৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ০৭:৪৯

তছনছ অসংখ্য পরিবার

শামীম আহমেদ

তছনছ অসংখ্য পরিবার

প্রতিদিন ভোরে দুই শিশু সন্তানকে বিছানা থেকে তোলা, নাশতা করানো, স্কুলড্রেস পরানো, ব্যাগ গুছিয়ে স্কুলের জন্য প্রস্তুত করা ছিল রাবেয়া আক্তারের নিয়মিত রুটিন। সন্তানরা স্কুলে গেলে যত্নের সঙ্গে গুছিয়ে রাখতেন তাদের বইখাতা, জামা-কাপড়, জুতো, খেলনা। হঠাৎ এক ঝড়ে যেন সবকিছু ওলটপালট হয়ে গেছে। এখন শুধু ঝাপসা চোখে তাকিয়ে থাকেন সন্তানদের পুতুল, খেলনা, জামা-জুতোর দিকে। উল্টে-পাল্টে দেখেন তাদের বই-খাতা। পাগলের মতো সারা ঘর হাতড়ে বেড়ান সন্তানদের স্মৃতি। বারবার আঁচল দিয়ে মোছেন চোখের পানি। মোবাইল খুলে দেখেন গত ১৫ আগস্ট সন্তানদের সঙ্গে তোলা শেষ ছবি। গত মাসে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে এক সপ্তাহের ব্যবধানে ইব্রাহিম-রাবেয়া দম্পতি হারিয়েছেন তাদের কলিজার টুকরা দুটি সন্তান আরাফাত ও রাইদাকে। ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে গত ১৮ আগস্ট শুক্রবার মৃত্যু হয় আরাফাত হোসেন রাউফের (৯)। পরের শুক্রবার ২৫ আগস্ট না ফেরার দেশে পাড়ি দেয় ইসনাত জাহান রাইদা (৬)। মশার কামড়ে মুহূর্তে নিভে গেছে পরিবারটির সব আলো। শুধু ইব্রাহিম-রাবেয়া দম্পতির পরিবারই নয়, চলতি বছরে ডেঙ্গুতে তছনছ হয়ে গেছে অসংখ্য পরিবার। কেউ হারিয়েছেন একমাত্র সন্তান, মা-বাবা হারিয়ে অসহায় হয়েছে অসংখ্য শিশু, পৃথিবী দেখার আগেই মাতৃগর্ভে থাকাবস্থায় পিতৃহারা হয়েছে শিশু, সন্তানসহ মৃত্যু হয়েছে অন্তঃসত্ত্বা মায়ের। একমাত্র উপার্জনক্ষম সদস্যকে হারিয়ে পথে বসেছে অনেক পরিবার। দেশ হারিয়েছে অনেক চিকিৎসক, ব্যাংকার, সাংবাদিক, লেখক, অভিনেত্রী, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী। 

ডেঙ্গু এলোমেলো করে দিয়েছে জাহেদুল আলম রুবেলের ১২ বছরের সাজানো সংসার। ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে গত ২৫ আগস্ট ১১ বছর ও ৪ বছর বয়সী দুই শিশু সন্তান রেখে না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছেন রুবেলের স্ত্রী ফারজানা শারমিন তপি (৪৩)। তিনি পেশায় ছিলেন ব্যাংকার। স্ত্রীকে হারিয়ে বাকরুদ্ধ রুবেল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এই ক্ষতি তো পূরণ হওয়ার নয়। আমার সন্তান দুটি এতিম হয়ে গেল। মেয়ে ফাতিহা রিদ্বীন চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে ও ছেলে আইয়ান তিহান পড়ে প্লে গ্রুপে। মাকে হারিয়ে প্রতিনিয়ত কাঁদছে দুই অবুঝ শিশু সন্তান। মেয়েটি চুপচাপ হয়ে গেছে। ছেলেটার মধ্যে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। মায়ের শূন্যতা ভুলতে পারছে না। রাতের বেলায় তাকে কিছুতেই ঠান্ডা রাখা যাচ্ছে না। সব সময় মাকে খুঁজছে। তার এক খালা এখন আমাদের সঙ্গে আছে। সে দেখভাল করছে। সামনে কী হবে তা বুঝতে পারছি না। ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে গত ২৭ আগস্ট ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান লেখিকা ফয়জুন্নেছা মণি (৩৮)। সেই সঙ্গে এতিম হয়েছে আদিয়ার আহনাফ আদ্রিক (১২) ও মেহবুবা ওয়ারিশা হৃদ্যতা (৮) নামের দুই শিশু। স্ত্রীকে হারিয়ে অসহায় হয়ে গেছেন এস এম মুকুল। দুই সন্তানকে কিছুতেই প্রবোধ দিতে পারছেন না। 

তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, তিন দিনের মধ্যেই সব শেষ হয়ে গেল! এক বাচ্চা সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে, অন্যজন দ্বিতীয় শ্রেণিতে। আমি নিজেই স্বাভাবিক হতে পারছি না, ওদেরকে শান্ত করব কীভাবে? সারাক্ষণ কান্নাকাটি করে। বাচ্চা দুটি এখন আমার বোনের কাছে আছে। দুই-এক দিনের মধ্যে ওদেরকে নিয়ে ঢাকায় ফিরব। সেখানে বাসায় আমার ছোট ভাইয়ের স্ত্রী আছে। ওরা ডিসেম্বর পর্যন্ত থাকবে। তত দিন তারা হয়তো দেখভাল করবে। এরপর কী হবে বলতে পারছি না। ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে গত ২৩ জুলাই রাজধানীর পপুলার হাসপাতালে মৃত্যু হয় বাংলাদেশ ব্যাংকের পাবলিক অ্যাকাউন্ট ডিপার্টমেন্টের সহকারী পরিচালক কান্তা বিশ্বাসের। তিনি আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। এ ছাড়া তার আড়াই বছরের কন্যাশিশুও রয়েছে। বছর খানেক আগে বিয়ে করেন ফরিদপুরের সালথা উপজেলা সদরের কাউলীকান্দা গ্রামের শাহ আলম (২৫)। স্ত্রী বর্তমানে আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা। মাস দেড়েক পর তার ফুটফুটে সন্তানের পৃথিবীতে আসার কথা। ঢাকায় চাকরিরত অবস্থায় নিয়মিত ভিডিওকলে স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতেন শাহ আলম। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে অনাগত সন্তানের মুখ দেখার আগেই ডেঙ্গুজ্বরে অকালে পৃথিবী ছাড়তে হয়েছে তাকে। গত ২১ আগস্ট ফরিদপুর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় তার। পৃথিবীর মুখ দেখার আগেই পিতৃহারা হয়েছে তার সন্তানটি। এক বছরের মাথায় বিধবা হয়েছে তার স্ত্রী। চলতি বছর বেশ কয়েকজন চিকিৎসকের মৃত্যু হয়েছে ডেঙ্গুতে। গত ৭ আগস্ট ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা যান ডা. আলমিনা দেওয়ান মিশু। মাত্র ছয় মাস পরই তার নামের পাশে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক উপাধি যুক্ত হওয়ার কথা ছিল। তার দুই ও চার বছর বয়সী দুই কন্যাসন্তান রয়েছে। গত ১১ আগস্ট ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা যান তরুণ চিকিৎসক শরিফা বিনতে আজিজ আঁখি। ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি। ডা. শরিফা রংপুর মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করেছেন।

 

বিডি প্রতিদিন/ ওয়াসিফ

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর