শনিবার, ১৩ জুলাই, ২০১৩ ০০:০০ টা
খোলা কলাম

সরকারকে সমাধানের পথে আসতে হবে

ড. কর্নেল অলি আহমদ (অব.) বীরবিক্রম, এমপি

সরকারকে সমাধানের পথে আসতে হবে

বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী সুদের হার বাড়িয়ে দিচ্ছে, এটা খুবই উদ্বেগের বিষয়। অধিকাংশ ব্যাংক শিল্পোদ্যোক্তাদের কাছ থেকে ১৭ থেকে ২২ শতাংশ হারে সুদ নিচ্ছে। তবে কার্যত এ হার আরও বেশি। কারণ কোনো কোনো ব্যাংক ঋণ প্রক্রিয়াকরণ ফি'র নামে আদায় করছে বাড়তি সার্ভিস চার্জ। এ ছাড়া মেয়াদপূর্তির আগে ঋণ সমন্বয় করার ক্ষেত্রে কোনো কোনো ব্যাংক এ বাবদ আরও চার শতাংশ চার্জ আদায় করছে। সব মিলিয়ে উদ্যোক্তাদের ২৩ থেকে ২৬ শতাংশ হারে সুদ গুনতে হচ্ছে। সুদের এ উচ্চহারের নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর। কারণ এর ফলে শিল্প-প্রতিষ্ঠানের ব্যয় বেড়ে গেছে। বেড়েছে উৎপাদন খরচ। ফলে দাম বেড়েছে পণ্যসামগ্রীর। ঋণের সুদের হার বৃদ্ধির প্রভাব শেষ পর্যন্ত জনগণের ওপর গিয়েই পড়ছে। সুদের হার বৃদ্ধির ফলে বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত হচ্ছে। এতে দেশের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সম্ভব হচ্ছে না কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি অর্জন। সুদের হার বৃদ্ধির কারণে অনেক ব্যবসায়ী সময়মতো ঋণ পরিশোধ করতে পারছেন না। এতে বেড়ে যাচ্ছে খেলাপি ঋণের পরিমাণ। প্রকৃতপক্ষে শিল্পোদ্যোক্তাদের ঋণ নিয়ে ব্যবসা করাই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। বস্তুত সামগ্রিক অর্থনীতিতেই পড়ছে এর নেতিবাচক প্রভাব।

বর্তমান সরকার আমলে ব্যাংকিং ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি ও ঋণ জালিয়াতির ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে চলছে। শেয়ার মার্কেট জালিয়াতি, হলমার্ক, ডেসটিনি, যুবক, ইউনিপে-২ এর কেলেঙ্কারির রেশ শেষ হতে না হতেই বিসমিল্লাহ গ্রুপ নামে বেনামি আরেক কোম্পানির হাজার কোটি টাকার ঋণ জালিয়াতির ঘটনা ফাঁস হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের দুর্বল মনিটরিং আর যথাযথ সুপারভিশনের অভাবে ব্যাংকিং খাতে দুর্নীতি এবং ঋণ জালিয়াতির ঘটনা ঘটছে। এসবের সঙ্গে সরকারের অনেক প্রভাবশালীর জড়িত থাকার সংবাদও পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।

রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন অগ্রণী ব্যাংকের ঋণখেলাপি শীর্ষ ২০ গ্রাহকের কাছে আটকে গেছে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা। এর মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকা।

আন্তর্জাতিক ক্রেডিট কার্ড জালিয়াত চক্রও বাংলাদেশের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট হোল্ডারদের অ্যাকাউন্ট থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। একদিকে ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ বেড়ে যাচ্ছে অন্যদিকে খেলাপির বিপরীতে প্রভিশন রাখতে গিয়ে মূলধন সংকটও দেখা দিয়েছে। ফলে ঋণ জালিয়াতি ও দুর্নীতির ঘটনা সামগ্রিক ব্যাংকিং খাতকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে।

সাম্প্রতিককালে ব্যাংকিং খাতে যে কেলেঙ্কারি ঘটেছে তার দায় সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক এড়াতে পারে না। মূলত সুপারভিশন ও যথাযথ মনিটরিংয়ের দুর্বলতার কারণেই এ ধরনের জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচিত হবে মনিটরিং ব্যবস্থা আরও জোরদার করা। কারণ ব্যাংকিং খাতে যদি বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়, তবে দেশের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হবে।

পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের বিশেষজ্ঞ দলের চূড়ান্ত প্রতিবেদন ইতোমধ্যে অর্থমন্ত্রীর কাছে জমা দেওয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতি বা দুর্নীতির ষড়যন্ত্রে যারা লিপ্ত ছিল, দুদকের তদন্তে তাদের অনেকেরই নাম বাদ পড়েছে। সুতরাং দুদকের তদন্ত প্রতিবেদন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়নি। সরকারের এই প্রতিবেদন তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। ফলে সমগ্র পৃথিবীতে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে। এ ব্যাপারে সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। সাবমেরিন কেবল কোম্পানি লি. জুড়ে চলছে এক রকম বেপরোয়া ডিজিটাল দুর্নীতি। এ সংস্থা লুটপাটের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। অভিযোগ আছে, সংস্থার একজন শীর্ষ কর্মকর্তার নেতৃত্বে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট গত কয়েক বছরে প্রায় এক হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে অডিট আপত্তি আছে ১৪৩ কোটি টাকা, ২০১১-১২ অর্থবছরে ৮৫ কোটি টাকা, আর্নিং পার শেয়ার অর্থাৎ ই.পি.এস জালিয়াতি করে লোপাট হয়েছে ৬৩০ কোটি টাকা। এ ছাড়াও বিভিন্ন প্রকল্পের নামে লুটপাট করা হয়েছে আরও ৩০০ কোটি টাকার বেশি। এ ব্যাপারে বিগত ২৫ মে যুগান্তর পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় বিস্তারিত তথ্য পরিবেশন করা হয়েছে।

রাষ্টায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের শত শত কোটি টাকার সম্পত্তি লিজ দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে প্রাইভেটাইজেশন কমিশন ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের মধ্যে ঠাণ্ডা লড়াই চলছে। বিদেশে অর্থ পাচার অহরহ ঘটছে। এ ছাড়াও অনেক মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতির ব্যাপারে প্রতিনিয়ত পত্রপত্রিকায় খবর প্রকাশিত হচ্ছে। এ ব্যাপারে সরকার নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে।

দুর্নীতি প্রতিরোধে গঠিত দুর্নীতি দমন কমিশন নিয়ে বাংলাদেশের মানুষের অনেক আশা ছিল। দেশের সর্বগ্রাসী দুর্নীতিতে অতিষ্ঠ মানুষ মনে করেছিল, নির্মূল না হোক, অন্তত কমে আসবে দুর্নীতি। দলীয়করণ এবং সরকারের হস্তক্ষেপের কারণে স্বাধীনভাবে দুদকের কর্মকাণ্ড পরিচালিত হচ্ছে না। দুদকের বিদায়ী চেয়ারম্যান নিজেই একাধিকবার স্বীকার করেছেন, দুদক একটি দন্তহীন বাঘ। তাহলে তিনি কেন এই পদ থেকে পদত্যাগ করলেন না? বর্তমান অবস্থার জন্য তিনি নিজেও দায় এড়াতে পারেন না। তা যে হয়নি, সেটা প্রতি বছর ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল জনগণকে অবহিত করছে। দুদককে স্বাধীনভাবে কর্মকাণ্ড পরিচালনা করার জন্য ক্ষমতা প্রদান করা প্রয়োজন।

অন্যথায় দেশের অবস্থা দিন দিন অবনতির দিকে যাবে। প্রশাসনকে দলীয়করণ করা হয়েছে। যেসব কর্মকর্তা সরকারের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে একমত নয়, তাদের বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো এবং ওএসডি করা হচ্ছে। অন্যদিকে নিজেদের পছন্দের কর্মকর্তাদের মাঠপর্যায়ে দায়িত্ব পালন করার জন্য একাধিক ধাপ তৈরি করা হয়েছে। এক কথায় সরকার দেশের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে দলীয়করণ করেছে। এতে কখনো দেশের মঙ্গল হবে না। ক্ষমতা কারও জন্য চিরস্থায়ী নয়। আমাদের সবাইকে দলীয়করণ করা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে পদায়ন করতে হবে। অন্যথায় কখনো সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হবে না। এককেন্দ্রিক সরকার বাংলাদেশে অকার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। আমূল সংস্কার প্রয়োজন। সুতরাং ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ সময়ের দাবি।

প্রবাসীদের প্রেরিত রেমিট্যান্স আমাদের দেশে মূল্যবান হলেও প্রবাসী শ্রমিকরা বরাবরই মূল্যহীন। এরা আমাদের কাছে শুধুই শ্রমিক হিসেবে গণ্য। প্রবাসীরা প্রতিবছর প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকার রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছে। বেকারত্বের অভিশাপ ঘুচিয়ে পরিবারের সুখ-শান্তির আশায় প্রবাসজীবন কাটান লাখ লাখ বাংলাদেশি। তাদের ঘামের বিনিময়ে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রয়েছে। অথচ তাদের কোনো সম্মান নেই আমাদের দেশে। অনেকে নিজের গ্রামের বাড়িতে বসবাস করতে ভয় পায়। অনেকের জায়গা জমি বেদখল হয়ে যাচ্ছে। তাই প্রবাসীদের দুঃখ-কষ্ট দূর করা এবং তাদের চাকরির নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সরকারসহ আমাদের সবার মানবিক দায়িত্ব। মধ্যপ্রাচ্যে প্রায় ৪০ লাখের উপরে প্রবাসী বাংলাদেশি রয়েছে। প্রয়োজনের তুলনায় তাদের কাউন্সিলর ও পাসপোর্ট নবায়নের সুযোগ-সুবিধা সীমিত। যেমন সৌদি আরবে বৈধ-অবৈধ মিলে ২২ লাখ বাংলাদেশি বসবাস করছে। অনেককে পাসপোর্ট নবায়নের জন্য এক হাজার কিলোমিটারের উপরে পথ পাড়ি দিতে হয়। একই অবস্থা সংযুক্ত আরব আমিরাত, ওমান এবং কুয়েতে বিরাজ করছে। তাদের ছেলেমেয়েকে লেখাপড়ার জন্য বাংলাদেশ সরকারের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত স্কুলের সংখ্যা সীমিত। কাতার ও বাহরাইনের স্কুলের অবস্থা অনুরূপ। সুতরাং এ ব্যাপারে আমার সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব থাকবে

১. পাসপোর্ট নবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় জনবল বৃদ্ধি এবং একাধিক স্থানে অফিস স্থাপন করা।

২. বাংলাদেশি ছেলেমেয়েদের জন্য প্রয়োজন অনুযায়ী নতুন স্কুল প্রতিষ্ঠা করা।

৩. মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাস করার পর প্রবাসী বাংলাদেশিদের ছেলেমেয়েদের জন্য দেশের বিভিন্ন কলেজ, মেডিকেল কলেজ, কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ব্যাপারে কোঠা সংরক্ষণ জরুরি। অন্যথায় প্রবাসীদের প্রতি অবিচার করা হবে।

অর্থনীতির পাশাপাশি সরকার দেশের রাজনীতিকে মহাসংকটে ফেলেছে। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রয়াস এ সংকটের জন্য দায়ী।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যতীত সুষ্ঠু, অবাধ এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়। সরকারবিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনও ক্ষমতার অপব্যবহার করে কখনো দমন করা যাবে না। যেমন সম্ভব হয়নি অতীতে। সুতরাং দেশের উন্নয়নের স্বার্থে, শান্তি-শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য এবং গণতন্ত্র সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি যে কোনো নামে হোক না কেন, বহাল করা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। দেরিতে হলেও আশা করি আমাদের সবার শুভবুদ্ধির উদয় হবে। আমাদের মন-মানসিকতার পরিবর্তন ও একগুঁয়েমি মনোভাব পরিহার করতে হবে। সরকারকেই অবশ্যই বিদ্যমান রাজনৈতিক সমস্যার সমাধানের পথে আসতে হবে। অন্যথায় গণতন্ত্র কার্যকর হবে না।

লেখক : সংসদ সদস্য ও চেয়ারম্যান, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি

 

 

সর্বশেষ খবর