শুক্রবার, ১৭ মে, ২০১৩ ০০:০০ টা

কুপি বাতির গণতন

সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল

কুপি বাতির গণতন
কারাগারে আমার কক্ষের জানালার পাশে দেয়াল ঘেঁষে দুটি হারিকেন বাতি আমার নিকট-প্রতিবেশী। প্রতিদিন শেষ বিকালে এগুলো রেখে যায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত একজন বন্দী। হারিকেনগুলো জ্বালানো থাকে না। তবে আমাদের সেবক হিসেবে পাশের কক্ষে থাকা কয়েদিদের বলে দিয়ে যাওয়া হয়, প্রয়োজনে দ্রুত জ্বালিয়ে দেওয়ার জন্য। দুটি হারিকেনই পরদিন সকালে এসে নিয়ে যায় একই ব্যক্তি। দীর্ঘদিনে একবারও এগুলো জ্বালানোর প্রয়োজন হয়নি। কৌতূহলবশে দু-এক দিন হাতে ধরে পরখ করে দেখেছি তেল-সলতে-চিমনি সবই ঠিক আছে। পরিষ্কার করে রাখা আছে যত্নে ঘষামাজা করে। শুধু দেখা হয়নি ওগুলো আসলেই জ্বলে কিনা, কিংবা জ্বললে স্থায়িত্বকাল কি? চার্জার লাইট, প্রায় ভুলিয়ে দিয়েছিল হারিকেন বাতির অস্তিত্ব। খুব ক্রান্তিকালীন এক সময় এ অন্ধকারে খুঁজে পেতে হয়রান হয়ে সফলতার সঙ্গে প্রাপ্তি এলো এবং হারিকেনগুলো নিজেদের জ্বালিয়ে এবং জ্বলে আমাদের নিকষ অাঁধার থেকে বের করে নিয়ে এলো, সে ঘটনাক্রমে পরে আসছি। কাচের চিমনিওয়ালা সলতে যখন তেল থাকা সত্ত্বেও আলো জ্বালাতে পারে না, তখন ক্রমশ বিস্তৃতির অতলে হারিয়ে যাওয়াই স্বাভাবিক। যেমন বর্তমান বাংলাদেশে চারপাশের অবস্থাদৃষ্টে যা দেখছি, তাতে অহিংসতা, ধৈর্য, সংযম, দায়িত্বশীলতা তথা গণতন্ত্রের কথা প্রায় ভুলতে বসেছি আমরা। জাতীয় সংসদে দায়মুক্তি দিয়ে কুইক রেন্টালের চুরির মহোৎসব, শেয়ারমার্কেটের আওয়ামী ঐতিহ্যবাহী সর্বনাশা লুটপাট, রেলের কালো বিড়াল ধরার প্রতিশ্রুতিতে নিজেদেরই কালো বিড়াল হওয়া, হলমার্ক, ডেসটিনি মিলিয়ে দেশের মহা-সর্বনাশ হলেও শাসক দলের ডেসটিনি বোধ হয় নির্ধারিত হয়ে গেছে। এ ছাড়াও পদ্মা সেতুতে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে চোরের উপাধিপ্রাপ্ত দেশ হয়েও চোরকে জাতীয় খেতাব দেওয়া হলো 'দেশপ্রেমিক' বলে, কি নির্মম রসিকতা জাতির সঙ্গে। দ্রব্যমূল্য বাড়লে কথা বলা যাবে না_ জ্বালানি তেল, গ্যাস, বিদ্যুৎ, পরিবহন ভাড়া ইচ্ছামতো যখন-তখন বাড়বে, প্রতিবাদ করা যাবে না। মিথ্যা মামলা দিয়ে গ্রেফতার-নির্যাতন, মহিলা রাজনীতিকদের পর্যন্ত রিমান্ডে নেবে, টুঁ-শব্দটিও করা যাবে না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অস্ত্রের নিশানা ঠিক রাখার নিয়মিত প্র্যাকটিস হচ্ছে, সহজ ভাষায় চানমারী। এখন প্রতিদিনই সেই চানমারী প্র্যাকটিস হচ্ছে অস্ত্র এবং গুলি কেনার অর্থের জোগানদাতা এ দেশের সাধারণ প্রতিবাদী মানুষের ওপর। মরছে মানুষ, দাফন হচ্ছে মানবতা, পোস্টমর্টেম হচ্ছে, কোন ভাষায় বিবৃতি দিলে বিরোধী দলের ওপর দায় চাপানো যায়, তার সব কুকীর্তি ভুলিয়ে দেওয়ার নতুন সালসা আবিষ্কার করছে মহাজোট সরকার। সেই সালসার নাম হচ্ছে 'যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাধাগ্রস্ত করা'। জনজীবনের যে কোনো দুর্ভোগ নিয়ে কথা বললে, রাস্তায় নামলে এ আপ্তবাক্যটি বাজিয়ে দেওয়া হয়। ভাবখানা এমন_ রাস্তার পাশে অবস্থিত কোনো বাড়ি কিংবা ফ্ল্যাটে স্বামী-স্ত্রী কিংবা কিশোর-কিশোরী, ভাই-বোন যদি উচ্চকণ্ঠে ঝগড়াও করে, তবুও সরকারি প্রেসনোট প্রকাশিত হবে_ 'অমুক এলাকায় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচালে নাশকতার পরিকল্পনা হচ্ছিল'। ঠাকুরমার ঝুলির গল্পগুচ্ছ আমরা অনেকেই কমবেশি জানি। যে সব গল্পে বাস্তবতাকে ভুলিয়ে দেওয়া হয় কিছু সময়ের জন্য হলেও। কিন্তু ২০০৮-এর ডিসেম্বরের পর থেকে বড় ঠাকুরমার খপ্পরে পড়েছে দেশ। তার ঝুলির গল্প আর শেষ হয় না। সব গল্পের মূল সুর হচ্ছে একমাত্র তিনি এবং তার সাঙ্গোপাঙ্গরা হচ্ছেন গণতন্ত্রের পূজারি, দেশদরদি, তথা দেশপ্রেমিক। দেশে ড. ইউনূস, ব্যারিস্টার রফিক-উল হক, মাওলানা আল্লামা শফী থেকে মাহমুদুর রহমান, ড. আনু মোহাম্মদরা পর্যন্ত সবাই গণতন্ত্র ধ্বংসের ষড়যন্ত্রকারী, দেশবিরোধী, তথা দেশদ্রোহী। এ বি এম মূসা, ফরহাদ মজহার, মতিউর রহমান চৌধূরী, আসিফ নজরুল, পিয়াস করিম, নুরুল কবির, মিনা ফারাহ, মাসুদা ভাট্টিরা হচ্ছেন নিশিকুটুম্ব কিংবা সিঁধকাটা। সর্বজনশ্রদ্ধেয় আলেম-উলামা, মাশায়েখরা হচ্ছেন ধর্মান্ধ কিংবা ইসলামের অপ-ব্যাখ্যাকারী, আর নাশকতার সব ফসলের কৃষক হচ্ছে বিএনপি-জামায়াত। রাস্তায় হঠাৎ কোনো গাড়ির চাকা সশব্দে ফেটে গেলেও সরকার বলতে চায় বিএনপি-জামায়াত ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। এমনকি প্রচণ্ড শব্দে দূরে কোথাও বজ্রপাত হলে বিরোধী দলের তাণ্ডব বলে চালিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা করা হয়। এমনও হতে পারে বিদ্যুতের ট্রান্সফরমার বিস্ফোরণ ঘটলে সেই নাশকতার মামলায় সব আসামি এবং পরিকল্পনাকারী বিরোধী দলের আলোচিত নেতারা। মনে হয়, ভিনগ্রহের কোনো এলিয়েন এসে দেশ শাসন করছে। তারা মানুষের মনের ভাষা দূরে থাক, মুখের ভাষাই বোঝে না। চলে নিজেদের খেয়ালে। এই গ্রহ রাখতে চায় ধূর্ততার দখলে। সম্প্রতি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জাতীয় সংসদে প্রশ্নোত্তর পর্বে বিরোধী দলবিহীন স্বজাতীয়দের জিজ্ঞাসায় বর্তমান সরকারের চার বছরে দেশে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের যে পরিসংখ্যান দিয়েছেন, তা রীতিমতো আতঙ্কের। ১০ ফেব্রুয়ারি সংসদের ১৬তম অধিবেশনে প্রদত্ত সেই পরিসংখ্যানে ২০০৯-২০১২ পর্যন্ত মোট হত্যাকাণ্ডের সংখ্যা ১৬ হাজার ২৮৫ জন। এ সময় শুধু ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকায় খুন হয়েছেন এক হাজার ৮৮ জন, পুলিশ রেকর্ডের বাইরের হত্যাকাণ্ড যদি বাদও দেই তাতেও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর হিসাবে এই সরকার আমলে ২০১২ পর্যন্ত খুন হয়েছে প্রতিদিন গড়ে ১২ জনের কাছাকাছি। কি ভয়ঙ্কর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সরকারি স্বীকৃতি অনুযায়ী। একই সঙ্গে ২০১৩-এর ফেব্রুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত যে নিষ্ঠুর জীবননাশের প্রতিযোগিতা সেটা যোগ করলে মনে হয় না, আমরা সুদান, আইভরি কোস্ট, ইরাক, আফগানিস্তানের চেয়েও পেছনে পড়ে থাকব। এর চেয়েও গণতান্ত্রিক সংবাদ আছে_ ১০ ফেব্রুয়ারির সংসদ অধিবেশনে ম. খা. আলমগীরের দেশে খুনের পরিসংখ্যান প্রদানে সরকারের মধ্যে ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি হয়। তাতে তাৎক্ষণিক দুজন পুলিশ কর্মকর্তা হয়রানির সম্মুখীন হন। সংসদবিষয়ক কাজের দায়িত্বপ্রাপ্ত দুজন পুলিশ কর্মকর্তাকে ওএসডি করা হয়। যদিও ওই দুই পুলিশ কর্মকতা লিখিতভাবে পুলিশ সদর দফতরে জানান, মাঠভিত্তিক দাফতরিক পরিসংখ্যানের ভিত্তিতেই তারা রিপোর্টটি তৈরি করেছেন। কিন্তু কে শোনে কার কথা। ওই ব্যাটাদের এত বড় অপসাহস যে, সত্য হলেই বলে দেবে, 'রাজা ন্যাংটা হাঁটছে'। একই সংবাদে প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহেব ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৩-এ সংসদ সচিবালয়ে একটি চাহিদাপত্র দিয়ে ওই খুনের তথ্য সম্পর্কিত বক্তব্য প্রত্যাহারের অনুরোধ করেছেন। এই অজুহাতে যে, তার উপস্থাপিত তথ্যে ভুল রয়েছে। ৪ মার্চ ২০১৩ সংসদ সচিবালয় পাল্টা চিঠি দিয়ে জানিয়ে দেয়, সংসদে একবার কোনো তথ্য উপস্থাপিত হলে তা প্রত্যাহারের কোনো সুযোগ নেই। সংসদ সচিবালয়ের কয়েকজন দায়িত্বশীল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এহেন চিঠিকে 'অসংসদীয় চর্চা' বলে উল্লেখ করেছেন। বিদ্বান, দুঃসাহসী, কর্মে অভিজ্ঞ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর জ্ঞান-গরিমা সম্পর্কে আমার কোনো সন্দেহ নেই। তবে 'অন্যায় করে লজ্জিত না হওয়া আর এক অন্যায়'। সক্রেটিসের এ কথাটি বোধ হয় তিনি ভুলে গেছেন। আর তা ছাড়া বহু শতাব্দী আগের এক মনীষীর কথা হয়তো তাদের কাছে এখন প্রযোজ্য নয়, কারণ এখন বাংলাদেশে সরকার তো ডিজিটাল, সেখানে এনালগ অমিয় বাণীর যৌক্তিকতা কোথায়। সরকারের গুণান্বিত কর্মতৎপর ম. খা. আলমগীর সাহেবদের মতো লোকদের বেলায় অতীত তো ধূসর, বর্তমান হচ্ছে রৌদ্রকরোজ্জ্বল। অতীতে পাকিস্তান সরকারের একান্ত অনুগত হয়ে জেলার সরকারি বড় দায়িত্ব পালনে রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস বাহিনী সংগঠিত হতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে অখণ্ড পাকিস্তান রক্ষায় কত তৎপর ছিলেন। হানাদার বাহিনীর নির্মম গণহত্যার সহায়ক ভূমিকা পালন করেছেন বিংশ শতাব্দীতে। আবার রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের খালকাটা কর্মসূচিতে বিপুল উদ্দীপনায় ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন কোদাল-ঝুড়ি নিয়ে। পিএইচডি ডিগ্রিটিও অর্জন করলেন জিয়াউর রহমানের খালকাটা কর্মসূচির নানাবিধ সুফল বর্ণনার থিসিস দিয়ে। আর একবিংশ শতাব্দীতে পরিপূর্ণ ডিজিটাল হলেন_ চালাও গুলি, উড়াও খুলি, দমন করা হবে কঠোর হস্তে বলে আড়াই মাসে ২৬০-এর অধিক মানুষ খুনের কৃতিত্ব দেখিয়ে। ১৯৮৮ সালে এরশাদ আমলে বরিশাল জেলা কারাগারে বসে জেলা প্রশাসককে চিঠি লিখলেন, বরিশালের প্রখ্যাত কমিউনিস্ট নেতা নুরুল ইসলাম যার ভাষ্য ছিল অনেকটা এরকম_ 'জনাব জেলা প্রশাসক, আপনার অনেক ক্ষমতা, আপনার ক্ষমতার মর্মে সন্তুষ্ট হয়ে আমরা আজ কারাগারে। কিন্তু এটা যে একটা আপ্তবাক্য তার প্রমাণ হলো জেলখানার অজস্র মশা। এ প্রাণিকুল আপনার ক্ষমতাকে থোড়াই কেয়ার করে। জীবন অতিষ্ঠ করে ফেলেছে আমাদের। তাই বলছি, অবিলম্বে এই মশককুল দমনের ক্ষমতা প্রমাণ করে আমাদের একটু শান্তি দিন।' ফলও হয়েছিল সেই চিঠির। পরদিনই ডিসি সাহেব পৌরসভার মশকনিধন বাহিনী পাঠিয়ে জেলখানার সেই নির্দিষ্ট ওয়ার্ড প্রায় মশামুক্ত করার পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। যে কারণে সক্রেটিসকে শ্রদ্ধায় স্মরণ করা_ 'অন্যায় করে লজ্জিত না হওয়া আর এক অন্যায়'। যদিও ডিজিটাল ডিকশনারি খুঁজে দেওয়ার সময় এসেছে যে, অন্যায় করে গর্বিত হওয়া, কোন সংজ্ঞায় পড়বে? পুণ্য না পাপ? বর্বরতা, নিষ্ঠুরতা, না বিবেকের গলাটিপে নগদ প্রাপ্তিতে উল্লসিত হওয়া? যা এখন প্রতিনিয়ত চলছে। লেজেগোবরে করে ফেলা_ প্রবাদটির মানে যদি হয় দিশাহীন হওয়া, তাহলে বর্তমান গোঁয়ার সরকারকে কি বলা যাবে? দিশাহীন নাকি বিদিশাহীন? বিরোধী রাজনীতিকদের অবরুদ্ধ করে, আটক করে, এরা বলে দুষ্কৃতকারী। সরকারের অপশাসন যন্ত্রণায় প্রতিবাদী মিছিলে বেশুমার গুলি, সাউন্ড গ্রেনেড, টিয়ার গ্যাস মেরে, পিটিয়ে গ্রেফতার করে বলে, এরা দুর্বৃত্ত। বলে সব অঘটনের হুকুমের আসামি হবে বিরোধীদলীয় নেতা। বিএনপি-জামায়াতের নেতা-কর্মীর নামে হাজার হাজার মামলা, আসামি আনুমানিক তিন লক্ষাধিক। ক্ষমতাসীন দলের মতে, বিশ্বাসী হলে রাজাকারকে মুহূর্তেই বানায় সঙ্গী, আবার অন্যমতের পথযাত্রী হলে তৎক্ষণাৎ বলে জঙ্গি। সকালে যদি হয় গলাগলি, বিকালে করে গালাগালি আর পরদিন করে গোলাগুলি। হক্বানি উলামা-মাশায়েখরা তাদের মতে চললে বলে এরা ধর্মভীরু, ইসলামপ্রিয়। অমতে গেলে বলে মৌলবাদী, ধর্মান্ধ। মতের সঙ্গে মিললে ধর্ম অবমাননাকারী ব্লগারদের বলে দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের শহীদ, আবার মতের অমিল হলে বলে ধর, এরা সাইবার ক্রিমিনাল। এরা চোরকে বলে দেশপ্রেমিক আর দেশপ্রেমিককে বলে রক্তচোষা-সুদখোর। এরা জাতীয় স্বার্থে শান্তির পক্ষে কাজ করার আগ্রহী সম্মানিত ব্যক্তিকে বলে_ 'মুই কার খালু রে'। তাই সব দেখেশুনে মনে হয়, লেজেগোবরে শুধু নয়, বর্তমান সরকার লেজ থেকে মাথা পর্যন্ত গোবর মেখে বসে রয়েছে। যদি এই গোবর সারে তর তর করে আবার ক্ষমতার চারাগাছ জন্মায়, বেড়ে ওঠে লতা-পাতা, তরু-গুল্ম সেই আশায়, কি আশায় বাঁধে খেলাঘর, ক্ষমতার বালুচরে। কথা শুরু করেছিলাম কারাগারে বিদ্যুৎ চলে গেলে হারিকেন জ্বালানো প্রসঙ্গে। এক দিন হঠাৎ জোর ঘূর্ণিবাতাস শুরু হওয়ায় অন্ধকার নেমে এলো। আচমকা ঘুম ভাঙা অাঁধার রাতে হাতের কাছে না কিছু খুঁজে পাচ্ছি, না সাহায্যের জন্য ডেকে কোনো সাড়া পাচ্ছি। প্রবল বাতাসে কারারক্ষীকে ডাকার কণ্ঠস্বর বাতাসে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। মশারি নামক বিছানার খাঁচা সরিয়ে বের হলাম, কিন্তু কোথায় চার্জার লাইট, কোথায় রেডিও লাইট কিংবা লাইটার কিছুই হাতের কাছে পেলাম না। অন্ধকার হাতড়াতে হাতড়াতে এক সময় পড়ার টেবিলের ওপর লাইটারটা পেলাম। বার বার জ্বালিয়ে রাখতে হচ্ছে বাতাসের ধাক্কা সামলানোর জন্য। খুব সতর্কে পা ফেলে জানালার কাছে গিয়ে শিকের ফাঁক দিয়ে হাত বের করে স্মৃতির নির্ধারিত স্থানে হারিকেন খোঁজা শুরু করলাম। হাতটা কখনো প্রসারিত কখনো সঙ্কুচিত করে ঘুরিয়ে বার কয়েক এদিকে-ওদিকে করতে হারিকেনের অস্তিত্ব পেলাম। এখন ওটাকে ভেতরে এনে জ্বালাতে পারলে হলো। শিকের ফাঁক দিয়ে আনতে হবে। কারা কক্ষের মূল দরজা বাইরে থেকে প্রতি রাতে তালাবদ্ধ থাকে। বেশ কিছু শারীরিক এবং হাতের কসরত করে ওটাকে যখন প্রায় কক্ষের ভেতরে নিয়ে এসেছি_ তখনই জানালার দুই পাশের শিকের চাপে কিংবা অন্য কোনো ধাক্কায় চিমনিটা চুরচুর হয়ে ভেঙে গেল। ভাগ্য ভালো চিমনির কাচে আমার হাত বা শরীরের কোনো অংশ কাটেনি। এখন শুধু আমি-হারিকেন-সলতে-লাইটার আর জ্বালানোর পর আলো বাড়ানো-কমানো চাবিটা ওটার নিম্নাংশে বিদ্যমান। যা হোক লাইটার দিয়ে চিমনিবিহীন হারিকেনের সলতে জ্বালালাম দেয়াল আড়াল করে। যাতে বাতাসে নিভে না যায়। তখনই দেখলাম হারিকেনের আভিজাত্য এবং নিরাপত্তার ব্যারিকেড হিসেবে থাকা চিমনি ভেঙে, ওটা এখন ন্যাংটা হয়ে গেছে। হারিকেন এখন রূপ নিয়েছে কুপি বাতিতে। ঘুমভাঙা বিষণ্ন শরীরে মনটাও বিষণ্ন হয়ে গেল। কেন যেন মনে হলো, বাংলাদেশের বর্তমান গণতন্ত্র আর হারিকেনের চিমনি ভাঙা কুপি বাতি কি একাকার হয়ে গেল। লেখক : রাজনীতিক (জেলজীবন নিয়ে সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলালের লেখাটি বাংলাদেশ প্রতিদিনে পাঠানোর পর দিনই তিনি গ্রেফতার হন।@বি.স.)

সর্বশেষ খবর