২৫ ডিসেম্বর, ২০২২ ০১:১০

বেসরকারি বিদেশি ঋণের প্রায় ৭০ শতাংশেরই মেয়াদ মাত্র এক বছর

অনলাইন ডেস্ক

বেসরকারি বিদেশি ঋণের প্রায় ৭০ শতাংশেরই মেয়াদ মাত্র এক বছর

প্রতীকী ছবি

 

দেশের বেসরকারি খাতে গত দেড় বছরে বিদেশি ঋণ প্রায় ৭৬ শতাংশ বেড়েছে। চলতি বছরের জুন শেষে এ ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৫ দশমিক ৯৫ বিলিয়ন বা ২ হাজার ৫৯৫ কোটি ডলার। বিপুল এ বিদেশি ঋণের ৬৮ দশমিক ৪ শতাংশের মেয়াদই সর্বোচ্চ এক বছর, ডলারের হিসাবে যার পরিমাণ ১৭ দশমিক ৭৫ বিলিয়ন বা ১ হাজার ৭৭৫ কোটি। স্বল্পমেয়াদি বিদেশি এ ঋণ বেসরকারি খাতের পাশাপাশি বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্যও এখন বড় বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, বেসরকারি খাতে স্বল্প মেয়াদে নেয়া বিদেশি ঋণের মধ্যে ১১ দশমিক ৯৬ বিলিয়ন ডলার ট্রেড ক্রেডিট বা বাণিজ্যভিত্তিক ঋণ। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ৯ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলার হলো বায়ার্স ক্রেডিট। মূলধনি পণ্য ও সেবা আমদানির জন্য ব্যবসায়ীরা বিদেশি ব্যাংক থেকে এ ঋণ নিয়েছেন। বাকি ঋণের ১ দশমিক ১৬ বিলিয়ন ডলার বিদেশি ব্যাক-টু-ব্যাক এলসি এবং ১ বিলিয়ন ডলার ডেফার্ড পেমেন্ট বা বিলম্বিত দায়। সরাসরি স্বল্পমেয়াদি ঋণ ও দায় হিসেবে বিদেশি উৎস থেকে এসেছে ৫ দশমিক ৭৯ বিলিয়ন ডলার। সব মিলিয়ে বিদেশি উৎস থেকে নেয়া ১৭ দশমিক ৭৫ বিলিয়ন ডলার ঋণের মেয়াদ সর্বোচ্চ এক বছর, যা বেসরকারি খাতের মোট বিদেশী ঋণের ৬৮ দশমিক ৪ শতাংশ। বাকি ৩১ দশমিক ৬ শতাংশের মেয়াদ এক বছরের বেশি। ডলারের হিসাবে এ ঋণের পরিমাণ ৮ দশমিক ১৯ বিলিয়ন। তবে বেসরকারি খাতের দীর্ঘমেয়াদি ঋণের মধ্যেও ১৩৩ কোটি ডলারের মেয়াদ এক থেকে তিন বছর। তিন থেকে পাঁচ বছর মেয়াদি বিদেশি ঋণ রয়েছে ৭৪ কোটি ডলার। পাঁচ থেকে সাত বছর মেয়াদি বিদেশি ঋণের পরিমাণ ৪৭ কোটি ডলার। আর সাত থেকে ১০ বছর মেয়াদি ৫৪ কোটি, ১০ থেকে ১২ বছর মেয়াদি ৫৩ কোটি ও ১২ বছরের বেশি মেয়াদি ৪৫৭ কোটি ডলার বিদেশি ঋণ রয়েছে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ‘ফরেন ডিরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট অ্যান্ড এক্সটারনাল ডেট’ শীর্ষক প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, বিদেশী উৎস থেকে নেয়া স্বল্পমেয়াদি ঋণ পরিশোধ নিয়ে চলতি বছরের শুরু থেকেই চাপ ছিল। এ চাপের কারণেই দেশে ডলারের বাজার অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে। চলতি বছরের মধ্যেই বেসরকারি খাতের প্রায় ১৮ বিলিয়ন ডলার ঋণের মেয়াদ পূর্ণ হয়েছে। সরকারি খাতেরও ৫ বিলিয়ন ডলার বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপ সৃষ্টি হয়। সব মিলিয়ে মাত্র এক বছরের মধ্যে ২৩ বিলিয়ন ডলার ঋণ পরিশোধের চাপ বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনই তৈরি হয়নি। তবে এরই মধ্যে সরকারি ও বেসরকারি খাতের বেশির ভাগ বিদেশী ঋণের মেয়াদ বাড়িয়ে নেয়া হয়েছে। যেসব ব্যাংক মেয়াদ বাড়াতে রাজি হয়নি সেগুলো পরিশোধ করা হয়েছে। তবে ঠিক কত পরিমাণ বিদেশি ঋণ নির্ধারিত সময়ে পরিশোধ করা হয়েছে, সে পরিসংখ্যান বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে পাওয়া যায়নি।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হকও প্রায় একই তথ্য জানান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, বেসরকারি খাতের কিছু ঋণের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। বিদেশি ব্যাংক বা প্রতিষ্ঠান ঋণের মেয়াদ বাড়াতে রাজি না হলে সেগুলো পরিশোধ করা হয়েছে। ব্যবসায়ীরা রফতানি আয় থেকে বিদেশি ঋণ পরিশোধ করেছেন। ঋণের মধ্যস্থতাকারী দেশি ব্যাংকগুলোও এক্ষেত্রে দায়িত্বশীল ভূমিকা রেখেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, গত পাঁচ বছরে বিদেশি উৎস থেকে বাংলাদেশের ঋণ দ্বিগুণ হয়েছে। সরকারের নেয়া ঋণের চেয়েও এ সময়ে বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছে বেসরকারি খাতে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বিদেশি উৎস থেকে দেশের মোট ঋণের পরিমাণ ছিল ৪৫ দশমিক ৮১ বিলিয়ন বা ৪ হাজার ৫৮১ কোটি ডলার। চলতি বছরের জুন শেষে সরকারি-বেসরকারি খাত মিলিয়ে বিদেশি ঋণের পরিমাণ ৯৫ দশমিক ৮৫ বিলিয়ন (৯ হাজার ৫৮৫ কোটি) ডলার ছাড়িয়ে যায়। বর্তমান বিনিময় হার (প্রতি ডলার ১০৬ টাকা) অনুযায়ী বাংলাদেশি মুদ্রায় এ ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ১০ লাখ ১৬ হাজার কোটি টাকারও বেশি, যা দেশের মোট জিডিপির প্রায় ২২ শতাংশ। বিপুল অংকের এ ঋণের ৭৩ শতাংশ সরকারের। বাকি ২৭ শতাংশ ঋণ নিয়েছে দেশের বেসরকারি খাত।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, পাঁচ বছর আগে দেশের বেসরকারি খাতে বিদেশি ঋণের পরিমাণ ছিল ১২ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু চলতি বছরের জুন শেষে তা ২৫ দশমিক ৯৫ বিলিয়ন বা ২ হাজার ৫৯৫ কোটি ডলারে গিয়ে ঠেকেছে। বাংলাদেশি মুদ্রায় এ ঋণের পরিমাণ ২ লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি। বিপুল অংকের এ ঋণের অন্তত ১০ বিলিয়ন ডলার নেয়া হয়েছে করোনা মহামারীর দুই বছরে। ব্যক্তি খাতের কোম্পানিগুলোর নেয়া বিদেশি ঋণের ৬৮ শতাংশই স্বল্পমেয়াদি।

২০২৩ সাল শেষে বাংলাদেশের বিদেশি ঋণের পরিমাণ ১১৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়াবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আর ২০২৪ সাল শেষে এ ঋণের পরিমাণ দাঁড়াবে ১৩০ বিলিয়ন ডলারে। দেশের বৈদেশিক মুদ্রাবাজার নিয়ে করা এক পর্যবেক্ষণে সরকারি-বেসরকারি খাতের বিদেশি ঋণ নিয়ে এ পূর্বাভাস দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রানীতি বিভাগের তৈরি করা ‘ফরেন এক্সচেঞ্জ মার্কেট মুভমেন্ট’ শীর্ষক প্রকাশনায় এ পূর্বাভাস তুলে ধরা হয়। এতে বলা হয়, গত বছর বাংলাদেশের রেকর্ড ১৭ বিলিয়ন ডলারের বিদেশি ঋণ তৈরি হয়েছে। সরকারি-বেসরকারি উভয় খাত এ ঋণ নিয়েছে। রেকর্ড এ বিদেশি ঋণের ৫৭ শতাংশই তৈরি হয়েছে বৈদেশিক বাণিজ্যের দায় বিলম্বের কারণে। এ সময় নভেল করোনাভাইরাস সৃষ্ট বৈশ্বিক দুর্যোগের কারণে আমদানি দায় পরিশোধের সময় বাড়িয়ে দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে ২০২১ সালের মোট আমদানি দায়ের ৩০ শতাংশ বিদেশী ঋণে রূপ নেয়। আমদানি দায় অপরিশোধিত থাকার কারণে স্বল্পমেয়াদি এ বিদেশি ঋণ সৃষ্টি হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, ২০২১ সালে সুদসহ দেশের বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের পরিমাণ ছিল ১১ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার। গত বছরের তুলনায় চলতি বছর বাংলাদেশকে দ্বিগুণ বিদেশি ঋণ পরিশোধ করতে হবে। ২০২২ সাল শেষে বিদেশি ঋণ পরিশোধের পরিমাণ ঠেকবে ২৩ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলারে। এর মধ্যে দেশের বেসরকারি খাতকে প্রায় ১৮ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করতে হবে। বাকি ৫ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করবে সরকার। তবে আগামী দুই বছর বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপ কিছুটা কমবে বলে মনে করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ সময়েও বাংলাদেশকে প্রতি বছর সুদসহ ২০ বিলিয়ন ডলার বিদেশি ঋণ পরিশোধ করতে হবে।

বেসরকারি খাতে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি বিদেশী ঋণের উল্লেখযোগ্য অংশ বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতের। এর মধ্যে ৪৩৩ কোটি ডলার নিয়েছেন বিদ্যুৎ খাতের ব্যবসায়ীরা। বিদ্যুৎ কোম্পানি ছাড়াও রফতানি আয় নেই এমন অনেক শিল্পোদ্যোক্তা বিদেশি বিভিন্ন উৎস থেকে ঋণ নিয়েছেন। কিন্তু ডলার সংকট ও দাম বেড়ে যাওয়ায় এখন ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে ক্ষতির মুখে পড়ছেন। আবার অনেক ব্যবসায়ী ক্ষতির অজুহাতে বিদেশী ঋণ পরিশোধে বিলম্বে করতে চাইছেন। এ অবস্থায় অফশোর ইউনিটের মাধ্যমে ঋণের অর্থ জোগানদাতা ব্যাংকগুলোও বিপদে পড়েছে। আর বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) মাধ্যমে সরাসরি বিদেশি ঋণ নিয়ে আসা কোম্পানিগুলোও যথাসময়ে কিস্তি পরিশোধ করা নিয়ে শঙ্কায় রয়েছে।

রেকর্ড এলসি দায় পরিশোধের পাশাপাশি সরকারি-বেসরকারি বিদেশি ঋণের কিস্তি পরিশোধ নিয়ে দিশেহারা পরিস্থিতি পার করছে দেশের ব্যাংক খাত। বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে তীব্র ডলার সংকটের কারণে অনেক ব্যাংক চাইলেও যথাসময়ে এলসি দায় পরিশোধ করতে ব্যর্থ হচ্ছে। আবার বিদেশি ঋণের কিস্তির ডলার সংস্থান করতে পারছে না কিছু ব্যাংক। এ অবস্থায় প্রতিনিয়ত বাজারে ডলার বিক্রি করতে হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংককে। গত অর্থবছরে রিজার্ভ থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিক্রি করেছে প্রায় ৭৫০ কোটি ডলার। চলতি অর্থবছরের এখন পর্যন্ত প্রায় ৭০০ কোটি ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। অব্যাহতভাবে ডলার বিক্রি করায় দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩৩ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। যদিও গত বছরের আগস্টে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৪৮ বিলিয়ন ডলার।

দেশের বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে অস্থিরতার কারণে গত এক বছরে ডলারের বিপরীতে টাকার প্রায় ২৫ শতাংশ অবমূল্যায়ন হয়েছে। ২০২১ সালের অক্টোবরে দেশে প্রতি ডলারের বিনিময় মূল্য ছিল ৮৫ টাকা। গতকাল কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদিত প্রতি ডলারের দর ছিল ১০৬ টাকা।

সৌজন্যে : বণিক বার্তা।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর