২ আগস্ট, ২০১৯ ১৪:৪৭

'শুধু পেঁপে পাতার রস খেলেই হবে না, ডেঙ্গুর চিকিৎসাও নিতে হবে'

অনলাইন প্রতিবেদক

'শুধু পেঁপে পাতার রস খেলেই হবে না, ডেঙ্গুর চিকিৎসাও নিতে হবে'

ডেঙ্গু অতটা আতঙ্কের রোগ না। এরচেয়ে সিরিয়াস রোগ মানুষের হচ্ছে, মারা যাচ্ছে। যেমন ক্যান্সার হচ্ছে, লিভার ক্ষতিগ্রস্থ হলে করার কিছু থাকে না। তারপরও মানুষ ডেঙ্গুতে আতঙ্কগ্রস্থ হচ্ছে, এটা সত্য। এটা বাস্তব। আসলে ব্যাপারটা হলো মশা একটা ক্ষুদ্রপ্রাণী, এর কামড়ে মানুষ মারা যাবে, এটা অনেকে মানতে পারছে না। এটা তাদের কাছে অবাস্তব মনে হয় যে, 'আমি একটা মশার কামড়ে মারা যাবো!' আজ শুক্রবার বেসরকারি স্যাটেলাইট চ্যানেল নিউজ টোয়েন্টিফোরের স্বাস্থ্য সংলাপ অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন প্রখ্যাত মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. এবিএম আব্দুল্লাহ। 

তিনি আরও বলেন, এরইমধ্যে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত কয়েকজন মানুষ মারা গেছে, সরকারি হিসেবে ১৪ জন। বেসরকারি হিসেবে আরও বেশি। মানুষতো মারা যাচ্ছে...। এর জন্যই মানুষ আতঙ্কগ্রস্থ হচ্ছে। কারও পরিবারে একজন, কারও পুরো পরিবারেই। আগে শুধু ঢাকার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল, এখন সব বিভাগীয় শহরে, জেলা শহরে ছড়িয়ে যাচ্ছে। তাই মানুষের আতঙ্কগ্রস্থ হওয়াটাই স্বাভাবিক। 

হঠাৎ হল কেন এমন প্রশ্নে অধ্যাপক ড. এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, এটা মূলত দুটি কারণে। একটা হলো নগরায়নের ফলে সুন্দর সুন্দর ঘরবাড়ি হচ্ছে। শুধু ঢাকায় না, আশেপাশেও নগরায়নের কারণে সুন্দর সুন্দর ঘরবাড়ি হচ্ছে। আর এডিস মশাকে বলে গৃহপালিত মশা। তার এই সুন্দর সুন্দর ঘরবাড়িতেই জন্ম নিচ্ছে। যত নগরায়ন হবে তত এটা বাড়বে।

দ্বিতীয়ত এটি বর্ষাকালের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। এবার বর্ষাটা আগে চলে এসেছে। থেমে থেমে বিক্ষিপ্তভাবে বৃষ্টি হচ্ছে। মাঝে মাঝে বৃষ্টি হলে পানি জমে যায়। আর ডেঙ্গু মশা যেখানে জমা পানি পায়, পরিষ্কার পানি পায় সেখানেই ডিম পাড়ে। মশার বংশবিস্তার ঘটছে। মশার লার্ভা (ডিম) শুষ্ক অবস্থায় ৬ মাস বেঁচে থাকে। গত বছর হয়তো ডেঙ্গু মশার যে লার্ভাগুলো ছিল সেগুলো হয়তো রয়ে গেছে। এই বৃষ্টির সংস্পর্শে এই লার্ভা থেকেও কিন্তু মশার বংশ বৃদ্ধি হয়েছে। এ বছর মশা ডিম পাড়ছে সেখান থেকে মশা বংশবিস্তার করছে, গত বছরের লার্ভাগুলো থেকেও মশার বংশবৃদ্ধি হচ্ছে। সুতরাং যত মশা বেশি হবে তত ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়বে। আর এখন তাই হয়েছে। আর সেই তুলনায় মশাকে নির্মূল করার জন্য আমরা সেভাবে পদক্ষেপ নিতে পারিনি। আমাদের সেরকম প্রস্তুতি ছিল না। আগে থেকে সারা বছর এটা করা হলে তাহলে এটা হতো না। সুতরাং মশাও নির্বিঘ্নে তার বংশবৃদ্ধি করেই চলেছে, কামড়াচ্ছে, মানুষ ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এটাই মূল কারণ আসলে। 

ডেঙ্গুর বর্তমান প্রাদুর্ভাবকে মহামারী বলা যায় কী না এমন প্রশ্নের উত্তরে অধ্যাপক আব্দুল্লাহ বলেন, মহামারী শব্দটা ব্যবহৃত হয় যখন একটা শহর বা দেশের অধিকাংশ বা বেশিরভাগ জনগণ আক্রান্ত হয়। ধরুন ঢাকা শহরে প্রায় ২ থেকে আড়াই কোটি লোক বাস করে। আর আমরা যে হিসাব দেখছি তাতে ১৭ থেকে ২০ হাজার লোক ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে। এর চেয়ে বেশিও হতে পারে। সুতরাং ঢাকা শহরে ডেঙ্গুকে এখন মহামারী বলা যাবে না। তবে প্রকট আকার ধারণ করেছে তা বলা যায়। এটাও মনে রাখতে হবে মহামারী পর্যায়ে যাতে না পৌঁছায় যে ব্যবস্থা নিতে হবে। 

ডেঙ্গু রোগের লক্ষণ কেন পাল্টেছে তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন, সাধারণত ডেঙ্গু রোগের লক্ষণ দেখা যায় এবার তা দেখা যাচ্ছে না বা কম দেখা যাচ্ছে।  সাধারণত লক্ষণগুলো হলো শরীরের তাপমাত্রা অনেক বেড়ে যাওয়া, শরীর ব্যথা, গিঁটে ব্যথা, মাংশপেশীতে ব্যথা, মাথা ব্যথা, চোখের পেছনে ব্যথা। এত বেশি ব্যথা থাকে যে বলা হয় হাড় ভাঙা জ্বর। অর্থ্যাৎ জ্বরে রোগীর মনে হয় তার হাড় ভেঙে যাচ্ছে। ৪/৫ দিন জ্বর ওঠে, গায়ে র‌্যাশ হয়। ওই সময় প্লাটিলেট কমে, যে কোনোভাবে রক্তক্ষরণ (বমির সাথে, ব্রাশ করলে, নাক থেকে, মেয়েদের বেলায় সময়ের আগেই ঋতুস্রাব) হয়। এসব সাধারণ লক্ষণ। এ বছর দেখা যাচ্ছে জ্বর এত বেশি হয় না। জ্বর নাই, মাংশপেশীর ব্যথা নেই। গায়ে র‌্যাশ নাই। এতে রোগী আগের মতো নিজের সমস্যাটা বুঝতে পারছে না। ১/২দিনের জ্বরেই প্লাটিলেট কমে যায়। আগে যেটা ৪/৫ দিন পরে হতো। শরীরের অভ্যন্তরে রক্তক্ষরণ (প্লাজমা লিকেজ) হচ্ছে। 

আর ডেঙ্গুর ধরন আছে, ১, ২, ৩, ৪। ডেঙ্গুর ২, ৩, ৪ অনেক সিরিয়াস। এখন সিরিয়াস ধরনের ডেঙ্গু হওয়ায় রোগী মারা যাচ্ছে। আর দ্বিতীয় দফায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে সেটি বেশি বিপদজ্জনক। এতে রোগীর মারা যাওয়ার শঙ্কা বেশি থাকে। ডেঙ্গুর ভাইরাস ৪ রকমের তাই ডেঙ্গু চারবার হওয়ার ঝুঁকি থাকে।

নারিকেল তেল ও পেঁপে পাতার মাধ্যমে ডেঙ্গু প্রতিরোধের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, যেকোনোভাবেই হোক মশার কামড় থেকে বাঁচতে হবে। অনেকে বলছেন নারিকেল তেল মাখলে মশার কামড় থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। এর কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নেই। সাধারণত শরীরের ওপর একটি প্রলেপ থাকলে মশা কামড়াতে পারে না। কিন্তু নারিকেল তেল খুবই হালকা। এরপরও যদি কেউ দিতে চায় দিতেই পারে। তবে ডেঙ্গু প্রতিরোধে অন্যান্য যেসব ব্যবস্থা তাতে গাফিলতি করা যাবে না। মশারি টাঙিয়ে ঘুমাতে হবে, লম্বা জামা-কাপড় মোজা পরা যেতে পারে। তেলও দেন তবে নাকে তেল দিয়ে ঘুমানো যাবে না। 

পাশাপাশি বাজারে পেঁপে পাতার রস নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। ডেঙ্গুতে প্লাটিলেট কমে যায়। মানুষের ধারণা পেঁপে পাতার রস খেলে প্লাটিলেট বাড়ে। বাড়লে রক্তের ঝুঁকিটা কমে যায়। এটা নিয়েও কথাবার্তা চলছে। এটাও বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত না। প্লাটিলেট ৪/৫ দিনে কমে। তার ২/৩ দিন পর এমনিই বাড়া শুরু করে দেয়। এটা প্রাকৃতিকভাবেই। এখন ওই সময় যদি কেউ পেঁপে পাতা খেয়ে থাকে তার মনে হতে পারে এ জন্যই বাড়ল। তারপরও বলবো এটা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত না। কেউ যদি ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয় তাহলে ডাক্তারের কাছে যাবে, পরামর্শ নিয়ে চিকিৎসা করবে, পাশাপাশি পেঁপে পাতার রস খেলে ক্ষতি নাই। তবে শুধু এটা নিয়ে বসে থাকবেন না। শুধু পেঁপে পাতা খাবেন আর ঘরে বসে থাকবেন- এটা বুদ্ধিমানের মতো কাজ হতে পারে না। 

হারপিক ও ব্লিচিং পাউডার দিয়ে ডেঙ্গু নিধন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এগুলো রাসায়নিক এবং বিষাক্ত পদার্থ। এটা আরও বেশি বিপজ্জনক। বলা হচ্ছে বেসিনে বা ঘরের আনাচে কানাচে এগুলো দিলে মশা মরবে। তবে এতে শুধু মশা, অন্যান্য কীটপতঙ্গও মারা যাবে। যা পরিবেশের জন্যও ক্ষতিকর। ঘরের মধ্যে খাবার থাকে, তাছাড়া শিশুরা এটা যদি নিঃশ্বাসের সঙ্গে নেয় তাদের জন্য ঝুঁকির হতে পারে। এটা কোনো ক্রমেই করা যাবে না। যারা এসব ছড়ান তাদের আরও বেশি সতর্ক হওয়া উচিত। যা মনে ধরে তা বলা যাবে না। এসবের বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। এটা কোনোভাবেই করা যাবে না।  

অধ্যাপক ড. এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, আর এ সময়ে জ্বরে আক্রান্ত হলে নিজে থেকে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে না। ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। যে কোনো ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহণ করা যেতে পারে। তবে ঢালাওভাবে গিয়ে হাসপাতালে ডেঙ্গু পরীক্ষা ও ভর্তি হওয়ার দরকার নেই। এতে শুধু আতঙ্ক বাড়বে না, অর্থেরও অপচয়। আর এতে সত্যিই যারা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে তারা সঠিক সেবা থেকে বঞ্চিত হবে। 

 বিডি প্রতিদিন/ফারজানা

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর