২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ ০৮:২৩

কমছে কাজ, বাড়ছে চাকরিপ্রার্থী

সুখবর নেই কোথাও। ব্যাংক ও বীমায় অস্থিরতা। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতেও কমেছে কাজের সুযোগ। সরকারি-বেসরকারি উভয় খাতেই কমেছে নিয়োগ-সংক্রান্ত বিজ্ঞাপন। পরিকল্পনামন্ত্রী বলছেন, যারা কাজ পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ করছেন তাদের বেশির ভাগই স্বেচ্ছা বেকার।

মানিক মুনতাসির

কমছে কাজ, বাড়ছে চাকরিপ্রার্থী

প্রতীকী ছবি

ঘটনাপ্রবাহ-১: নুর মোহাম্মদ। বাড়ি টাঙ্গাইল। ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার। বয়স ৩০ ছুঁই ছুঁই। ঢাকায় থাকেন বছর দশেক। কাজ করতেন ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (ডিপিডিসি) প্রি-পেইড মিটার প্রকল্পে। করোনা মহামারির সময় কাজ ছেড়ে দেন। এর পর থেকে সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক, বিমা, এনজিওসহ বহু প্রতিষ্ঠানে চাকরির জন্য সিভি জমা দিয়েছেন। সাক্ষাৎকারও দিয়েছেন বহু জায়গায়। কিন্তু চাকরি হচ্ছে না। কয়েক দিন আগে কথা হয় নুর মোহাম্মদের সঙ্গে। তিনি জানান, বিয়ের জন্য পাত্রী ঠিক করা আছে বছরখানেক আগে থেকেই। চাকরি না হওয়ায় বিয়েটাই এখন আটকে আছে। বিদেশ যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বিদেশে শ্রমবাজারের অবস্থা ভালো নয় জেনে পরিবার থেকে যেতে দিচ্ছে না। ফলে জীবনের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন নুর মোহাম্মদ।

ঘটনাপ্রবাহ-২ : সাবিনা ইয়াসমিন। গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করেন প্রায় ১০ বছর। ঢাকার বিভিন্ন এলাকায়। শনিবার। সকাল সকাল দেখা হয় রাজধানীর খিলগাঁও তালতলায়। নুরবাগ মসজিদের সামনে। বয়স ৪০। চার মাস আগে কাজ হারিয়েছেন। এখন কাজ পাচ্ছেন না। পেলেও বেতন কম। ফলে রিকশাচালক স্বামীর ওপর চাপ বেড়েছে পরিবারের খরচ জোগানোর। এরা ছাড়াও রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার কাজের হাট ঘুরে (অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের) কাজের লোকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাদেরও কাজের সুযোগ কমেছে। মজুরিও কমেছে। অথচ জীবনধারণের খরচ বাড়ছে প্রতিদিনই। ফলে বিভিন্ন পেশায় বিরাজ করছে অনিশ্চয়তা। একদিকে দক্ষ লোকের অভাব, অন্যদিকে কাজের সংকট। করোনা মহামারির পর চলমান বৈশ্বিক সংকটে চাকরি-বাকরির সুযোগ কমেছে। একাধারে কমেছে শ্রমজীবী বা দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে কাজের সুযোগও। অনেক ক্ষেত্রে রিকশাচালকদের আয়ও কমেছে তুলনামূলকভাবে। ফলে প্রাতিষ্ঠানিক বা অপ্রাতিষ্ঠানিক সব ধরনের কাজের বাজারে বিরাজ করছে মন্দা। বিশ্লেষকরা বলছেন, ব্যাংক, বিমা, করপোরেট, এনজিওসহ বেসরকারি খাত ও সরকারি খাত কোথাও কাজের সুখবর নেই। ব্যাংক ও বিমায় অস্থিরতা। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতেও কমেছে কাজের সুযোগ। সরকারি-বেসরকারি উভয় খাতেই কমেছে নিয়োগ-সংক্রান্ত বিজ্ঞাপন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাস্তবে চাকরির বাজারে ভয়াবহ সংকট বিরাজ করছে। আতঙ্ক ও অস্থিরতা বাড়ার আশঙ্কায় প্রকৃত চিত্র প্রকাশ করছে না সরকার। বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘দেশে দক্ষ লোকের অভাব আছে এটা ঠিক। আবার বহু লোক কাজ পাচ্ছে না। বেকার রয়েছে। সেটাও সঠিক। করোনা মহামারির পর এখানে সংকট কিছুটা বেড়েছে। আমাদের আসলে কর্মমুখী শিক্ষার প্রসার ঘটাতে হবে। পাশাপাশি চাকরি-বাকরির আশায় যুবকদের যেন বসে থাকতে না হয় সে জন্য বিশ্ববিদ্যালয়জীবন থেকেই তাদের খন্ডকালীন কাজের ব্যবস্থা করার কথা ভাবার সময় এসেছে। অন্যথায় আমরা পিছিয়ে পড়ছি। আমাদের শ্রমশক্তিকে ভালোভাবে কাজে লাগাতে হলে সময়মতো কাজের ব্যবস্থা করতে হবে।’ এখানে সরকারের অনেকগুলো দুর্বলতা রয়েছে বলে তিনি মনে করেন।

এদিকে অর্থ মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, শ্রম মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থার তথ্যমতে, গ্যাস-বিদ্যুতের সংকট যেমন শিল্প খাতের টানাপড়েনের সৃষ্টি করেছে, ঠিক তেমন ডলার সংকটের প্রভাবে কাজের সুযোগ কমেছে। কেননা নতুন করে বিনিয়োগের আগে উদ্যোক্তারা বারবার ভাবছেন। নিশ্চিন্তে বিনিয়োগ করতে পারছেন না। আবার বৈশ্বিক সংকট তো এক ধরনের অনিশ্চয়তাও তৈরি করেছে শিল্পসহ সামগ্রিক অর্থনেতিক খাতে। ফলে বেকারত্ব বাড়ছে। অবশ্য বিশ্বব্যাপী একই চিত্র লক্ষ করা যাচ্ছে বলে মনে করে জাতিসংঘের শ্রম সংস্থা আইএলও।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের পোশাক খাতে নতুন কোনো বিনিয়োগ নেই। নতুন কর্মী নিয়োগ হচ্ছে না। বাস-ট্রাকসহ বিভিন্ন পরিবহনের নিবন্ধন কমেছে। অনেক হোটেল-রেস্তোরাঁ বন্ধ হয়ে গেছে। সেগুলো আর নতুন করে খোলা সম্ভব হয়নি। ফলে চাকরির বিজ্ঞাপনও কমেছে প্রায় ২০ শতাংশ। এ অবস্থায় সরকারের হাতে কর্মসংস্থান হালনাগাদের কোনো তথ্যও নেই। চাকরির সুযোগ বাড়ল নাকি কমল, এর প্রবণতা বুঝতে সরকারি কোনো পরিসংখ্যান নেই। আবার মানুষের আয় বেড়েছে কি না, এর কোনো হালনাগাদ পরিসংখ্যানও নেই। মানুষের কর্মসংস্থান, আয়-ব্যয়ের প্রকৃত চিত্র মিলছে না। কেননা পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে শ্রমশক্তি জরিপ এবং খানা আয় ও ব্যয় জরিপ এর কোনোটিই হয়নি। ফলে এই সময়ে কতসংখ্যক মানুষ বেকার হয়েছে, কতসংখ্যক মানুষ কাজের বাজারে ঢুকেছে আর কতসংখ্যক মানুষ কাজের বাজারে ঢোকার যোগ্য হলেও ঢুকতে পারেনি এর কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই সরকারের হাতে। অবশ্য পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলছেন, করোনা মহামারির ফলে বিপুলসংখ্যক তরুণ ফ্রিল্যান্সিংয়ের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। সরকারের বহু প্রকল্পও চলমান রয়েছে, যেগুলোতে গত কয়েক বছর লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। আর যারা কাজ পাচ্ছেন না বলছেন, তাদের বেশির ভাগই স্বেচ্ছা বেকার। এদের অধিকাংশই শিক্ষিত ও উচ্চশিক্ষিত বলে তিনি মনে করেন। দেশের বেসরকারি খাতের সবচেয়ে বড় শ্রমশক্তি নিয়োজিত তৈরি পোশাক খাতে। প্রায় অর্ধকোটি মানুষ এতে সরাসরি কাজে নিয়োজিত। এর বাইরেও লাখ লাখ মানুষ ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজের মাধ্যমে এ খাতের সঙ্গে যুক্ত। তবে গত কয়েক বছরে অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। কারখানার মালিকদের আয় কমেছে। ফলে নতুন করে কর্মী নিয়োগও কমেছে। এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে নতুন নিয়োগ বন্ধই রয়েছে। সাধারণত যে কোনো একটি দেশের বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের একটি চিত্র পাওয়া যায় মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির ওপর। প্রায় এক বছর ধরে চলমান ডলার সংকটের কারণে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি আগের বছরের জুলাই-ডিসেম্বরের তুলনায় ২০২২ সালের একই সময়ে কমেছে ৬৭ শতাংশ। ফলে নতুন বিনিয়োগ কমেছে ব্যাপক হারে। এ জন্য কর্মসংস্থানের চাকাও স্থবির হয়ে পড়েছে। এদিকে ২০২০-২১ বছরের তুলনায় গত বছর বিনিয়োগ প্রস্তাব নিবন্ধনের সংখ্যাও কমেছে দেড় হাজারের বেশি।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর