সোমবার, ২৯ জুলাই, ২০১৩ ০০:০০ টা
খোলা কলাম

হায় সেলুকাস, কি বিচিত্র এ দেশ

নূরে আলম সিদ্দিকী

হায় সেলুকাস, কি বিচিত্র এ দেশ

শেয়ার বাজারে ২৬ হাজার কোটি টাকা লুণ্ঠন, মর্মান্তিকভাবে ৩১ লাখ জনগোষ্ঠীকে সর্বস্বান্ত করা_ তার যথাযোগ্য প্রতিবাদ তো হয়ইনি বরং ইব্রাহীম খালেদের নেতৃত্বে গঠিত কমিটির রিপোর্টটি পর্যন্ত এ দেশে প্রকাশিত হতে পারেনি। ছিটেফোঁটা যেটুকু প্রতিবাদ হয়েছে সেটা অঙ্কুরে বিনষ্ট হয়েছে। একটা শাস্তিযোগ্য পরিবেশ তৈরি করতে পারেনি। এটা শুধু সরকার বা বিরোধী দলের নির্লিপ্ততার বহিঃপ্রকাশ নয়, জাতির জন্য লজ্জাজনকই বটে! এর উপরে রয়েছে হলমার্ক কেলেঙ্কারি, পদ্মা সেতুর ব্যাপারে বিশ্বজুড়ে বাংলাদেশের নিন্দা, ডেস্টিনি, যুবক আরও কত দুর্নীতির অভূতপূর্ব সব কাহিনী। বাংলাদেশ দুর্নীতির অতলান্তে যেন ক্রমেই তলিয়ে যাচ্ছে। এটি বাস্তব এবং বিশ্বজনমত সে ব্যাপারে নিঃসংশয় চিত্ত। বিশ্বব্যাংক, জাতিসংঘ, পৃথিবীর অপ্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি আমেরিকার অনেক উক্তি-ইঙ্গিত এবং সমালোচনা আমাদের কর্ণকুহরে প্রবেশ করেনি। এ বিষয়ে প্রতিবিধানের ব্যবস্থা তো হয়ইনি বরং আন্তর্জাতিক সংস্থার অস্তিত্ব; সততা এবং প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে চ্যালেঞ্জ ছোড়া হয়েছে। এটা যে বাংলাদেশের অর্থনীতি এবং বহির্বিশ্বে তার ভাবমূর্তি সমুদ্রের কোনো কিনারায় এনে দাঁড় করিয়েছে ভাবলেও যে কোনো বিবেকবানের হৃদয় থর থর করে কেঁপে ওঠে। কিছু সুশীল সমাজের সঙ্গে আমিও এর প্রতিবাদে সরব হয়েছিলাম। বিভিন্ন প্রবন্ধ এবং টকশোতে আমি এর প্রতিবাদ করেছি, অর্থনীতির উপরে এর অশনি সংকেতের ইঙ্গিত করেছি কিন্তু যথা পূর্বং তথা পরং। কোনো পরিবর্তন হয়নি বরং পৃথিবীর অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরাশক্তিসমূহের সঙ্গে আমাদের মতানৈক্যের পরিধি বেড়েই চলেছে। সম্প্রতি আমাদের অনুজপ্রতিম এক সংসদ সদস্য তার পরিমণ্ডলে প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছে। কিন্তু তার ভাষা অপরিশীলিত, অমার্জিত, অশালীন এবং এতই উগ্র যে মানহানির মামলার আওতার মধ্যে পড়ে। উপরন্তু, সাংবাদিকের ওপরে তার দৈহিক আক্রমণ দেশের সাংবাদিক মহলকে এতটাই বিক্ষুব্ধ করে যে তারা সরকারকে একটি আলটিমেটাম দিয়ে বসে। সেই পাকিস্তানের ঊষা লগ্ন থেকেই সাংবাদিকরাই এদেশের রাজনৈতিক চেতনাকে উদ্বেলিত করেছেন, জনগণকে অনুপ্রাণিত করেছেন। স্বাধীনতার লালিত বিশ্বাসকে উদ্ভাসিত করেছেন। সরাসরি রাজনৈতিক দলের সদস্য না হলেও মরহুম মানিক মিয়া, সিরাজুদ্দীন হোসেন, জহুর হোসেন চৌধুরীরা প্রাক-স্বাধীনতা যুগে এ দেশের জনমনে রাজনৈতিক চেতনাকে উদ্ভাসিত করার প্রাণপুরুষ। রাজনীতিকরা তাদের হৃদয়ের উচ্ছ্বলিত চেতনা থেকে শুধু সমৃদ্ধই হতেন না বরং রাজনৈতিক পথপরিক্রমণে দিকনির্দেশনা তৈরি করার দিগন্ত বিস্তৃত পথ খুঁজে পেতেন। আজকে সেই সাংবাদিকের ওপরে দৈহিক আঘাত গণতান্ত্রিক পথপরিক্রমণের যে কোনো মানুষকে ব্যথিত করবে, আমাকেও করেছে। সম্প্রতি এক সংসদ সদস্য এবং শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির অগ্রজকে নিয়ে পত্রিকায় বিভিন্ন মতামত প্রকাশিত হয়েছে; স্বপক্ষে এবং বিপক্ষে। আমি এ সময়টি দেশের বাইরে ছিলাম। আমি কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষে ওকালতি করি না; তবুও একটি মুহূর্তের জন্যও রাজনৈতিক চেতনা বিচ্যুত নই। এমনিতেই দেশটি সংঘাতের মুখোমুখি। প্রশাসন, বিচারব্যবস্থা, সংসদ অকার্যকর, বিরোধী দলের নির্লজ্জ নিরবচ্ছিন্ন সংসদ বর্জন, দুই নেত্রীর আপন আঙ্গিকে যে হিংসার আস্ফালন, কারণে-অকারণে আহূত হরতাল, গ্যাস, বিদ্যুতের অনভিপ্রেত সংকট, অর্থনৈতিক তারল্য সংকট ও বিতরণ ব্যবস্থার একটা অশুভ প্রভাব জাতিকে সম্পূর্ণ বিকলাঙ্গ করেছে। সেখানে সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির বিশ্লেষণে একজন সংসদ সদস্যের প্রতিবাদ বা তার মারমুখী আচরণ সর্বোপরি সাংবাদিকদের ওপর চড়াও হওয়ার বিষয়টি দুঃখজনক ও নিন্দনীয় এবং অমার্জনীয়ও বটে।

এ বিষয়টি নিয়ে আমি লিখব কিনা তা নিয়ে আমার ঘনিষ্ঠজনদের মধ্যেও মারাত্দক মতবিরোধ। যারা আমার হৃদয়ের খুব কাছের মানুষ তাদের পক্ষে-বিপক্ষে উত্থাপিত যুক্তি এর আগে কোনো বিষয়ে লিখতে আমাকে এত দ্বিধাগ্রস্ত করেনি। নিজেই নিজের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বিবেকের সঙ্গে বুঝতে কখনো পিছপা হইনি। বঙ্গবন্ধু আমার আদর্শের প্রাণপুরুষ। তার হৃদয়ের অনুরণনের প্রতিধ্বনি হিসেবে আমার পরিচিতি। চতুর্থ সংশোধনীর বিরোধিতা করার জন্য আজ পর্যন্ত কারও নেতিবাচক মন্তব্য আমাকে শুনতে হয়নি বরং ক্ষমতার মধ্য গগন থেকে নিষ্প্রভ নক্ষত্রের মতো খসে পড়ে গেলেও মানুষের সাধুবাদে আমি উদ্বেলিত হয়েছি। বঙ্গবন্ধুর প্রতি আনুগত্যেরও কোনো সংকট আমার হৃদয়ে তৈরি হয়নি। কিন্তু আজকে পরস্পরমুখী এই বক্তব্যের পরেও আমি উপসংহারে বলতে চাই, বিচিত্র এ দেশ, সেলুকাস! ৩১ লাখ মানুষকে সর্বস্বান্ত করলে তাদের নাম প্রকাশ করার শক্তি সরকারের থাকে না। তার প্রতিবাদ করলে প্রতিবাদীর বিরুদ্ধে যে ফাঁদ পাতা হয় সেটা কি ধরনের ষড়যন্ত্র ছিল তার অনুসন্ধানও হয় না। একতরফাভাবে তাকে দোষী সাব্যস্ত করে গ্রেফতার নিশ্চিত করা হয়। এখানে আর একটি দুঃখবোধের কারণে আমার এ লেখা। গ্রেফতারকৃত সংসদ সদস্যটি আমার সন্তানপ্রতিম। তাকে আমি সরল প্রতিবাদী হিসেবেই জানতাম এবং তাই গ্রেফতারকালীন তার অভিব্যক্তি আমার অনুভূতিকে কেবল আঘাতই করেনি অনেকখানি হতাশও করেছে। তার কাছে প্রত্যাশা করেছিলাম সাংবাদিকের ওপর দৈহিক নির্যাতনের জন্য তিনি ক্ষমা চাইবেন এবং এর সঙ্গে সঙ্গে তার কণ্ঠে প্রতিধ্বনিত হবে এই কথা যে, 'যতদিন বেঁচে থাকব ওই শুভ্রবেশী ব্যক্তির বিরুদ্ধে আমার প্রতিবাদী কণ্ঠ সোচ্চার থাকবে। একযুগ পরেও যদি কারাগার থেকে বেরিয়ে আসি এবং এর মধ্যে যদি এই মহামারী রূপের দুর্নীতির (শেয়ারবাজার, হলমার্ক, ডেস্টিনি, যুবক) বিচার না হয় তবে একটি কণ্ঠে হলেও আমার কণ্ঠে তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ধ্বনি উচ্চারিত হবে। দৈবক্রমে আমার মৃত্যু হলেও এই মৃত্যু হবে আমার জীবনের জয়ধ্বনি।' অথচ তিনি কিনা বললেন এমন দুর্ভাগা স্ত্রী যেন কারও না হয় যে ঈদে তার স্বামীকে সঙ্গে পাবে না, এমন দুর্ভাগা সন্তান যেন কারও না হয় যে তার পিতাকে ঈদে সঙ্গে পাবে না। সত্য কথা বলার চেষ্টা করব অথচ নির্যাতন দেখে থর থর করে কাঁপব! হৃদয়ে পরোক্ষভাবে সাহসকে বিসর্জন দিয়ে ক্ষমতাসীনদের পরোক্ষ অনুকম্পা এবং করুণাধারা প্রত্যাশা করব এটা আত্দবিরোধিতারই নামান্তর। আমি প্রতিনিয়তই প্রত্যাশা করি দেশের এই ঘোর ঘন অমানিশার দিনে সুশীল সমাজ, বুদ্ধিজীবী, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম থেকে একদল প্রত্যয় দৃঢ় প্রতিভা প্রদীপ্ত জীবন এগিয়ে আসবে যাদের সাহস, সাহসী উচ্চারণ, দুর্নীতি বিমুক্ত জীবন এবং প্রত্যয় দৃঢ় পদচারণা জাতিকে সব গ্লানি থেকে বিমুক্ত করবে; নিমজ্জিত অবক্ষয়ের অতলান্ত থেকে আবার তুলে আনবে। ষাট দশকের সেই অমিত তেজ আপসহীন মনোভাব তরুণ প্রজন্মের চিত্তকে উজ্জীবিত করবে।

মানিক মিয়া, সিরাজুদ্দীন হোসেনের আদর্শনিষ্ঠ জীবন সাংবাদিকদের উদ্বেলিত করবে। মুজিব ভাইয়ের অমিত সাহস, প্রত্যয় দৃঢ়চিত্ত রাজনীতিকের মনে আশঙ্কার পরিবর্তে আশার আলো জাগাবে। বিচারপতি কায়ানী থেকে শুরু করে বিএ সিদ্দিকী পর্যন্ত বিচারকদের দৃষ্টান্ত বিচার ব্যবস্থাকে দলীয় প্রভাবের আবর্ত থেকে অবমুক্ত করবে। স্বাধীনতা থেকে ২০০১ পর্যন্ত প্রশাসনের নির্ভীকতা এবং প্রতিভা প্রদীপ্ত চেতনা আবার এখনকার প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের মনে এই বিশ্বাস, এই প্রতীতির জন্ম দেবে যে, তারা কোনো দলের নয়, তারা প্রজাতন্ত্রের; গণমানুষের স্বার্থবিরোধী কোনো নির্দেশ মান্য করা তাদের নৈতিক কর্তব্যের আওতার মধ্যে পড়ে না।

সেখানে হঠাৎ করে সাহস দেখিয়ে সামান্য নির্যাতন সামান্য স্বার্থক্ষুণ্ন হওয়া অথবা প্রাপ্তি-প্রত্যাশার মধ্যে কোনো অন্তরায় সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কায় তার হৃদয়ের বিশ্বাস ও প্রতীতির পথ ছেড়ে দিলে শুধু তার ভাবমূর্তিই নষ্ট হবে না, জাতি এই দুর্বিষহ যন্ত্রণা, সংঘাত এবং প্রতিহিংসাপরায়ণতার আবর্ত থেকে, সামাজিক বিপর্যয় থেকে কখনোই বেরিয়ে আসতে পারবে না। যে জাতি এক সাগর রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছে তার নেতৃত্বের মধ্যে দৈন্য দেখলে মনে হয় আলেকজান্ডারের সেই ঐতিহাসিক উক্তি, 'কি বিচিত্র এ দেশ, সেলুকাস!' সাগর-রুনি হত্যা, অসংখ্য সাংবাদিককে দলীয় কর্মীদের বেধড়ক মারধর, রমজান মাসে ইসলামের নামে হরতাল এগুলোর ব্যাপারে সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, সুশীল সমাজের যতটুকু প্রতিবাদী হওয়া এবং সরব হওয়া উচিত ছিল তা কি তারা হতে পেরেছেন? শেয়ারবাজার, ডেস্টিনি, যুবক, হলমার্কের ব্যাপারে বিরোধী দল, সাংবাদিকসহ এই জাগ্রত সুশীল সমাজের যে প্রতিবাদে গর্জে ওঠার কথা ছিল, জনমতকে যেভাবে সংগঠিত করার দায়িত্ব ছিল সেটা কি আমরা করতে সক্ষম হয়েছি? কিছু ব্যতিক্রম বাদে জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে গোটা রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, বিচারিক, সুশীল সমাজ আজকে কি দুটি নেত্রীর শর্তহীন আজ্ঞাবহ হয়ে যায়নি?

এসবকে কি বলব, 'ভাগ্যের নির্মম পরিহাস', নাকি আলেকজান্ডারের সেই উক্তি ফের উচ্চারণ করে বলব, 'সত্যিই সেলুকাস, কি বিচিত্র এই দেশ!'

লেখক : স্বাধীন বাংলা ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক।

 

 

সর্বশেষ খবর