শুক্রবার, ১৭ মে, ২০১৩ ০০:০০ টা
খোলা কলাম

সাভারে গণহত্যা : আইন পলাতক

রণেশ মৈত্র

সাভারে গণহত্যা : আইন পলাতক
যে কোনো বিবেচনায় সাভারের ভবন ধসকে বেপরোয়াভাবে ঘটানো গণহত্যা বলে অভিহিত করতেই হবে। আর যারা তা ঘটাল গণদাবির পরিপ্রেক্ষিতে তাদের সরকার গ্রেফতার করতে এই প্রথমবারের মতো বাধ্য হলেও শেষ পর্যন্ত যেসব অভিযোগে তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, তাতে তারা যে দু-তিন মাস পর, তপ্তাবস্থা খানিকটা শীতল হয়ে এলেই জামিনে মুক্তি পাবে এবং তার পর পরিচিত সব পদ্ধতি অবলম্বন করে ওই সব মামলারও অপমৃত্যু ঘটবে_ তাও নির্দ্বিধায় বলে দেওয়া যায়। গার্মেন্ট সেক্টর সম্পর্কে যারাই বিগত দুটি দশকের করুণ ঘটনাসমূহ বিশেষভাবে লক্ষ্য করেছেন, স্মরণে রেখেছেন তারা সবাই নির্দ্বিধায় আমার সঙ্গে একমত হবেন বলে আমি গভীরভাবে বিশ্বাস করি। বেদনাদায়ক হলেও আমার এ ধারণা আজ আর শুধু ধারণা নয়_ গভীর বিশ্বাসে পরিণত। আরেকটি বিষয়ে সম্ভবত একই সঙ্গে সত্য বলে সবাই মানবেন_ দু-চার মাস পর পর একই জাতীয় ঘটনা, যা নির্ভয়ে-নির্বিচারে-নিশ্চিন্তে আজতক ঘটেই চলেছে তার খবরাদি গণমাধ্যমসমূহে দেখে বা পড়ে আমরা ওই নিষ্ঠুর গার্মেন্ট শিল্পের মালিকদের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করতে পারছি_ তাদের দেশদ্রোহী, জাতিদ্রোহী বলে দফায় দফায় চিহ্নিত করতে পারছি_ দেশবাসীর মধ্যে মানবতার জয়গান গাওয়া ও দেশপ্রেমে বার বার উদ্বুদ্ধ হওয়ার প্রেরণা সঞ্চারিত হচ্ছে_ সর্বাত্দক ঘৃণারও সৃষ্টি হচ্ছে। দেশ ও জাতির ভয়াবহ শত্রু তারা, যারা শ্রমজীবী নারী-পুরুষের হত্যাকারী হিসেবে আবিভর্ূত একশ্রেণীর পোশাক-শিল্প মালিককে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে ফুলে-ফেঁপে ওঠার সুযোগ করে দিচ্ছে। ধনিক শ্রেণী ও তাদের নিয়ন্ত্রিত শাসক শ্রেণীর বিরুদ্ধে কিছুকাল পর পরই শ্রমজীবী মানুষের সর্বাত্দক প্রতিরোধ গড়ারও প্রেরণা জোগাচ্ছে তাদের এসব কর্মকাণ্ড। কিন্তু এ তো হলো খারাপ ও গর্হিত কাজের প্রতিক্রিয়া হিসেবে পরোক্ষে ঘটে যাওয়া ইতিবাচক ফলাফলের কাহিনী। একে প্রশংসা করার কিছু নেই। একে স্বাগত জানালে সরাসরি এমনতর ভয়াবহ প্রাণঘাতী ঘটনাবলী অনবরতই ঘটার অনুকূলে বলা হবে। না, তা কেউ চায় না। চাইতে পারে না। অবিলম্বে বন্ধ হোক এমন ভবন ধস, ভবনে আগুন লাগা আর সে কারণে নির্বিবাদে হাজার হাজার গার্মেন্ট কর্মীর প্রাণ হারানোর ঘটনা। তাদের অকালে এই পৃথিবী থেকে বিদায় নেওয়ার পৌনঃপুনিক ঘটনা বন্ধ হোক। সমাপ্তি ঘটুক এমন প্রাণঘাতী ঘটনাসমূহ। জীবনের ও কাজের নিরাপত্তা সূচিত হোক সব গার্মেন্ট কর্মীর। কিন্তু এমন একটি কামনা তো সবারই এবং এই শিল্পের জন্মকাল থেকেই নানাজনের কণ্ঠে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। বার বার এমন আকাঙ্ক্ষা, এমন দাবি সংঘটিত-অসংঘটিত উভয়ভাবেই প্রকাশিত হচ্ছে_ উচ্চারিত হচ্ছে, ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হচ্ছে দেশের আনাচে-কানাচে। শ্রমজীবীদের সঙ্গে তেমন প্রতিবাদ জানাতে দেশবাসীও পিছিয়ে থাকছে না। এমন নারকীয় ঘটনাবলী দেশে এযাবৎ গার্মেন্ট সেক্টরে একটি-দুটি না একবার-দুইবার ঘটেনি। অনবরত ঘটছে। প্রতি বছর ঘটছে বছরে দুইবার-তিনবার করে ঘটছে এবং প্রতিবার প্রতিটি ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গেই কী অদ্ভুত নৈপুণ্য, নিষ্ঠা, দরদ ও আন্তরিকতা নিয়েই না দেশের প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াসমূহ দিনের পর দিন খবর প্রকাশ করে থাকে, তুলে ধরে ঘটনাগুলোর ভয়াবহতার চিত্র, করুণ আর্তনাদের চিত্র। ঘটনার পেছনের ঘটনার কাহিনীসমূহ। দিনের পর দিন দেশের সাংবাদিক সমাজ প্রতিবারই এভাবে খবর সংগ্রহ করে, তা বিশ্লেষণ করে নিষ্ঠুর মালিকদের নিষ্ঠুরতা ও বর্বরতার খবর দেশ-বিদেশের কোটি কোটি মানুষের কাছে পেঁৗছে দিচ্ছেন। প্রতিবাদে এমন ঘটনাসমূহ বন্ধের দাবিতে কতই না সমাবেশ-মিছিলের সচিত্র খবর, কত সম্পাদকীয়, উপ-সম্পাদকীয়, নিবন্ধ কতদিন ধরে আমাদের সংবাদপত্রসমূহ প্রকাশ করে_ জনদাবি সবাই অবহিত করেন, জনমতকে কতই না ধৈর্যের সঙ্গে সংঘটিত করেন, তার কোনো লেখাজোকা নেই। এভাবেই আমাদের সংবাদপত্রসমূহ সেই মহান রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে পরবর্তী সময়ে সংঘটিত ধারাবাহিকভাবে সব গণতান্ত্রিক আন্দোলন, একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতা-উত্তর যুগে এসেও যখনই কোনো গণতন্ত্র ও মানবাধিকার-বিরোধী ঘটনা ঘটেছে আমাদের সংবাদপত্রসমূহ তখনই তার প্রতিবাদে মুখর হয়ে উঠেছে। যে কোনো অন্যায়, দুর্নীতি, অপশাসনের বিরুদ্ধেও রুখে দাঁড়াতে আমাদের দেশপ্রেমিক সাংবাদিক সমাজ কদাপি এতটুকু কুণ্ঠাবোধ করেননি। গার্মেন্ট সেক্টরে সাভারে এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে যা ঘটল তার তাবৎ মর্মান্তিকতা, ভয়াবহতা, নাটকীয়তাকেও দেশ-বিদেশের মানুষের সামনে তুলে ধরতেও একইভাবে নিষ্ঠা ও কর্তব্য সচেতন মন নিয়ে তারা এগিয়ে এসেছেন। যার ফলে কি সুদূর অস্ট্রেলিয়ার দ্য অস্ট্রেলিয়ান, সিডনি মর্নিং হেরাল্ড, এবিসি টেলিভিশন, ইউরোপ-আমেরিকার বিবিসি-সিএনএন, ভয়েস অব আমেরিকা, রয়টার্স, ভারতের পিটিআই থেকে শুরু করে নামকরা হেন বিদেশি পত্র-পত্রিকা, রেডিও-টেলিভিশনের নাম করা যাবে না_ যাতে গুরুত্বসহকারে এই ভয়াবহ গণহত্যার খবর