রবিবার, ২৩ জুন, ২০১৩ ০০:০০ টা
খোলা কলাম

ঐতিহ্যের অপর নাম আওয়ামী লীগ

আমির হোসেন আমু

ঐতিহ্যের অপর নাম আওয়ামী লীগ

জনগণের সংগ্রামই ইতিহাস নির্মাণ করে। সেই ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাহন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। জনগণের চিন্তা, চেতনা, আকাঙ্ক্ষা এবং স্বপ্ন দিয়ে তৈরি যে রাজনৈতিক দল তার ভাষা আপামর জনসাধারণেরই কণ্ঠের ভাষা। আমরা ভাগ্যবান, আমরা তেমনই একটি রাজনৈতিক সংগঠনের উত্তরাধিকার এবং আলোকিত তেমনই জননেতার আলোকবর্তিকায়। আমাদের দল আওয়ামী লীগ, আমাদের নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং আমাদের বাঙালি জাতীয়তাবোধ সব একাকার এ মাটির ঐতিহ্যে, সংস্কৃতিতে, কৃষ্টিতে এবং স্বাধীনতায়।

প্রতিষ্ঠাকাল থেকে আওয়ামী লীগ একটি সংগ্রামী রাজনৈতিক গণসংগঠন। আর তাই এই দলটি জন্মলগ্ন থেকেই জনগণনির্ভর জাতীয়তাবাদী, দেশপ্রেমিক, নির্ভীক, ত্যাগী, উদার অসাম্প্রদায়িক সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে ধাবমান। সাতচলি্লশের দেশবিভাগের আগের অনেক বিষয়ই গুরুত্বপূর্ণ এবং উল্লেখ্য, কিন্তু আমি আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠনের কথাই তুলে ধরার চেষ্টা করব। চেষ্টা করব এ কারণে যে, এ দেশের মানুষের জন্য রাজনৈতিক প্রজ্ঞা নিয়ে প্রথমে এই একটি রাজনৈতিক দল গঠিত হয়, যা বাংলার মূল শেকড়কে আশ্রয় করেই ক্রমে মহীরুহ আকার ধারণ করেছে।

১৯০৬ সালে ডিসেম্বরে নবাব স্যার সলিমুল্লাহর বিশেষ উদ্যোগে এবং বঙ্গভঙ্গের প্রভাবে ঢাকায় মুসলিম শিক্ষা সম্মেলনের সময় রাজনৈতিক সংগঠন মুসলিম লীগের জন্ম। পরবর্তী সময়ে সমগ্র মুসলমান জনগণের স্বার্থ ও কল্যাণের জন্য বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচি নেওয়া হয়। ১৯৩৭ সালের নির্বাচনের আগে কলকাতায় মুসলিম লীগের শাখা গঠন করা হয়। ভালো-মন্দ বৈশিষ্ট্যের মধ্যে সাম্প্রদায়িক চিন্তা কাজ করেছে। দলের মূল ছিল আহসান মঞ্জিল, যেখানে সাধারণ মানুষের প্রবেশ সংরক্ষিত ছিল।

এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, মুসলিম লীগের মধ্যে মধ্যবিত্তের আত্দবিকাশে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল পূর্ববঙ্গ। বিশেষ করে ঢাকা। ওই সময়ই শেখ মুজিবুর রহমান মুসলিম লীগের বিশাল কর্মী বাহিনীর মধ্যে অনন্য সাধারণ হয়ে উঠেছিলেন। জনপদের সাধারণের মধ্যে অনায়াসে বিচরণ, বাস্তব অভিজ্ঞান, স্মরণশক্তি ও তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের গুণ ছিল তার। অর্থাৎ ঊনপঞ্চাশে যে আওয়ামী লীগ গড়ে উঠেছিল, সেই সংগঠনের হাল তৈরি হচ্ছিল আগে থেকেই। দলের মধ্যে গণতান্ত্রিক রীতির প্রাধান্য, নেতৃত্বের মূল্যবোধ ও তার বিকাশ, সময়োচিত কর্মসূচি প্রণয়ন, জনগণের চিন্তা ও আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন_ এসব কিছুই মুজিব ধাতস্থ করেছিলেন রাজনীতির শুরু থেকেই। ১৯৪৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারিতে পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বাংলা ভাষাকে গণপরিষদের ভাষা এবং অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি জানান। ১৯৪৮ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি এসএস হলের শামসুল আলমকে আহ্বায়ক করে রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ গঠন করা হয়। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে কর্মপরিষদ ১১ মার্চ হরতাল আহ্বান করে। অন্যদিকে ১০ মার্চ সরকার ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে। ১১ মার্চ ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে সচিবালয়ের সামনে বিক্ষোভের সময় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ হয় এবং এখানেই বঙ্গবনু্লসহ ৬৯ জন গ্রেফতার হন। পশ্চিম পাকিস্তানিদের আস্থাভাজন পূর্ব-বাংলার মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীনের একান্ত ঘনিষ্ঠ মাওলানা আকরম খান ছিলেন প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি। তাদের রক্ষণশীলতার হাত থেকে নেতৃত্ব উদারপন্থিদের হাতে নেওয়ার জন্য দ্বন্দ্ব চলতে থাকে। এটা চরম পর্যায় পেঁৗছে সদস্য সংগ্রহ বই দিতে মাওলানা আকরম খাঁর অসম্মতির মধ্য দিয়ে।

এমন সময় হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ঢাকা হাইকোর্টে দবিরুল ইসলামের হেবিয়াস কার্পাস মামলাটি পরিচালনা করার জন্য ঢাকা আসেন। তখন বিরোধী বিক্ষুব্ধদের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা করেন। ইতোমধ্যে তিনি মুসলিম লীগের বিপরীতে পশ্চিম পাকিস্তানে গণতন্ত্রের পক্ষে নতুন দল গঠন করার প্রক্রিয়া শুরু করেছিলেন। তিনি ঢাকার নেতা-কর্মীদের পরামর্শ দিয়েছিলেন, মুসলিম লীগের সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করে নতুন রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তুলতে, যাতে করে পাকিস্তানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা য়ায় এবং একমাত্র গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হলেই জনগণ ও রাষ্ট্রের উন্নয়ন সম্ভব। আওয়ামী মুসলিম লীগ নামটিও তার দেওয়া। ১৯৪৯ সালে ঢাকাসহ বাংলাদেশে চলছিল ম্যালেরিয়ার প্রকোপ, খাদ্যাভাব প্রকট হয়ে উঠেছে। এপ্রিলের শুরু থেকেই ঢাকা শহরে পানির অভাব, নিত্যব্যবহার্য দ্রব্যের দাম দফায় দফায় বেড়ে যাচ্ছিল, উর্দু রাষ্ট্রভাষার ব্যাপারেও জনরোষ।

এ পরিস্থিতিতে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন সকাল ১০টায় কেএম দাস লেনের বশির সাহেবের রোজ গার্ডেনের বাসভবনে মুসলিম লীগ কর্মী, নেতা এবং অন্যান্য রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সম্মেলন শুরু হয়। এ সম্মেলনে গঠিত হয় আওয়ামী মুসলিম লীগ। এ দলের সভাপতি হন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, সহ-সভাপতির পদে মনোনীত হলেন আতাউর রহমান খান অ্যাডভোকেট, সাখাওয়াত হোসেন, আলী আহমেদ এমএলএ, আলী আমজাদ খান অ্যাডভোকেট, আবদুল সালাম খান অ্যাডভোকেট, সাধারণ সম্পাদক টাঙ্গাইলের শামসুল হক, যুগ্ম সম্পাদক একজনই ছিলেন তিনি শেখ মুজিবুর রহমান।

আওয়ামী মুসলিম লীগের আত্দপ্রকাশের দিন ১৯৪৯ সালের ২৩ ও ২৪ জুন উপলক্ষে দলের সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রথম মেনিফেস্টো পেশ করেন। এটির নাম ছিল 'মূলদাবি'। এতে যে সব দাবি উত্থাপন করা হয় সেগুলোর মধ্যে রয়েছে : ১. ব্যক্তিস্বাধীনতা ২. ধর্মের স্বাধীনতা ৩. সংখ্যালঘুদের ন্যায্য অধিকার ৪. আইনের চোখে সমতা ৫. মানুষের সমান অধিকার ৬. কাজ করার অধিকার ৭. শিক্ষার অধিকার ৮. স্বাস্থ্যের অধিকার ৯. নারীর অধিকার ১০. দেশ রক্ষার অধিকার ১১. বয়স্কদের ভোটাধিকার ১২. বৈদেশিক নীতি, ইসলামী রাষ্ট্র ও কৃষ্টি পুনর্গঠন ১৩. শিল্প বিপ্লব ইত্যাদি।

১৯৪৯ সালের ২৪ জুন আরমানিটোলা ময়দানে আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রথম জনসভা হয়। আরমানিটোলা মাঠে সেদিন বক্তৃতা দিয়েছিলেন মওলানা ভাসানী, আতাউর রহমান খান, খয়রাত হোসেন, আবদুল জব্বার খদ্দার ও শামসুল হক। পূর্ববঙ্গের অভাব-অভিযোগসহ মুসলিম লীগের নেতা, মন্ত্রীদের অনাচার, অদক্ষতা ও দুর্নীতির কথা বলা হয়। বৈষম্যের কথাও বলা হয়েছিল। পবিত্র ইসলাম ধর্মকে অপব্যবহার করা হচ্ছে বলেও বক্তারা মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনেন।

বঙ্গবন্ধু মুক্তি পেয়েছিলেন ১৯৪৯ সালের ১৭ জুলাই। বঙ্গবন্ধু জেল থেকে বেরিয়ে এসে লক্ষ্য করলেন আওয়ামী মুসলিম লীগের দাফতরিক কাজ কিছুই হয়নি। আওয়ামী লীগের দফতরটি ছিল ৯৪ নবাবপুর রোডের দালানে। বঙ্গবন্ধু চেয়ার টেবিল ফাইলপত্তর নিয়ে বসে গেলেন। জেলায় জেলায় প্রথম যে কমিটিগুলো তিনি করেছিলেন বস্তুত সেই কমিটিগুলোই আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রথম সাংগঠনিক স্তম্ভ। প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের পূর্ববঙ্গ সফরের আগে ২৩ অক্টোবর আওয়ামী মুসলিম লীগের উদ্যোগে ডাকা হয় জনসভা। মূল বিষয় ছিল খাদ্য সংকট। লিয়াকত আলী খান যখন গভর্নর হাউসে তখন মওলানা ভাসানী ও শেখ মুজিবের নেতৃত্বে ভুখা মিছিল বের হয়। মিছিল নবাবপুর হয়ে গভর্নর হাউসের কাছাকাছি এলে পুলিশের লাঠিচার্জ এবং ঢালাও গ্রেফতার শুরু হয়। মওলানা ভাসানী, শামসুল হক, বঙ্গবন্ধুসহ আরও বেশ কয়েকজন গ্রেফতার হন। ১৯৫১ সালের ২ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিব বাদে সবাইকে মুক্তি দেওয়া হয়।

১৯৫৩ সালের ১৪ নভেম্বর ঢাকার মুকুল সিনেমা হলে আওয়ামী মুসলিম লীগের কাউন্সিল অধিবেশন বসে। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে এসেছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, গোলাম মোহাম্মাদ লুন্ধখর, মিয়া ইফতিকার উদ্দিন এবং আরও অনেকে। অধিবেশনের অভ্যর্থনা কমিটির সভাপতি ছিলেন আবুল মুনসুর আহমদ। বিভিন্ন জেলা থেকে উপস্থিত হয়েছিলেন ৩০০ কাউন্সিলর। এ অধিবেশনে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী সভাপতি, আতাউর রহমান খান অ্যাডভোকেট, আবুল মুনসুর আহমদ, আবদুস সালাম খান, খয়রাত হোসেন সহ-সভাপতি, শেখ মুজিবুর রহমান সাধারণ সম্পাদক, কোরবান আলী সাংগঠনিক সম্পাদক, আবদুর রহমান প্রচার সম্পাদক, মোহাম্মাদ উল্লাহ দফতর সম্পাদক ও ইয়ার মোহাম্মাদ খান কোষাধ্যক্ষ নির্বাচিত হন। ১৯৫৩ সালের ১৮ নভেম্বর আওয়ামী মুসলিম লীগের উদ্যোগে ঢাকা বার লাইব্রেরিতে সর্বদলীয় বৈঠক বসে গণবিরোধী মূলনীতি কমিটি খসড়া প্রতিরোধের বিষয়ে। এ বৈঠকে নির্বাচনী মোর্চা গঠনের বিষয়টি আলোচনা হয়। যুক্তফ্রন্টে যে দলগুলো অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল সেগুলো হলো আওয়ামী মুসলিম লীগ, কৃষক শ্রমিক পার্টি (১৯৫৩ সালের অক্টোবরে গঠিত), গণতন্ত্রী পার্টি, নেজামে ইসলাম পার্টি, খিলাফতে রাব্বানী পার্টি ও কমিউনিস্ট পার্টি। ১৯৫৩ সালের ১১ ডিসেম্বর ময়মনসিংহে আওয়ামী মুসলিম লীগের বিশেষ কাউন্সিল অধিবেশনে আওয়ামী মুসলিম লীগ ২১ দফা অনুমোদন করে। ২১ দফাই যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী ইশতেহারে পরিণত হয়। ১৯৫৫ সালের ২১ সেপ্টেম্বর সদরঘাটের রূপমহল সিনেমা হলে অধিবেশন বসল। আওয়ামী লীগ শুরু থেকেই এ দেশে অবাধ ও নিরপেক্ষ সাধারণ নির্বাচনের দাবি করে আসছিল। যাকে আমরা যুক্ত নির্বাচন বলে আখ্যায়িত করে থাকি। অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে সবার জন্য দরজা খুলে দেওয়ার চিন্তা ছিল আরও আগে থেকেই। নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী রূপমহলের অধিবেশনে এ প্রস্তাবটি আনেন। কেউই এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করেননি। কাউন্সিলর উপস্থিত ছিলেন প্রায় ৭০০। সবাই হর্ষধ্বনির মাধ্যমে প্রস্তাবটি সমর্থন করেন।

১৯৫৬ সালের ২৩ মার্চ রাতে পাকিস্তান কেন্দ্রীয় পরিষদে সংবিধান গৃহীত হয়। পরিষদে সেদিন শেখ মুজিব বলেছিলেন, পূর্ববঙ্গের নাম পূর্ব পাকিস্তান রাখার অধিকার এ পরিষদের নেই এবং সংবিধানে তা বৈধ নয়, একটি দেশের নাম বদল করতে হলে সে দেশের জনগণের রায়ের প্রয়োজন। পূর্ববঙ্গ হাজার হাজার বছরের ঐতিহ্যমণ্ডিত একটি জনপদ। এ নামের সঙ্গে জনগণের জাতীয় পরিচয় অবিচ্ছেদ্য।

১৯৫৬ সালের ৪ মার্চ জেনারেল ইস্কান্দার মীর্জা পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হন। দেশে দেখা দেয় দুর্ভিক্ষ। দুর্ভিক্ষ মোকাবিলার দাবিতে মওলানা ভাসানী ১৯৫৬ সালের ২ মে থেকে অনশন শুরু করেন। ১৬ মে পরিস্থিতি যখন চরম পর্যায়ে শেখ মুজিব আরমানিটোলা ময়দানের জনসভায় গণআন্দোলনের কর্মসূচি দেবেন বলে ঘোষণা করেন। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এসে মওলানা ভাসানীর অনশন ভাঙালেন। ১৯৫৬ সালের ১৯ ও ২০ মে মুকুল সিনেমা হলে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন সম্পন্ন হয়। ১৯৫৬ সালের ২৬ মে প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মীর্জা পূর্ব পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট শাসন জারি করেন। কিন্তু ১৯৫৬ সালের ১ জুন আবার তা তুলে নেওয়া হয়।

১৯৫৬ সালের ২৩ জুলাই পল্টন ময়দানে বঙ্গবন্ধু পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দাবি করলেন। অবিলম্বে ব্যবস্থাপক পরিষদের অধিবেশন ডাকা না হলে ঢাকা শহর অচল করে দেওয়া হবে বলে তিনি চূড়ান্ত ঘোষণা দিলেন।

১৯৬৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি লাহোরে পাকিস্তানের সব বিরোধী দলের সভা বসে। বৈঠকে বঙ্গবন্ধু ছয় দফা দাবি পেশ করেন। বৈঠকে যোগদানকারী অন্য দলগুলো কোনো অঞ্চলের স্বায়ত্তশাসন নিয়ে কথা না তোলার আহ্বান জানায়। আওয়ামী লীগ বৈঠক বর্জন করে। ১৯৬৬ সালের ৭ মার্চ পাকিস্তানের সব পত্রপত্রিকায় ছয় দফার খবর ছাপা হয়। ১৯৬৬ সালের ১১ মার্চ বঙ্গবন্ধু ঢাকা বিমানবন্দরে সাংবাদিক সম্মেলনে ছয় দফার ব্যাখ্যা প্রদান করেন। তিনি এটাকে বাঙালির বাঁচার দাবি বলে আখ্যায়িত করেন। কিন্তু অবাক ব্যাপার ছিল এটাই, তরুণ সমাজ তার প্রত্যাবর্তনের আগেই বরিশাল, ঢাকা, কুমিল্লা, নোয়াখালী, সিলেট, চট্টগ্রামসহ সর্বত্র পোস্টার এবং দেয়াল লিখনে ছেয়ে ফেলেছে ছয় দফার কথা। ১৯৬৬ সালের ১২ মার্চ রমনাগ্রিনে বেসিক ডেমোক্রেসির জমায়েতে আইয়ুব খান স্পষ্টই বললেন, আওয়ামী লীগের ছয় দফা স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের জন্য মারাত্দক। আইয়ুব এবং মোনেম দুজনেই দুষ্কৃতকারীদের কঠোর হস্তে দমন করবেন বলে চরম হুঁশিয়ারি জানালেন। ১৯৬৬ সালের ১৩ মার্চ আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটিতে ছয় দফা অনুমোদন করা হয়।

১৯৬৬ সালের ১৮ মার্চ মতিঝিলের হোটেল ইডেনে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন শুরু হয়। ওই কাউন্সিলে ছয় দফা বিপুল সমর্থনে অনুমোদিত হয়। সর্বসম্মতিক্রমে সভাপতি নির্বাচিত হন শেখ মুজিবুর রহমান, সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ। ছয় দফাই পূর্ব পাকিস্তানের একমাত্র রাজনৈতিক বিষয় হয়ে ওঠে। ছয় দফার প্রথম জনসভাটি হয়েছিল ১৯৬৬ সালের ২০ মার্চ। পূর্ব পাকিস্তানে ছয় দফার আন্দোলনই একমাত্র আন্দোলনে পরিগণিত হয়। বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজ অর্থনৈতিক টানাপড়েনে ছয় দফাকেই মুক্তির সনদ হিসেবে বিবেচনা করে।

১৯৬৮ সালের জানুয়ারিতে সরকারি প্রেসনোটে উল্লেখ করা হলো, পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন করার যে ষড়যন্ত্র হয়েছিল সরকার তার বিরুদ্ধে বিশেষ ব্যবস্থা নিয়েছে। এ পর্যন্ত বিভিন্ন বিভাগের ১৯ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। অভিযুক্তের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। ইতিহাসে এটাই আগরতলা মামলা নামে পরিচিত, যদিও মামলার শিরোনাম ছিল শেখ মুজিবুর রহমান গং বনাম পাকিস্তান। ১৯৬৮ সালের ১৭ জানুয়ারি ঢাকা জেলে বন্দী শেখ মুজিবুর রহমানকে জানানো হয়েছিল যে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। এটা ছিল গভীর রাতের ঘটনা। জেল গেটেই শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে ক্যান্টনমেন্ট নিয়ে যাওয়া হলো।

১৯৬৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি সেনাবাহিনী আগরতলা মামলার অন্যতম আসামি সার্জেন্ট ফজলুল হক ও সার্জেন্ট জহিরুল হকের ওপর গুলি চালায়। সার্জেন্ট জহিরুল হক ঘটনাস্থলেই নিহত হন। কেউ কেউ এটা আইয়ুব খানবিরোধী সামরিক চক্রের ষড়যন্ত্র বলেও খবরটি ঢাকায় ছড়িয়ে পড়লে প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ঘটে। বাধ্য হয়ে আইয়ুব খান শেখ মুজিবুর রহমানসহ সব বন্দীকে মুক্তি দিতে বাধ্য হন। ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে শেখ মুজিবকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ডাকসু ভিপি তোফায়েল আহমেদ লাখো জনতার অনুমোদনক্রমে তাকে বঙ্গবন্ধু অভিধায় ভূষিত করেন। বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন ছয় দফা বাঙালির মুক্তির সনদ। ছয় দফার ব্যাপারে কোনো আপস নেই।

লেখক : রাজনীতিক

 

 

সর্বশেষ খবর