হয়ে গেলো। আমিও চলে গেলাম বাড়িতে।মা, খালা, ভাই বোন তখন সবাই বাড়িতে। এরপর আমাদের বাড়িতে আসতে শুরু করলেন আমার চাচাতো বোনেরা তাদের পরিবার নিয়ে যারা ঢাকায় ছিলেন সবাই। মোটামোটি আমাদের বাড়িটি ছিলো কিছুটা নিরাপদ জায়গা। তবে আমরা কিছুটা সতর্ক ছিলাম এ জন্য যে, আমার চাচাতো বোনের স্বামী ছিলেন মুক্তি বাহিনীতে। তারা থাকতেন ঢাকায়। বাড়িতে একত্রে সবাই চলে আসায় বাড়িটি ছিলো লোকে লোকারন্য। পরিবারের ভাই বোনেরা সবাই ছিলেন একটা আতংকের মধ্যে থাকা লাগতো।
সে সময় খবর পাওয়ার একমাত্র মাধ্যম ছিলো রেডিও। রেডিওতে খবর শুনতাম তাও খুবই কম সাউন্ড দিয়ে। খবর শুনলে মুক্তি বাহিনীর সাথে কোন জায়গায় পাকিস্তানী সৈন্যদের সাথে যুদ্ধ হচ্ছে, কতজন পাকসেনা মারা গেছে ইত্যাদি যাবতীয় খবর। তখন বুঝতে পারতাম পাক সেনাদের গতিবিধ, তারা কোন দিকে এগোচ্ছে। যুদ্ধের প্রায় আট মাসের মাথায় একদিন খবর পাওয়া গেলো যে, পাকবাহিনী আমাদের এদিকে আসছে। তখন সাথে সাথেই আমার চাচাতো ভাই আমাদের সবাইকে ডেকে বললেন, তোমরা তাড়াতাড়ি বাড়ি থেকে বের হয়ে যাও। বড় ভাই বললেন, তোমরা চৌকিঘাটা গ্রামে চলে যাও। আমরা পাঁচজন তাড়াতাড়ি বের হয়ে গেলাম। বাড়ি থেকে বের হয়ে বিভিন্ন গ্রামের পাশ দিয়ে ধানক্ষেতের আইল দিয়ে যখন হেঁটে যাচ্ছিলাম, তখন গ্রামের অনেকেই আমাদের মুক্তি বাহিনীর লোকজন মনে করে কেউ কেউ পালিয়ে যায়, আবার বৃদ্ধ বয়সের মানুষরা এসে ভয়ে ভয়ে আমাদের কাছে এসে জিজ্ঞাসা করে আপনারা কি মুক্তি বাহিনী? তখন আমার চাচাতো ভাই বললেন, না আমরা মুক্তি বাহিনী নই। জিজ্ঞাসা করল, এখন যাচ্ছেন কোথায় এতজন একসাথে? ভাই বললেন, পাকসেনারা আসছে আমাদের ঐদিকে, আপনারাও সাবধান থাকবেন। এজন্য আমরা চৌকিঘাটা গ্রামে চলে যাচ্ছি। সবশেষে বললো, বাবারা খেয়াল করে যাবেন। আমরাও সাবধান হচ্ছি। আমরা যখন ঐদিকে যাচ্ছিলাম, তখন ছোট ছোট খালগুলো পানি ভরা, তখন বর্ষা মওসুম। নতুন পানি আসলে সাধারণত জোঁক থাকে পানিতে। আমার ভাগ্নারা জোঁক দেখলে বেশী ভয় পেতো কিন্তু ঐদিন খাল পাড়ি দিতে গিয়ে কত জোঁক যে পায়ে ধরছে কিন্তু ভয় পায়নি বরং আমাকে ডাক দিয়ে বলল, মামা জোঁকে ধরেছে, ছাড়িয়ে দাও। আমি ওর পা থেকে জোঁক ছাড়িয়ে দিলাম। এসময় সবার মনের মধ্যে যে কী পরিমাণ ভয় ঢুকেছিলো তা পরে বুঝতে পেরেছি। আমরা যাখন যাচ্ছিলাম তখন আমরাও ভয়ে কাঁপছিলাম, কারণ যদি কোনো রাজাকার দেখে ফেলে। আমরা বাড়ি থেকে বের হওয়ার প্রায় ঘন্টা খানেক পরেই নাকি পাক সেনারা আমাদের বাড়িতে এসে হাজির হয়। তাদের আসার খবর পেয়েই আমার চাচাতো ভাই কয়েকটা চেয়ার বারান্দায় এনে সুন্দর করে সাজিয়ে রাখলেন। তারা যখন আসলো বাড়ির চারিদিকে তাকালো। তার কারণ হচ্ছে আমাদের বাড়ির সীমানা বিরাট বড়। বারান্দায় যখন তারা উঠলো তখন ভাই তাদেরকে বসতে বললেন। এরপর উর্দূতে বললেন, ডাবের পানি দিবেন নাকি? আবার বললো, আমাদের সামনে এনে ডাব কেটে দাও। ভাই সাথে সাথেই লোক পাঠিয়ে আমাদের নারিকেলের গাছ থেকে এক ছড়ি ডাব কেটে তাদের সামনে এনে দিলেন। তাদের সামনে ওগুলো কেটে দিলো কাজের লোকটি। কোন গ্লাস নিলো না, মুখে লাগিয়ে ডাবের পানি পান করে খুব খুশি হলো। এরপর জিজ্ঞাসা করলো তোমরা কি কর? ভাই বললেন, আমাদের ক্ষেত আছে ওগুলোতে ধান ফলাই, বিক্রি করি, এভাবেই আমাদের চলে যায়। এ কথা শুনে তারা খুব খুশি হয়ে গেলো। আমার চাচাতো ভাই নির্ভূল ভাবে উর্দূতে কথা বলতে পারতেন। কাজেই তাদের সাথে কথা বলে মোটোমুটি তারা সন্তুষ্ট হয়ে চলে গেলো। আমাদের মুক্তি বাহিনীর সদস্যরা নিজেদের জীবন বাজি রেখে পাক সেনাদের সাথে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছে। বিজয় এনেছে।
অনামিকা বলল, দাদু এটা তো ভূতের গল্প হয়নি, তবে শুনতে ভালো লেগেছে।
দাদু হেসে বললেন, এটাই আমাদের বিজয়ের গল্প। আমাদের দেশের কথা। এগুলো নিয়েত আমরা সবাই বেঁচে আছি। তোমরা বড়ো হয়ে বুঝতে পারবে।
অনামিকা দাদুর গলা জড়িয়ে ধরে আবদার করে।
সে দেশের আরও গল্প শুনতে আগ্রহী। দাদু মিস্টি হাসি দিয়ে আনমনা হয়ে গেল। কি ভয়াবহ ছিলো সে দিনগুলো!