শিরোনাম
শুক্রবার, ৭ জুন, ২০২৪ ০০:০০ টা

খাঁচা

কবির কাঞ্চন

খাঁচা

বন্দি জীবনের কথা ভাবতেই ওর মনে পড়ে ১৯৭১-এর কথা। পশ্চিমা হানাদারদের নৃশংসতার কথা। দাদার কাছ থেকে শোনা পরাধীনতার সেই স্মৃতিকথা মনে পড়ে যায় তার গত কয়েক দিন খুব

 

অস্বস্তির মধ্যে কেটেছে টুনটুনি পাখিটির। জন্মের পর থেকে যে মায়ের পাশে, বাবার পাশে, একমাত্র আদরের বোন টুনির পাশে আপন নীড়ে থেকে বড় হয়েছে সেই তাকেই এখন থাকতে হচ্ছে ছোট্ট একটি খাঁচার ভিতরে। খাঁচাটি এতটাই ছোট যে, ঠিকমতো একটু নড়াচড়া পর্যন্ত করা যায় না। তার মধ্যে আবার খাঁচার ভিতরে ছোট্ট একটি খাবারের প্লেটও ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। যে কারণে ভালোমতো একটু ঘুমুতেও পারছে না। শত কষ্টের মাঝে হঠাৎ টুনটুনির মায়ের কথা মনে পড়ে। মা তাকে কত আদর করতেন। নিজে সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠিয়ে দিয়ে খাদ্যের খোঁজে বেরিয়ে যেতেন। আবার একগাল খাবার নিয়ে বাসায় ফিরতেন।  এরপর তাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সেগুলো খাওয়াতেন। পরম মমতায় বুকে জড়িয়ে ধরে আদর করতেন। আজ কয়েক দিন ধরে মা-বাবা, টুনি কাউকে দেখতে পারছে না সে। বদ্ধ খাঁচায় থেকে যা দেখা যায় তা কেবল রংবেরঙের ভবন আর ভবন। সবুজের ছিটেফোঁটা পর্যন্ত দেখা যায় না।

টুনটুনি পাখিটি খাঁচার এক কোনায় মন খারাপ করে ঝিমুচ্ছে। এরই মধ্যে সেখানে এসে উপস্থিত হয় শুদ্ধ। প্রিয় টুনটুনির জন্য এ বাসার সবার মধ্যে শুদ্ধের মায়া বেশি। শুদ্ধ নিজ হাতে ওকে খাবার খাওয়ায়। কাছে বসে ওর সঙ্গে কথা বলে। আবার খাঁচার ভিতরে ময়লা জমে গেলে তা পরিষ্কার করে দেয়। টুনটুনিও শুদ্ধকে দেখলে খুব প্রফুল্ল হয়ে ওঠে। কিন্তু আজ শুদ্ধকে দেখেও মনমরা হয়ে খাঁচার এক কোনায় ঝিমুচ্ছে সে।

টুনটুনিকে এভাবে মন খারাপ করে বসে থাকতে দেখে শুদ্ধ খাঁচার কাছাকাছি এসে জিজ্ঞেস করল-

- এই টুনটুনি, তুমি এমন মন খারাপ করে আছ কেন? তোমার কি কোনো সমস্যা হয়েছে?

টুনটুনি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দিয়ে বলল,

- আর বলো না। গতকাল থেকে আমার বাসার সবার কথা খুব মনে পড়ছে। সবাইকে হারিয়ে আমি খুব একা হয়ে গেছি, বন্ধু।

শুদ্ধ একটু ভেবে বলল,

- এখানে কি তোমার আপন বলে কেউ নেই?

- থাকবে না কেন? তোমার মতো ভালো বন্ধু থাকলে দুঃখ করার সুযোগই নেই।

- তাহলে মন খারাপ করলে কেন?

- সবার মতো তুমিও ছিলে না। খাঁচার ভিতর আমার নিজেকে খুব একাকী মনে হলো। এক মুহূর্তের জন্য আমার যেন দম বন্ধ হয়ে আসছিল। এখন তুমি এসেছ, আমার খারাপ লাগা কেটে গেছে।

- আচ্ছা, এই কথা। ঠিক আছে, এখন থেকে তোমাকে আর একা থাকতে হবে না। কথা দিলাম,

আমি তোমায় চোখে চোখে রাখব।

শুদ্ধের কথায় টুনটুনি পাখিটি লেজ নাচিয়ে ডানা জোড়া ঝাপটিয়ে খাঁচার অন্য প্রান্তে গিয়ে বিষণœ হয়ে বসে রইল। শুদ্ধ পাখিটির মনের ভাষা বোঝে। সে আবার সামনে এসে আদুরে গলায় বলল,

- বন্ধু, তোমার কি এখনো মন খারাপ?

- তোমায় কাছে পেলে আমার আবার বাঁচতে ইচ্ছে করে।

- তাহলে ওভাবে আমাকে এড়িয়ে গেলে কেন?

- আবার আমার বাবা-মা এবং একমাত্র আদুরে ছোটবোন টুনির কথার মনে পড়ল। মুহূর্তে মনটা খারাপ হয়ে গেল। কিন্তু আমার এই মলিন মুখটা আমি তোমাকে দেখাতে চাইনি। তাই উল্টোদিকে চলে এসেছি। তুমি কিছু মনে কর না, বন্ধু। যেখানে আমি পাখি খাঁচায় থাকি। খাঁচাই আমার ঘর। চারদিকে কেবলই শূন্যতা। সেখানে তোমার মতো এত ভালো একজন বন্ধু পাওয়া তো সৌভাগ্যের বিষয়।

- ধন্যবাদ, বন্ধু। তুমি একটু অপেক্ষা কর। আমি ঘরে গিয়ে আবার আসছি।

এ কথা বলে শুদ্ধ ঘরের দিকে পা বাড়ায়।

নিজের পড়ার কক্ষে এসে খাটের ওপর চিত হয়ে আনমনে ভাবতে লাগল,

আমার প্রিয় টুনটুনি পাখিটির মন ভালো নেই। একান্ত আপনজনদের দূরে রেখে বন্দি জীবন ওর জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে।

বন্দি জীবনের কথা ভাবতেই ওর মনে পড়ে ১৯৭১-এর কথা। পশ্চিমা হানাদারদের নৃশংসতার কথা। দাদার কাছ থেকে শোনা পরাধীনতার সেই স্মৃতিকথা মনে পড়ে যায় তার।

এক মুহূর্তে শুদ্ধের মন পাল্টে যায়। সে এবার টুনটুনির জন্য কিছু একটা করবেই। আর সেটা হবে এবারের স্বাধীনতা দিবসে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে তার একটি ভালো কাজ। এভাবে যতদিন বাঁচবে, ততদিন সে স্বাধীনতা দিবসে কমপক্ষে একটি করে হলেও ভালো কাজ করে যাবে।

এরপর আবার টুনটুনি পাখিটির কাছে ফিরে আসে। এভাবে যতই দিন যায় ততই টুনটুনি পাখির সঙ্গে শুদ্ধের হৃদ্যতা বাড়তে থাকে।

এরই মধ্যে ঘনিয়ে আসে স্বাধীনতা দিবস। রাত পোহালেই ২৬ মার্চ। সারা রাত টুনটুনির সঙ্গে নিজের দীর্ঘদিনের সখ্যের কথা মনে পড়ে তার। এতদিনের মায়া কী করে সে ছিন্ন করবে! টুনটুনিকে ছাড়া সে কি থাকতে পারবে! আর টুনটুনিই বা কী করে তাকে ভুলে থাকবে! এসব ভাবতে ভাবতে এক সময় দুই চোখের পাতা মিলে আসে।

দুঃস্বপ্নের মধ্যে কেটে যাওয়া রাতের অবসানে শুদ্ধের ঘুম ভাঙে। সে এক পা দুই পা করে টুনটুনির কাছে চলে আসে। শুদ্ধকে দেখতে পেয়ে টুনটুনি পাখিটি আনন্দে ডানা ঝাপটিয়ে শুদ্ধের দিকে তাকিয়ে থাকে। শুদ্ধও নির্বাক চোখে টুনটুনির দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। এরপর খাঁচার দরজা খুলে দিতেই পাখিটি উড়ে এসে শুদ্ধের কাঁধে বসে। দূর থেকে বাতাসে ভেসে আসে, আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণা। শুদ্ধ কাঁধ থেকে টুনটুনিকে দুই হাতে নিয়ে একবার বুকের কাছে এনে আবার দুই হাত প্রসারিত করে দূর আকাশে পাঠিয়ে দিয়ে বলে ওঠল, ‘যাও, আজ থেকে তুমি মুক্ত। তোমার পৃথিবী তোমার হোক। বাধাহীন জীবনে তুমি সুখে থেকো, বন্ধু।’

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর