শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪ ০০:০০ টা

আন্তোনিও ক্যানোভা

মূল : জেমস বাল্ডউইন - অনুবাদ : আকতার জামিল

আন্তোনিও ক্যানোভা

অনেক বছর আগে ইতালিতে আন্তোনিও ক্যানোভা নামে এক ছেলে ছিল। বাবা মারা যাওয়ায় সে দাদার সঙ্গে থাকত। দাদা পাথর ভাঙার কাজ করতেন এবং তিনি খুবই গরিব ছিলেন। আন্তোনিও অনেক ছোট ছিল এবং কাজ করার মতো বয়সও তার হয়নি। এলাকার অন্য ছেলেদের সঙ্গে খেলতে যাওয়ার চেয়ে দাদার সঙ্গে পাথরের খনিতে যেতে সে পছন্দ করত। বৃদ্ধ দাদা যখন পাথরের বড় বড় ব্লকগুলো কাটা এবং ছাঁটাই করার কাজে ব্যস্ত থাকতেন তখন সে চিপসের মধ্যে খেলত। কখনো নরম মাটি দিয়ে ছোট মূর্তি তৈরি করত; কখনো আবার হাতুড়ি ও ছেনি দিয়ে পাথরের টুকরা থেকে মূর্তি তৈরির চেষ্টা করত। তার এ দক্ষতা দেখে দাদা খুশি হতেন।

‘ছেলেটি একদিন বড় ভাস্কর হবে।’ দাদা বলতেন। সন্ধ্যায় দাদার সঙ্গে বাড়ি ফিরে এলে দাদি বলতেন, ‘আজ কি তৈরি করেছ আমার ছোট্ট ভাস্কর?’ দাদি তাকে কোলে বসিয়ে গান গাইতেন, কিংবা এমন এমন গল্প শোনাতেন যে আন্তোনিওর মনটা বিস্ময়কর এবং সুন্দর জিনিসের কল্পনায় ভরে থাকত। পরদিন যখন দাদার সঙ্গে পাথরের খনিতে যেত, তখন কল্পনায় আঁকা ছবিগুলোর মূর্তি পাথর বা মাটি দিয়ে তৈরির চেষ্টা করত।

এ শহরেই একজন ধনী লোক থাকতেন যাকে সবাই কাউন্ট বলত। কাউন্ট মাঝেমধ্যে গ্র্যান্ড ডিনারের আয়োজন করতেন এবং শহরের বিভিন্ন স্থান হতে তার বন্ধুরা সে অনুষ্ঠানে যোগ দিতেন। আন্তোনিওর দাদা এসব অনুষ্ঠানে রান্নার কাজে সহায়তা করতে কাউন্টের বাড়িতে যেতেন; কেননা পাথর ভাঙার কাজের পাশাপাশি তিনি একজন ভালো বাবুর্চিও ছিলেন।

একদিন এমনই এক অনুষ্ঠানে আন্তোনিও তার দাদার সঙ্গে কাউন্টের বাড়িতে গিয়েছিল। শহর থেকে কাউন্টের বন্ধুদের আসার কথা ছিল। সেজন্য জমকালো ভোজের আয়োজন করা হয়েছিল। আন্তোনিও রান্না করতে পারত না। কেননা টেবিলে কাজ করার মতো বয়স তখনো তার হয়নি।  কিন্তু সে প্যান এবং কেটলি ধুতে পারত এবং অত্যন্ত দ্রুত ও দক্ষতার সঙ্গে সে এটি করতে পারত। এভাবে আরও অনেক উপায়ে সে রান্নাঘরের টুকিটাকি কাজে সাহায্য করতে পারত।

রাতের খাবার টেবিলে পরিবেশনের আগ পর্যন্ত সবকিছু ঠিকঠাক ছিল। কিন্তু হঠাৎ ডাইনিং রুমে বিপর্যয় ঘটে গেল। একজন হাতে কিছু মার্বেলের টুকরা নিয়ে রান্নাঘরে ছুটে গেল। সে ফ্যাকাশে এবং ভয়ে কাঁপছিল।

‘আমি কী করব? আমি এখন কী করব?’ বলে সে কাঁদতে লাগল। ‘টেবিলের মাঝখানে যে মূর্তিটি ছিল তা আমি ভেঙে ফেলেছি। মূর্তি ছাড়া টেবিলটিকে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করা সম্ভব নয়। কাউন্ট কী বলবেন?’

অন্য সব ভৃত্যরাও ভাবনায় পড়ে গেল। ডিনার কি শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হবে? টেবিলটি সুন্দরভাবে সাজানোর ওপর সবকিছু নির্ভর করছে। কাউন্ট ভীষণ রেগে যাবেন।

‘আহ, এখন আমরা কী করব?’ তারা পরস্পর বলতে লাগল। ছোট্ট আন্তোনিও প্যান এবং কেটলিগুলো রেখে যে লোক মূর্তিটি ভেঙেছিল তার কাছে গেল।

‘আপনাকে যদি আরেকটি মূর্তি এনে দেওয়া হয়, আপনি কি টেবিলটি সাজাতে পারবেন?’ সে  জিজ্ঞাসা করল।

‘অবশ্যই, যদি মূর্তিটি সঠিক দৈর্ঘ্য এবং উচ্চতার হয়।’ লোকটি বলল।

‘আমাকে কি একবার সুযোগ দেওয়া যায়?’ আন্তোনিও জিজ্ঞাসা করল। ‘আমার বিশ্বাস আমি আপনাকে এমন কিছু তৈরি করে দেখাব যাতে আপনার চলবে।’

লোকটা হেসে উঠল।

‘কী সব আজেবাজে কথা!’ লোকটি বলল। ‘তুমি কে, যে এক ঘণ্টার নোটিসে মূর্তি বানানোর কথা ভাবছ?’

‘আমার নাম আন্তোনিও ক্যানোভা,’ ছেলেটি বলল।

‘যদি পারে দেখুক না চেষ্টা করে,’ ভৃত্যদের মধ্য যারা আন্তোনিওকে চিনত তারা বলল।

যেহেতু বিকল্প কিছুই আর করার নেই, তাই লোকটি তাকে অনুমতি দিল।

রান্নাঘরের টেবিলে হলুদ রঙের মাখনের বর্গাকৃতি একটি বড় পি- ছিল। পি-টি দু শত পাউন্ড ওজনের এবং সেটি একেবারে তাজা এবং পরিষ্কার। সবেমাত্র পাহাড়ের এক ডেইরি ফার্ম হতে এটি আনা হয়েছে। রান্নাঘরের ছুরি নিয়ে আন্তোনিও এই মাখন কাটা শুরু করল। কয়েক মিনিটের মধ্যে সে পি-টিকে কেশরওয়ালা এক সিংহের আকার দিল; ভৃত্যরা তা দেখার জন্য চারপাশে ভিড় করল?

‘কী সুন্দর! এটি ভেঙে যাওয়া মূর্তিটির চেয়ে অনেক সুন্দর।’ তারা বলতে লাগল।

আন্তোনিও শেষ করলে লোকটি এটিকে টেবিলে বসিয়ে দিল।

‘আমি যতটা করতে চেয়েছিলাম তার থেকে অর্ধেক সুন্দর হয়েছে টেবিলটি,’ লোকটি বলল। কাউন্ট এবং তার বন্ধুরা যখন ডিনারের জন্য প্রবেশ করলেন তখন সর্বপ্রথম হলুদ সিংহের মূর্তিটিই নজরে পড়ল।

‘কী সুন্দর শিল্পকর্ম!’ তারা বলতে লাগলেন। ‘মহৎ কোনো শিল্পী ছাড়া কারও পক্ষেই এমন শিল্পকর্ম নির্মাণ করা সম্ভব নয়; আর কতই না অপরূপ যে মূর্তিটি নির্মাণে তিনি মাখনকে বেছে নিয়েছেন!’ তারা কাউন্টের কাছে শিল্পীর নাম জানতে চাইলেন।

‘ভৃত্যরা মূর্তিটির চারপাশে ভিড় করল।’

‘সত্যিই, বন্ধুরা, আপনাদের মতো আমার কাছেও এটি বিস্ময়কর।’ কাউন্ট বললেন। এরপর তিনি প্রধান ভৃত্যকে ডেকে এত চমৎকার মূর্তিটি সে কোথায় পেয়েছে তা জানতে চাইলেন।

‘এক ঘণ্টা আগে রান্নাঘরে একটি ছোট ছেলে এটি তৈরি করেছে,’ প্রধান ভৃত্য বলল।

এ কথায় কাউন্টের বন্ধুরা আরও বিস্মিত হলেন। কাউন্ট ছেলেটিকে ডাইনিং রুমে ডেকে পাঠালেন।

‘এই ছেলে, তুমি এমন একটি কাজ করেছ যা নিয়ে সেরা শিল্পীরাও গর্বিত হবেন। কী নাম তোমার এবং কার কাছ থেকে তুমি এ কাজ শিখেছ?’ তিনি আন্তোনিওর  কাছে জানতে চাইলেন।

‘আমার নাম আন্তোনিও ক্যানোভা। আমার দাদা যিনি পাথর ভাঙার কাজ করেন তিনি ছাড়া আমার আর কোনো শিক্ষক নেই।’

ততক্ষণে আন্তোনিওর চারপাশে সমস্ত অতিথিরা ভিড় করেছে। তাদের মধ্যে বিখ্যাত শিল্পীরা ছিলেন এবং তারা বুঝতে পারলেন যে, ছেলেটির যথেষ্ট প্রতিভা রয়েছে। শিল্পকর্মটির প্রশংসা করার চেয়ে আন্তোনিও তাদের পাশে বসে খেলে এবং নৈশভোজটি তার সম্মানে উৎসর্গ করা হলে তারা বেশি খুশি হবেন বলে জানালেন।

ডিনারের পরদিন কাউন্ট আন্তোনিওকে ডেকে পাঠালেন এবং তার বাড়িতে থাকার জন্য বললেন। ভাস্কর্য নির্মাণে আন্তোনিওর দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য দেশের সেরা শিল্পীদের নিযুক্ত করা হলো।  মাখনের পরিবর্তে আন্তোনিও ছেনি দিয়ে মার্বেল খোদাই করা শুরু করল। এর কয়েক বছরের মধ্যে আন্তোনিও ক্যানোভা বিশ্বের অন্যতম সেরা ভাস্কর হিসেবে পরিচিতি লাভ করল।

সর্বশেষ খবর