শুক্রবার, ২ আগস্ট, ২০২৪ ০০:০০ টা

প্রকৃতির রূপকথা

তানহা জাদিদা খান

প্রকৃতির রূপকথা

ছোট্ট রাহাতের স্বপ্ন বাংলাদেশের এক ছোট্ট গ্রামে ছিল সবুজ শস্যক্ষেত, নদী, পাখির কলরব আর মনোমুগ্ধকর প্রকৃতি। এই গ্রামে থাকত একটি ছোট্ট ছেলে, রাহাত। রাহাত ছিল খুবই কৌতূহলী এবং প্রকৃতিপ্রেমী। প্রতিদিন সে প্রকৃতির মাঝে ঘুরে বেড়াত, নদীর ধারে বসে পাখির গান শুনত আর আকাশের নীলিমায় হারিয়ে যেত। রাহাতের বাবা-মা গ্রামের স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। তারা রাহাতকে বই পড়তে উৎসাহিত করতেন। গ্রামের ছোট্ট লাইব্রেরিতে রাহাত অনেক বই পেত, কিন্তু তার প্রিয় ছিল প্রকৃতি নিয়ে লেখা বইগুলো। সে সব সময় ভাবত, ‘আমি যদি প্রকৃতির সৌন্দর্যকে কথায় বন্দি করতে পারতাম!’ একদিন রাহাত তার বাবার কাছে গিয়ে বলল, ‘বাবা, আমি কীভাবে প্রকৃতির সৌন্দর্য নিয়ে গল্প লিখতে পারি?’ বাবা হাসিমুখে বললেন, ‘প্রকৃতিকে মন দিয়ে দেখো, তার পরে যা অনুভব করো তা লেখার চেষ্টা করো।’ রাহাত বাবার কথা মনে রেখে প্রতিদিন তার ডায়েরিতে প্রকৃতির বিভিন্ন দিক নিয়ে লেখালেখি শুরু করল। সে নদীর কলকল ধ্বনি, পাখির গান, সবুজ ধানের ক্ষেতে দোল খাওয়া বাতাস-সব কিছু লিখে রাখত। দিনে দিনে তার লেখার দক্ষতা বাড়তে লাগল। গ্রামের মানুষও রাহাতকে উৎসাহিত করত। তারা বলত, ‘তুমি একদিন বড় লেখক হবে রাহাত।’ একদিন গ্রামের বড় মেলা বসেছিল। সেখানে একটি ছোট প্রতিযোগিতা আয়োজন করা হয়েছিল, যেখানে শিশুদের নিজেদের লেখা গল্প শোনানোর সুযোগ দেওয়া হচ্ছিল। রাহাত খুবই উত্তেজিত হয়ে তার লেখা গল্প নিয়ে সেখানে গেল। রাহাতের পালা এলে সে মঞ্চে উঠে তার গল্পটি পড়া শুরু করল। সে বর্ণনা করছিল কীভাবে ভোরের আলোয় নদীর জল চকচক করে ওঠে, কীভাবে পাখির গান মনে আনন্দ এনে দেয়, কীভাবে গ্রামের মানুষ প্রকৃতির সঙ্গে মিলেমিশে জীবনযাপন করে। তার গল্প শুনে সবাই মুগ্ধ হয়ে গেল। বিচারকরা তার গল্পের প্রশংসা করলেন এবং প্রথম পুরস্কারটি তাকে দিলেন। রাহাতের এই সাফল্য তার মনে নতুন স্বপ্নের বীজ বুনে। তারপর থেকে সে ভাবতে লাগল, ‘আমি যদি একদিন সত্যিকারের লেখক হতে পারতাম!’ ‘এই চিন্তা তাকে আরও অনুপ্রাণিত করল। সে আরও বেশি করে প্রকৃতিকে পর্যবেক্ষণ করতে লাগল, আরও গভীরভাবে তার সৌন্দর্যকে অনুভব করতে লাগল। গ্রামের মানুষও রাহাতকে উৎসাহিত করত। তারা বলত, ‘তুমি একদিন বড় লেখক হবে রাহাত।’ রাহাতের লেখার প্রতিভা দেখে তার বাবা-মা তাকে শহরের বড় লাইব্রেরিতে নিয়ে গেলেন। সেখানে সে আরও অনেক ধরনের বই পড়তে পারল এবং নতুন নতুন বিষয় নিয়ে লেখালেখি শুরু করল। শহরের লেখক সংঘ তাকে তাদের দলে যোগ দিতে আমন্ত্রণ জানাল। রাহাত সেখানে গিয়ে অনেক অভিজ্ঞ লেখকের সঙ্গে দেখা করে তাদের কাছ থেকে পরামর্শ নিল। হঠাৎ একদিন একটি বড় প্রকাশনী সংস্থা রাহাতের লেখা পড়ে মুগ্ধ হয়ে তার সঙ্গে যোগাযোগ করে। তারা রাহাতকে একটি বই লিখতে বলে। রাহাত আগ্রহের সঙ্গে অনেক পরিশ্রম করে একটি গল্পের বই লিখল ‘প্রকৃতির রূপকথা’। এ বইটি প্রকাশিত হওয়ার পর চারদিকে তার সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। সবার মুখে মুখে রাহাতের নাম। রাহাতের গ্রামের সবাই এ খবর শুনে তো ভীষণ খুশি। তার স্কুলের শিক্ষক, বন্ধু এবং গ্রামের সবাই তাকে বাড়িতে এসে অভিনন্দন জানিয়ে যাচ্ছে। রাহাত ভাবল, ‘আমার এই সাফল্যের পেছনে প্রকৃতিরই অবদান সবচেয়ে বেশি।’ রাহাত এখন শুধু নিজেই লেখে না, অন্য ছোটদেরও লেখালেখিতে উৎসাহিত করে। তার গ্রামে একটি ছোট সাহিত্য ক্লাব গড়ে তুলেছে, যেখানে সে প্রতিদিন ছোটদের সঙ্গে বসে প্রকৃতির গল্প বলে এবং তাদের লেখালেখির দীক্ষা দেয়। গ্রামের শিশুদের কাছে রাহাত এখন এক অনুপ্রেরণা। রাহাতের এ সাহিত্য ক্লাবে শিশুদের লেখালেখির প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, তাদের মধ্যে সৃজনশীলতা জাগিয়ে তোলা হয়। রাহাত তাদের শেখায় কীভাবে প্রকৃতিকে দেখলে, তার সৌন্দর্যকে অনুভব করলে এবং সেই অনুভূতিগুলোকে কীভাবে অনুভব করলে তা লেখায় প্রকাশ করা যায়। শিশুদের মধ্যে রাহাতের গল্পগুলো পড়ে অনেকেই লেখালেখির আগ্রহ পায় এবং তার কাছ থেকে দীক্ষা নিয়ে নিজেরাও লেখার অভ্যাস গড়ে তোলে। রাহাতের প্রতিদিনের রুটিন ছিল খুবই সুন্দর। সকালে উঠে সে গ্রামের সবুজ ধানের ক্ষেতে হাঁটতে যেত। নদীর ধারে বসে পাখির গান শুনত আর ছোট্ট নৌকায় চড়ে নদীর মাঝে হারিয়ে যেত। প্রতিদিন সন্ধ্যায় সে তার ডায়েরি নিয়ে বসত এবং পুরো দিনের অভিজ্ঞতাগুলো লিখে রাখত। তার লেখাগুলো ছিল জীবন্ত, যেন পাঠক সেই মুহূর্তগুলোকে নিজেই অনুভব করতে পারে। একদিন রাহাতের কাছে একটি চিঠি এলো। চিঠিটি ছিল দেশের এক বড় সাহিত্য পুরস্কারের আমন্ত্রণপত্র। রাহাতের ‘প্রকৃতির রূপকথা’ বইটি সেই পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছে। রাহাত এতে খুবই খুশি এবং তার বাবা-মা এবং গ্রামের মানুষের সঙ্গে এই সুখবরটি ভাগাভাগিও করে নেয়। পুরস্কার অনুষ্ঠানে রাহাত যখন মঞ্চে উঠে তার পুরস্কার গ্রহণ করছিল, তখন তার চোখে ছিল আনন্দের অশ্রু। সে ভাবছিল, ‘আমি যদি প্রকৃতির সৌন্দর্যকে না বুঝতাম, তাহলে কখনো এ জায়গায় আসতে পারতাম না।’ পুরস্কার গ্রহণের পর রাহাত একটি ছোট বক্তব্য দেয়। সে বলে, ‘প্রকৃতি আমাদের চারপাশে সব সময় সুন্দরভাবে বিদ্যমান। আমাদের শুধু মন দিয়ে তাকে দেখতে হবে, তার সৌন্দর্যকে অনুভব করতে হবে এবং সেই অনুভূতিগুলোকে লিখতে হবে। আমি সব সময় বিশ্বাস করি, প্রকৃতির সৌন্দর্য আমাদের হৃদয়কে প্রশান্তি এনে দেয় এবং আমাদের সৃজনশীলতাকে জাগিয়ে তোলে।’ রাহাতের এই বক্তব্য সবাইকে মুগ্ধ করে। তার কথা শুনে সবাই নতুন করে প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা অনুভব করতে শুরু করে এবং নিজের জীবনেও সেই সৌন্দর্য খুঁজে পেতে চেষ্টা করে। রাহাতের গল্প শেষ হয়নি। সে এখনো প্রতিদিন নতুন নতুন গল্প লিখছে, ছোটদের সাহিত্যে উৎসাহিত করছে এবং গ্রামের মানুষের কাছে প্রকৃতির সৌন্দর্যকে তুলে ধরছে।

সর্বশেষ খবর