প্রকাশ বা প্রচার করা হয়নি।' দেশ-বিদেশের সংবাদ মাধ্যমেরও কম অবদান নেই সাভারের রানা প্লাজায় ধস ও গণহত্যার জন্য দায়ী মালিক সোহেল রানা নামক কুখ্যাত সন্ত্রাসী ও ওই প্লাজার বিভিন্ন তলায় যেসব গার্মেন্ট শিল্প মালিক সব নিয়ম-কানুন অমান্য করে তাদের কারখানা অমানবিক বর্বরতার সঙ্গে সেদিন খোলা রেখে হাজারো নারী-পুরুষ শ্রমিককে ভয় দেখিয়ে আগের দিন ফাটল দেখা দেওয়া সত্ত্বেও কারখানা নামক মৃত্যুকূপে শ্রমিকদের আপত্তি অগ্রাহ্য করে জোর করে ঢুকিয়ে ওই হত্যালীলার শিকারে পরিণত করা হয়_ তাদের গ্রেফতারের পেছনে বিপুল অবদান রেখেছে। এমন বর্বরোচিত পৈশাচিক নরহত্যা অতীতে কদাপি কেউ বাংলাদেশ ছাড়া অন্য কোনো দেশে ঘটতে দেখেছে বা শুনেছে বলেও জানা যায় না। একনাগাড়ে সাত-আট দিন ধরে উদ্ধার অভিযানও তো একটি ধস নামা দালানের নিচে চাপা পড়া হাজার হাজার মানুষ উদ্ধার করে চলেছে_ সে জীবিত কি মৃত যাই হোক না কেন_ আমার সুদীর্ঘ ৮০ বছরের জীবনে কদাপি তা শুনিনি। আবার এই প্রসঙ্গে লিখতে গিয়ে আমাদের দেশের অগণিত সাধারণ মানুষ, গরিব মানুষ_ সৎ মানুষদের অসম সাহসী ও দরদি চিত্তের যে সক্রিয় বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে গোটা বিশ্বের মানবিকতার ইতিহাসে তাও বিরল ঘটনার সাক্ষ্য বহন করবে অনাদি-অন্তকাল ধরে। হাজার হাজার নর-নারী ছুটে এসেছেন সাভারে, পেটের ভাত জুটেছে কি জোটেনি সেদিকে আদৌ কোনো নজর না দিয়ে। কোনো প্রকার প্রশিক্ষণ নেই_ নেই কোনো বেতন-ভাতার ব্যবস্থাও। তবু তারা কাজ করবেন, উদ্ধার কাজ চালাবেন নিহত-আহত শ্রমিকদের উদ্ধার করবেন। বাঁচানোর চেষ্টা করবেন_ এ এক অভাবিত ঘটনা। মানুষ মানুষের জন্য প্রায় বিস্মৃত এই প্রবাদ বাক্যটি সাভারের নির্মমতার প্রতীক রানা প্লাজার গণহত্যা কতই না উজ্জ্বলভাবে দেশ-বিদেশের মানুষের সামনে তুলে ধরল! তারা অকুতোভয়ে ঢুকে পড়লেন ওই মৃত্যুকূপে_ ধ্বংসস্তূপ থেকে মানুষজনকে সযত্নে বের করে আনতে লেগে গেলেন কারও আদেশ-নির্দেশ-অনুরোধ-উপরোধের অপেক্ষায় না থেকে। এ এক নতুন বাংলাদেশ দেখলাম, যেন পৃথিবীও প্রত্যক্ষ করল বৈকি। এভাবে উদ্ধার অভিযানে অংশ নিলেন যে অগণিত সাধারণ মানুষ তাদের কোনো তালিকাও প্রণয়ন করা হয়েছে বলে জানা যায়নি। তবে এ কথা জানা গেছে, ওই অভিযান স্বেচ্ছায় চালাতে গিয়ে প্রাণ দিয়েছেন বেশ অনেকেই। তারাও তাদের পরিবার পরিজনকে কাঁদিয়ে বিদায় নিলেন নীরবে-নিভৃতে কর্মময় এ পৃথিবী থেকে। মরণোত্তর কোনো কিছু তারা পাবেন কি? কেউ এগিয়ে আসবেন কি এমন সাধারণ মানুষের, যারা স্বেচ্ছায় স্বপ্রণোদিত হয়ে আত্দদান করলেন সাভারের রানা প্লাজা নামক আতঙ্ক স্তূপে তাদের তালিকা তৈরি করে সংবাদপত্রে প্রকাশ করার? সরকার আসবে কি এগিয়ে এই কাজে। এসব মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো যে জাতির বিশেষ করণীয় একটি কাজ। তাদের ওপর নির্ভরশীল পরিবারের সদস্যদের দায়িত্বও গ্রহণ করবে কি সরকার? আর যে ব্যাপারটি জেনে দেশবাসী ভয়াবহ মনঃপীড়ায় ভুগছেন তা হলো, এমন জাতীয় ঘটনার প্রতিবিধান ও উপযুক্ত শাস্তির বিধান রেখে কোনো কড়াতাকের আইনও নাকি দেশে নেই। সত্যিই যদি তা হয়ে থাকে, তবে তার জন্য দায়ী করব কাকে? সরকারকে নিশ্চয়ই। কিন্তু তা হচ্ছে কেন? সরকার কেন উপযুক্ত আইন করছে না? তবে এই সরকার বা অতীতের সব সরকার পীড়ন-অত্যাচারীদের বাঁচানোর জন্য যে কঠোর কোনো আইন প্রয়োগ করেনি, তা বুঝতে কারও বিলম্ব হওয়ার কথা নয়। তবুও ইবঃঃবৎ ষধঃব ঃযধহ হবাবৎ অতীতে করা হয়নি_ অন্যায় হয়েছে। এখন করা হোক। অবিলম্বে কঠোর শাস্তির বিধান রেখে আইন প্রণয়ন করাই শুধু নয়, তার নিশ্চিত ও কার্যকর প্রয়োগেরও ব্যবস্থা করা হোক অবিলম্বে। এ ব্যাপারে কোনো প্রকার কালক্ষেপণ হবে পরিপূর্ণভাবে গণবিরোধী পদক্ষেপ। পরিশেষে যেসব ছেলে-মেয়ে ওই মৃত্যুকূপে প্রাণ দিতে বাধ্য হলেও বরং যারা আহত হলেন, কি বলে তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাব_ তা ভেবে পাই না। এরা তো তারাই, যাদের জীবনযাত্রা মানবেতর। যাদের পরনে কাপড় নেই, পেটে ভাত নেই। নিজেদের বা সন্তানদের শিক্ষার ব্যবস্থা নেই। বসবাসের ব্যবস্থা নেই, কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা নেই। নিশ্চয়তা আছে শুধু বেঘোরে প্রাণ দেওয়ার_ সেই অসহায় গরিব মানুষগুলোই তো দিনরাত পরিশ্রম করে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রেখেছেন_ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ গড়ে তুলেছেন। সোহেল রানা এবং তার মতো হাজারো মালিকের অর্থ, বিত্ত, বৈভব, বিলাসী জীবন গড়ে তুলেছেন_ তাদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা, অসীম কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলি_ 'ক্ষমা কর মোরে' তোমাদের বাঁচাতে যারা আমরা ব্যর্থ হয়েছি, নিজেদের সচেতন দেশপ্রেমিক বলে দাবি করা সত্ত্বেও_ তাদের এই ব্যর্থতার দায় তো আমাদেরই বহন করতে হবে। করজোড়ে ক্ষমা প্রার্থনা ছাড়া এবং ভবিষ্যতে তাদের বাঁচানোর আন্দোলনে শরিক হওয়ার প্রত্যয় ঘোষণা ছাড়া আর কিছুই তো করার নেই। তোমরা অমর। লক্ষণীয়, এই প্রাণগুলোর জন্য রক্তদানের আয়োজন করল গণজাগরণ মঞ্চ এবং অজস্র তরুণ-তরুণী ধর্ম-বর্ণ, সম্প্রদায়, নির্বিশেষে। না, আসেনি জামায়াতে ইসলামী, আসেনি হেফাজতে ইসলামও। লেখক : রাজনীতিক ই-মেইল : [email protected]

সর্বশেষ খবর